সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বুধবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম



বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
বাংলা একাডেমী ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা বানানকে নিয়মিত, অভিন্ন ও প্রমিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে একটি নিয়ম দাঁড় করিয়েছিলেন। যার ‘পরিমার্জিত ও সংশোধিত’ সংস্করণ তাঁরা ১৯৯৪-এর জানুয়ারিতে প্রকাশ করেন।
তাঁদের সেই ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকায় বলেছেন, ‘এখন থেকে বাংলা একাডেমী তার সকল কাজে, তার বই ও পত্রপত্রিকায় এই বানান ব্যবহার করবে। ভাষা ও সাহিত্যের জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে বাংলা একাডেমী সংশ্লিষ্ট সকলকে- লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষভাবে সংবাদপত্রগুলোকে, সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে- এই বানান ব্যবহারের সুপারিশ ও অনুরোধ করছে’। ২০১২ সাল থেকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ তাদের অনুমোদিত ও প্রকাশিত সকল পুস্তকে এই বানানরীতি অনুসরণ করছেন। ২০১২ সালে মুদ্রিত প্রাথমিক স্তরের সকল পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা ‘প্রসঙ্গ-কথা’য় প্রফেসর মোঃ আবুল কাসেম মিয়া, চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা বলেন, ‘বানানের ক্ষেত্রে সমতা বিধানের জন্য অনুসৃত হয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত বানানরীতি’।
প্রমিত বাংলা বানান বলতে আমরা স্ট্যান্ডার্ড বা মানসম্পন্ন বুঝি যে যে ভাষায় কথা বলুক না কেন তার একটি শুদ্ধরূপ আছে, স্বকীয়তা আছে, অর্থাৎ প্রত্যেক ভাষারই একটি সর্বজনগ্রাহ্য শুদ্ধরূপ আছে ভাষাবিজ্ঞানীদের পরিভাষায় একেই বাংলা বানানের নিয়ম বলা হয়
এখানে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানান বিষয়ক সুপারিশ উদ্ধৃতি করে দিচ্ছি  :
তৎসম শব্দ
.০১.      তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অপরিবর্তিত থাকবে কারণ এসব               শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে তবে এই বানানরীতিতে যেসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রস্তাবিত হয়েছে, তা অনুসৃত হবে
.০২.    তবে যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয়ই শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তারকারচিহ্ন ‘ি’  ব্যবহৃত হবে যেমন কিংবদন্তি , খঞ্জনি , চিৎকার , ধমনি , ধূলি , পঞ্জি , পদবি , ভঙ্গি , মঞ্জরি , মসি , লহরি , সরণি , সূচিপত্র , উর্ণা , উষা
.০৩.   রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না যেমন অর্চনা , অর্জন , অর্থ , অর্ধ , কর্দম , কর্তন , কর্ম , কার্য , গর্জন , মূর্ছা , কার্তিক , বার্ধক্য , বার্তা , সূর্য
.০৪.   সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার ( ) লেখা যাবে যেমন অহংকার , ভয়ংকর , সংগীত , শুভংকর , হৃদয়ংগম , সংঘটন বিকল্পে ঙ্ লেখা যাবে ক্ষ-এর পূর্বে সর্বত্র ঙ্ হবে যেমন আকাঙ্ক্ষাতবে অঙ্ক , অঙ্গ , বঙ্গ , সঙ্গ , সঙ্গী প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে স্থানে হবে না
-তৎসম শব্দ অর্থাৎ তদ্ভব , দেশী , বিদেশী , মিশ্র শব্দ
.০১.    ই ঈ উ ঊ
সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব , দেশী, বিদেশী ও মিশ্র শব্দে কেবল ই বং উ এবং এদের -কারচিহ্ন ই-কার ( ি ) এবং উ-কার (ু ) ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন গাড়ি, বাড়ি, শাড়ি, ভারি, দাড়ি, চুরি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচে, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ
অনুরূপভাবে –আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি। তবে নাম-বিশেষ্যের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় চলতে পারে।
সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার ( ী )  দিয়ে লেখা হবে। যেমন কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি? তোমার কী? এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!
অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার ( ি ) দিয়ে কি শব্দটি লেখা যাবে। যেমন তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলায় কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী।
পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন ছেলেটি, লোকটি, বইটি।
২.০২. ক্ষ
তৎসম শব্দের বানানে ক্ষ ঠিক থাকবে। যেমন ক্ষীর, ক্ষুর, ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে ইত্যাদি লেখা হবে।
২.০৩. মূর্ধণ্য ণ, দন্ত্য ন
তৎসম শব্দের বানানে ণ ও ন-এর নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী ও মিশ্র কোন শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি মানা হবে না। অর্থাৎ ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গুনতি, গোনা,ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন।
তৎসম শব্দে ঠ, ঠ, ড, ঢ-এর পূর্বে ‘ণ’ হয়; যেমন কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড। কিন্তু তৎসম শব্দ ছাড়া সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট, ঠ, ড, ঢ-এর আগেও কেবল ন হবে।
২.০৪. শ ষ স
তৎসম শব্দের বানানে শ ষ স-এর নিয়ম মানতে হবে। এ-ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না।
বিদেশী মূল শব্দে শ স-এর যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে, বাংলা বানানে তা-ই ব্যবহার করতে হবে। যেমন সাল, সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলা, জিনিস, আপোস, সাদা, পোশাক, বেহেশত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট। তবে পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে। তৎসম শব্দে ঠ, ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয়। যেমন বৃষ্টি, দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে। যেমন স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট।
কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা যাবে।
২.০৫. আরবি-ফার্সি শব্দে ‘সে’ ث, ‘সিন্’س , ‘সোয়াদ’ص  বর্ণগুলোর প্রতিবর্ণরূপে স এবং ‘শিন’ ش  -এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যবহৃত হবে। যেমন সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস), বেহেশত।
এই ক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয়। তবে যেখানে বাংলা বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স, ছ-এর রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যবহার করতে হবে। যেমন পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ।
২.০৬.    ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী  s বর্ণ বা ধ্বনির জন্যএবং sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্যব্যবহৃত হবে যেমন সেশন, নেভিগেশন ইত্যাদি তবে question ইত্যাদি শব্দের বানান অন্যরূপ, যেমন- কোএস্চন হতে পারে
.০৭. জ য
বাংলায় প্রচলিত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে যেমন কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা।  
কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে ‘যে’  د   , ‘যাল’  ذ   , ‘যোয়াদ’  ض , ‘যোই’  ظ রয়েছে , যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণগুলোর জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত যেমন আযান, ওযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন
জাদু, জোয়াল, জো ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়
.০৮. এ অ্যা
বাংলায় এ বা  ‘ে’ (-কার) দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয় তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সব বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা ে (এ-কার) হবে যেমন দেখে, দেখি, যেন, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে।
বিদেশী শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা ে (এ-কার ) ব্যবহৃত হবে। যেমন এন্ড, নেট, বেড, শেড।
বিদেশী শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা য-ফলা আ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন অ্যান্ড, অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট।
তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশী শব্দ রয়েছে যার য-ফলা আ-কারযুক্ত রূপ বহুল পরিচিত। যেমন ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে য-ফলা আ-কার অপরিবর্তিত থাকবে।
২.০৯. ও
বাংলায় অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়। এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ‘ো’ (ও-কার) ব্যবহার করছেন। যেমনছিলো, বললো, করলো, বলতো কোরছে, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য) ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ‘ো’ (ও-কার ) ব্যবহার করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছ এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য পদ যার শেষে ো যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমনধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো।
২.১০. ং ঙ
তৎসম শব্দে  ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ সম্পর্কে ১.০৪ অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে। তদ্ভব, দেশী, বিদেশী ও মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে। বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের। বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি ং (অনুস্বার) দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে
২.১১. রেফ (  ©© ) ও দ্বিত্ব
তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার।
২.১২. বিসর্গ
শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ ) থাকবে না। যেমন কার্যত, মূলত, প্রধানত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ। তবে যেসব শব্দের শেষে বিসর্গ না থাকলে অর্থের বিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেখানে শব্দের শেষে বিসর্গ থাকবে। যেমন-- পুনঃপুনঃ। পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়। যেমন দুস্থ, নিস্পৃহ।
২.১৩. –আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ
-আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ‘ো’ (ও-কার) যুক্ত করা হবে। যেমন করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো।
২.১৪. বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ
বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে। তাই ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাৎ ভেঙে দেওয়া উচিত নয়। শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয়। যেমন স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং। তবে কিছু কিছু বিশ্লেষ করা যায়। যেমন সেপটেম্বর, অকটোবর, মার্কস, শেকসপিয়ার, ইসরাফিল।
২.১৫. হস-চিহ্ন
হস-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক।
২.১৬. ঊর্ধ্ব-কমা
ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন করল (=করিল), ধরত (=ধরিত), বলে (=বলিয়া), হয়ে, দু জন, চার শ, চাল (=চাউল), আল (=আইল) ।
বিবিধ
৩.০১.     যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলো যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলোর স্পষ্ট রূপ দিতে হবে। সেজন্যে কতকগুলো স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন গু , রু , শু , দ্রু , শ্রু , রূ , ভ্রু , হূ , হৃ , ত্র , ভ্র। তবে ক্ষ-এর পরিচিতি যুক্তরূপ অপরিবর্তিত থাকবে।
৩.০২.    সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না। যেমন সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমণ্ডিত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সংকল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র।
বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো একটির বেশি, হাইফেন ( - ) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন মা-মেয়ে,  মা-ছেলে, বেটা-বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্যৎ-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু।
৩.০৩.    বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধি ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গুণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেই যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন কতদূর যাবে, একজন অতিথি, তিনহাজার টাকা, বেশিরভাগ ছেলে, শ্যামলা-বরন মেয়ে। তবে কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে। যেমন দুজনা।
৩.০৪.    নাই, নেই, না, নি, এই নঞর্থক অব্যয়পদগুলো শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই।
তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে না উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন নারাজ, নাবালক, নাহক।
অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে ‘না’ –এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যেমন  না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না-গোনা পাখি।
৩.০৫.    উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে। কোনো পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনুরূপ না হয়, উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে। যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত করে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে শুদ্ধ বানানটির উল্লেখ করতে হবে। এক বা দুই ঊর্ধ্ব-কমার দ্বারা উদ্ধৃত অংশকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না। তাছাড়া কবিতা যদি মূল চরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সে-ক্ষেত্রেও উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেয়ার দরকার নেই। ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনার কোনো অংশ যদি বাদ দেয়া হয় অর্থাৎ উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেয়ার স্থানগুলোকে তিনটি বিন্দু বা ডট্ (অবলোপ-চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহৎ অংশ বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটি ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।
কোনো পুরাতন রচনার অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তিত করা যেতে পারে




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন