সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বাংলা বর্ণমালা পরিচিতি ও উচ্চারণ (ব্যঞ্জনবর্ণ)


বাংলা বর্ণমালা পরিচিতি ও উচ্চারণ (ব্যঞ্জনবর্ণ)
         ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞাতব্য যে, উচ্চারণের সুবিধার জন্য বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণে দ্যোতিত ধ্বনি ‘অ’ স্বরধ্বনিটি যোগ করে উচ্চারণ করা হয়ে থাকে। যেমন, ক্+অ=ক, চ্+অ=চ, ট্+অ=ট, ত্+অ=ত, প্+অ=প ইত্যাদি। এরূপ স্থলে ব্যঞ্জনধ্বনিটির সঙ্গে ‘অ’ ধ্বনিটির মিলিত উচ্চারণে একটি পূর্ণ অক্ষর (Syllable) হয়। এটি একটি মুক্ত অক্ষর (Open syllable)। বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ পাঠের সময় এ নিয়ম মেনে চলা হয়। এ কারণে আমরা বলি, ‘ক’ অক্ষর, ‘প’ অক্ষর, ‘হ’ অক্ষর ইত্যাদি। প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনভাবে নাম উল্লেখ করার সময় ‘ক’ ধ্বনি এবং ‘ক’ বর্ণ এরূপ বলতে হয়। যখন ব্যঞ্জনধ্বনিটির উচ্চারণের সময় ফুসফুস তাড়িত বায়ু নিঃসরণ হয় না, কোথাও আটকে যায়, তখন সেটি বদ্ধ অক্ষর (Closed syllable)। স্বরধ্বনি সংযুক্ত না হয়ে অর্থাৎ বদ্ধ অক্ষররূপে উচ্চারিত ধ্বনির প্রতীক বা বর্ণের নিচে ‘হস্’ বা ‘হল্’ চিহ্ন (্) দিয়ে লিখিত হয়। এরূপ বর্ণকে বলা হয় হসন্ত বা হলন্ত বর্ণ।

 নিচের ছকে ক্রমান্বয়ে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচিতি ও উচ্চারণ দেওয়া হলো :-
বর্ণ
বাংলা নাম ও উচ্চারণ
রোমান প্রতিবর্ণ
(অভ্র ফোনেটিক কীবোর্ডে)
আন্তর্জাতিক ধ্বনিবর্ণে উচ্চারণ
ko
k [kɒ]
as in cat /kæt/
kho
kh [khɒ]
as in khaki /`kɑ:kɪ/ 
go
ɡ [ɡɒ]
as in got /ɡɒt/
gho
ɡh [ɡhɒ]
as in ghastly, ghat
ঙ (উয়োঁ)
n,   Ng
ŋ [uõ]
as in sing /sɪŋ/
co
ʧ [ʧɒ]
as in chin /ʈʃɪn/
cho
s [sɒ]
as in civil /sɪvl/
জ (বর্গীয় জ)
jo
ʤ [ʤɒ]
as in June /ʤu:n/
jho
ʤh [ʤhɒ]

ঞ (ইঁঅঁ)
NG
iõ [iõ]

To
   [ṭɒ]
as in tea /ti:/
Tho
ṭh   [ṭhɒ]

Do
d [dɒ]
as in did /dɪd/
Dho
dh [dhɒ]

ণ (মূর্ধন্য ণ)
No
n [murdhɒnnɒ nɒ]

to
t[tɒ]

tho
 θ [θɒ]
as in thin /θɪn/
do
δ [δɒ] 
as in then /δen /
dho
δhɒ [δhɒ]

ন (দন্ত্য ন)
no
n [dɒntɒ nɒ]
as in no /nəʊ /
po
p [pɒ]
as in pen /pen/
pho, fo
f [fɒ]
as in fall /fɔ:l/
bo
b [bɒ]
as in bad /bæd/
bho, vo
v [vɒ]
as in voice /vɔɪs/
mo
m [mɒ]
as in man /mæn/
য (অন্তঃস্থ য)
zo
z [ɒntɒsthɒ ʤɒ]
as in zoo /zu:/
ro
r [rɒ]
as in red /red/
lo
l [lɒ]
as in leg /leɡ/
শ (তালব্য শ)
So, sho
ʃ [ʃɒ]
as in she /ʃi:/
ষ (মূর্ধন্য ষ)
Sho
ʃh [ʃhɒ]

স (দন্ত্য স)
so
s [sɒ]
as in so /səʊ/
ho
h [hɒ]
as in how /hau/
ড় (ড শূন্য ড়)
Ro
ṛ [dɒ ʃunnɒ    ṛɒ]

ঢ় (ঢ শূন্য ঢ়)
Rho
ṛh [dhɒ ʃunnɒ ṛhɒ]

য় (অন্তঃস্থ য়)
yo, Yo
y [ɒntosthɒ yɒ]

ৎ (খণ্ড ত্/হসন্ত ত্)
t``
t` [khɒndɒ   t`ɒ

 
ং (অনুস্বার) ঙ্
ng
ŋ  [ɒnuʃʃʌr]

ঃ (বিসর্গ) হ্
:
h` [biʃɒrɡɒ]

ঁ (চন্দ্রবিন্দু) (ঁ)
^
῀ [ʧɒnδrɒbinδu]


বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের সমস্যা নানাবিধ তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, উচ্চারিত ধ্বনি একটি কিন্তু লেখার বর্ণ প্রতীক একাধিক। যেমন : ঙ, ং, জ, য, ত, ৎ, ন, ণ এবং শ, ষ, স তো আছেই। এরপরে আছে যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের বিচিত্র উচ্চারণ-সমস্যা। যেসব ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণে ও লিখিত প্রতীকে পার্থক্যহেতু সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেসব বর্ণ নিয়েই এক্ষেত্রে আলোচনা করা হলো।
১.    :    বাংলা ভাষা-শিক্ষার্থীকে ‘ঙ’ বর্ণটির নাম জানানো হয় ‘উয়োঁ’ রূপে (অঞ্চলভেদে উম, উওঁ, উআঁ ইত্যাদি)। কিন্তু এর প্রাচীন নাম বা পরিচিতি যাই হোক, আধুনিক বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত এ বর্ণটি কখনও ‘উয়োঁ’ রূপে উচ্চারিত হয় না, হয় ‘অঙ’ রূপে। ধ্বনিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই এ ধ্বনিকে চিহ্নিত করেছেন‘ঘোষ বা নিনাদিত পশ্চাত্তালুজাত নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি (ঙ) রূপে। কতিপয় উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে : রঙ, ঢঙ, সঙ, রাঙা, সঙ্গিন, কঙ্কন, গঙ্গা, সঙ্ঘ, বেঙ ইত্যাদি শব্দে ব্যবহৃত ‘ঙ’-র উচ্চারণ নিঃসন্দেহে—‘অঙ’। উঁয়ো হলে উচ্চারণ হতো রঙ (রউয়োঁ), বেঙ (বেউয়োঁ) ইত্যাদি।

.:      এই বর্ণটির পরিচিতি অনুনাসিক ‘য়ঁ’ অর্থাৎ ইঁঅঁ রূপে (বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ‘নিঅঁ’ বা নিঁওঁ’ হিসেবে)। কিন্তু ‘ঞ’-র মূল উচ্চারণ কেবল ‘মিঞা’, ‘ভূঞা’ (ভুইআঁ)-র মতো দু’চারটি শব্দে শোনা যায় এবং স্বাধীনভাবে অন্যত্র বর্ণটি ব্যবহৃতও হয় না।
‘ঞ’ সাধারণত ‘চ’ বর্গের (চ, ছ, জ, ঝ) চারটি বর্ণের পূর্বে যুক্তাবস্থায় ব্যবহৃত হয় তবে ক্ষেত্রবিশেষে ‘চ’ এর পরে বসে (যাচ্ঞাজাচ্না) এবং বাংলা উচ্চারণে ‘দন্ত্য ন’-এর মতো হয়। যথা : পঞ্চ (পন্চ), লাঞ্ছিত (লান্ছিত), রঞ্জ (রন্জো), ব্যঞ্জন (ব্যান্জোন্), ঝঞ্ঝা (ঝন্ঝা) ইত্যাদি।
ঞ্ + জ = ঞ্জ এই যুক্তধ্বনিতে ‘ঞ’-এর উচ্চারণ ‘ন’ হলেও ‘জ’-এর উচ্চারণ অবিকৃত, কিন্তু জ্ + ঞ = জ্ঞ-তে, ‘জ’ এবং ‘ঞ’ বর্ণ দুটোর কোনোটিরই উচ্চারণ নেই। সংস্কৃতে এর উচ্চারণ ছিল ‘জ্ ঞ’ (অর্থাৎ অনেকটা ‘জ্যাঁ’-এর মতো) কিন্তু বাংলায় শব্দের আদিতে এর উচ্চারণ হয় অনেকটা ‘গঁ’ বা ‘গ্যঁ’-এর মতো, আর শব্দের মধ্যে ও অন্তে উচ্চারিত হয় ‘গ্গঁ’-এর ন্যায়। যথা : আদিতে জ্ঞ (গঁ/গ্যঁ), জ্ঞাত (গ্যাঁতো), জ্ঞান (গ্যাঁন্), জ্ঞাপন (গ্যাঁপন্/-পোন্); মধ্যে ও অন্তে বিজ্ঞান (বিগ্‌গ্যাঁন), বিজ্ঞপ্তি (বিগ্‌গোপ্‌তি), অজ্ঞান (অগ্‌গ্যাঁন), অবজ্ঞা (অবোগ্‌গাঁ), অজ্ঞ (অগ্‌গোঁ), বিজ্ঞ (বিগ্‌গোঁ), বিশেষজ্ঞ (বিশেশোগ্‌গোঁ), দৈবজ্ঞ (দোইবোগ্‌গোঁ) ইত্যাদি।

.    :   এ ধ্বনিটির নাম মূর্ধন্য ‘ণ’। ‘ণ’-এর উচ্চারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য : ‘বাংলা বর্ণমালার আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য ‘ন’ –এ ভেদাভেদ –তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। ‘মূর্ধন্য ণ’ এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই।’ আর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘মূর্ধন্য ণ’-এর ধ্বনি এখন বাঙ্গালাতে নাই। বাঙ্গালায় ইহার উচ্চারণ দন্ত্য ‘ন’-এর উচ্চারণ হইতে অভিন্ন।’ বিশুদ্ধ মূর্ধন্য ‘ণ’-এর ধ্বনি (অনেকটা ‘ড়ঁ’-এর মতো) বাংলা ভাষায় নেই। ফলে লিখিত রূপে ‘ণ’ থাকলেও উচ্চারণগত দিক থেকে এ বর্ণটি দন্ত্য ‘ন’-এর সঙ্গে অভিন্ন (কেউ কেউ অবশ্য ট্, ঠ্, ড্, ঢ্-এর আগে মূর্ধন্য ণ-কারের কিঞ্চিৎ আভাস স্বীকার করেন)। অধ্যাপক আবদুল হাই তাঁর ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেছেন, “বানান যেখানে যেমনই হোক অসংযুক্ত ‘ণ’ উচ্চারণ বাংলাতে খাঁটি দন্তমূলীয়ই। মূর্ধন্য ‘ণ’-এর উচ্চারণগত এ-সীমিত ব্যবহারই একে মূলধ্বনি (phoneme) থেকে অপসারিত করে দন্তমূলীয় ‘ন’-এর একটি সদস্য বা allophone রূপে পরিগণিত করেছে।” ‘ণ’ এবং ‘ন’-এর উচ্চারণ যে অভিন্ন, কয়েকটি উদাহরণ দিলেই তা প্রমাণিত হবে। যেমন : ধরণী (ধরোনি), রণ (রন্), পাষাণ (পাশান্), চরণ (চরোন্), স্মরণ (শঁরোন্/-রন্), সরণী (শরোনি, তরুণ (তোরুন্), অরুণ (ওরুন্) ইত্যাদি। এর প্রতিটি ‘ণ’-এর উচ্চারণই দন্ত্য ‘ন’ থেকে অভিন্ন।

. (অন্তঃস্থ ‘য’)   :  এর সংস্কৃত উচ্চারণ ‘ইঅ’ (ya)-র মতো কিন্তু বাংলা উচ্চারণে এটি পরিষ্কার ‘জ’ অর্থাৎ বাংলা ভাষায় এর উচ্চারণ চ-বর্গীয় জ-থেকে অভিন্ন। যথা : যম (জম্), জামাই (জামাই), যখন (জখোন্), যুক্ত (জুক্তো), জন্তু (জোন্তু),  যোগ (জোগ্), জন্য (জোন্নো), যদি (জোদি), জল (জল্) ইত্যাদি।

. শ, ষ, স   :   এ তিনটি ‘শ’ বাংলা ভাষার উচ্চারণে কেবল বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত। যথা : তালব্য ‘শ’, মূর্ধন্য ‘ষ’ এবং দন্ত্য ‘স’। আসলে এই তিনটি ‘শ’-ই ‘শ’ (ইংরেজির ‘sh’)-এর মতো উচ্চারিত। প্রাচীনকালে এগুলোর পৃথক উচ্চারণ ছিল কিন্তু আধুনিক বাংলা ভাষায় প্রতিটি ‘শ’-ই “বাংলার শিস জাতীয় মূলধ্বনি (phoneme)।” কেবল ত, থ, ন, র, ল-এর পূর্ববর্তী ধ্বনি হিসেবে ‘শ’-এর দন্ত্য স (স) ধ্বনির উচ্চারণ শোনা যায়। এটাকে ‘শ’-এর দন্ত্য সহধ্বনি বা পূরক ধ্বনি (allophone) বলা যায়। যথা :

ত : সমস্ত (শোমোস্‌তো/ শমোস্‌তো), ব্যস্ত (ব্যাস্‌তো), গ্রস্ত (গ্রোস্‌তো) বস্তি (বোস্‌তি), আস্তে (আস্‌তে), রাস্তা (রাস্‌তা) কাস্তে (কাস্‌তে), দস্তা (দস্‌তা), মস্তক (মস্‌তক্/-তোক্) ইত্যাদি।

থ : আস্থা (আস্‌থা), স্থান (স্থান্), সুস্থ (শুস্‌থো), উপস্থিত (উপোস্‌থিত্), ব্যবস্থা (ব্যাবোস্‌থা), মুখস্থ (মুখোস্‌থো), অস্থাবর (অস্থাবোর্) ইত্যাদি।

ন : স্নান (স্নান্) স্নেহ (স্নেহো), প্রশ্ন (প্রোস্‌নো), স্নায়োবিক (স্নায়োবিক), স্নিগ্ধ (স্নিগ্‌ধো) ইত্যাদি।

র : শ্রদ্ধা (স্রোদ্‌ধা), শ্রবণী (স্রোবোনি), শ্রম (স্রোম্), শ্রব্য (স্রোব্‌বো), শৃঙ্গ (সৃঙ্‌গো), শৃঙ্খল (সৃঙ্‌খল্) শৃগাল (সৃগাল্), শ্রাবণ (স্রাবোন্), শ্রোতা (স্রোতা), স্রোত (স্রোতো/স্রোত্), শ্রুতি (স্রুতি), শ্রেষ্ঠ (স্রেশ্‌ঠো), শ্রেয়সী (স্রেয়োশি), বিশ্রী (বিস্‌স্রি), শ্রী (স্রি) ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে,    ‘ক্‌ + ষ’ --মিলে ক্ষ (খিয়ো)-এর সংস্কৃত উচ্চারণ ‘ক্‌ষ’। যথা : দক্ষ (দক্‌ষ), যক্ষ (ইঅক্‌ষ), পক্ষ      (পক্‌ষ) ইত্যাদি। কিন্তু বাংলা ভাষায় পদের প্রথমে এর উচ্চারণ স্পষ্ট ‘খ’-এর মতো এবং মধ্যে ও অন্তে ক্‌খ-এর অনুরূপ হয়। যেমন : ক্ষত (খতো), ক্ষুধিত (খুধিতো), ক্ষেত্র (খেত্‌রো), ক্ষমতা (খমোতা), ক্ষতি (খোতি), পদের মধ্যে ও অন্তে--- দক্ষ (দোক্‌খো), যক্ষ (জোক্‌খো), রক্ষা (রোক্‌খা), পরীক্ষা (পোরিক্‌খা), অক্ষয় (অক্‌খয়), বুভুক্ষা (বুভুক্‌খা), অক্ষাংশ (ওক্‌খাঙশো), পক্ষান্তরে (পোক্‌খান্‌তরে), পাক্ষিক (পাক্‌খিক্‌) ইত্যাদি।

. ড়,     :   ‘ড়’ ও ‘ঢ়’ এই বর্ণ দুটো সংস্কৃতে নেই। সংস্কৃতে সর্বত্র ‘ড’ এবং ‘ঢ’ অবিকৃতভাবে উচ্চারিত হতো। এজস্যে আধুনিক বাংলার ‘নাড়ু’ সংস্কৃতে ছিল ‘নাডু’ এবং বাংলার ‘মূঢ়’ সংস্কৃতে ‘মূঢ’। বর্ণ দুটোর পরিবর্তিত উচআরণের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনিই প্রথম ‘ড’ ও ‘ঢ’ এর নিচে বিন্দু দিয়ে আধুনিক বাংলা বর্ণমালায় স্থান করে দেন। ‘ড শূন্য ড়’ ‘ঢ শূন্য ঢ়’ এর উচ্চারণ স্থান ও রীতি প্রায় অভিন্ন। প্রখ্যাত ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই-এর মতে ‘ধ্বনির দিক থেকে দুটোই নিনাদিত বা ঘোষধ্বনি, পার্থক্য তাদের মধ্যে শুধু বাতাসের নির্গমন পদ্ধতিতে। অন্য কথায় ‘ড়’ স্বল্পপ্রাণ আর ‘ঢ়’ মহাপ্রাণ। ‘ড়’ এর ধ্বনিতত্ত্বগত নাম ঘোষ অল্পপ্রাণ দন্তমূলীয় তাড়নজাত ধ্বনি (voiced unaspirated alveolo flapped sound)       আর ‘ঢ়’ এর নাম ঘোষ মহাপ্রাণ দন্তমূলীয় তাড়নজাত ধ্বনি (voiced aspirated alveolo flapped sound)

.  (অন্তঃস্থ ‘য়’) :  অন্তঃস্থ ‘য়’-এর উচ্চারণ পদমধ্যে এর সঙ্গে যুক্তস্বরের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলা শব্দের অভ্যন্তরে পাশাপাশি দুটো স্বরধ্বনি থাকলে, যদি দুটো স্বর মিলে একটি যৌগিক স্বরে বা সন্ধ্যক্ষরে পরিণত না হয়, তা হলে এই দুটো স্বরের মধ্যে Hiatus বা ব্যঞ্জনের অভাব জনিত ফাঁকটুকুতে উচ্চারণের সুবিধার্থে অন্তঃস্থ ‘য়’ (y) বা অন্তঃস্থ ‘ব’ (w) = ওয় ও-এর আগম হয়। মুহম্মদ আবদুল হাইও তাঁর ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।

. ৎ (খণ্ড ত) :     ৎ (খণ্ড ত) প্রকৃত প্রস্তাবে ‘ত’-এর খণ্ডরূপ। প্রাচীন লিপিকারদের হাতে ‘ত’-এ হস্ চিহ্ন দিতে গিয়ে হাত না তোলার কারণে (হসন্ত ত = ৎ) এরূপ হয়েছে। খণ্ড ৎ এবং হসন্ত ত্-এ উচ্চারণগত কোনো পার্থক্য নেই। অনেক স্থানে এই বর্ণটিকে হসন্ত ত্ বলা হয়।

. ং (অনুস্বার)  :    আধুনিক বাংলা ভাষার উচ্চারণগত দিক থেকে ‘ং’ (অনুস্বার) এবং হসন্তযুক্ত ‘ঙ’ সম্পূর্ণ অভিন্ন। সংস্কৃতে ‘ং’ (অনুস্বার) যে-বর্ণের পরে সংযুক্ত হতো, সে-স্বরবর্ণকে আংশিকভাবে সানুনাসিক করে দিতো। বাংলা ভাষায় ‘ং’ (অনুস্বার)-এর উচ্চারণ সর্বত্র ‘অঙ’ (অঙ্) যথা : অংশ (অঙ্‌শো), বংশ (বঙ্‌শো), কংশ (কঙ্‌শো), হংস (হঙ্‌শো), অংশী (ওঙ্‌শি), জংলা (জঙ্‌লা), দংশ (দঙ্‌শো), মাংস (মাঙ্‌শো), রং (রঙ্‌), শংখ (শঙ্‌খো), শংসা (শঙ্‌শা), সংগ্রহ (শঙ্‌গ্রোহো), সংগ্রাম (শঙ‌্গ্রাম), সংক্ষিপ্ত (শঙ্‌খিপ্‌তো), সংজ্ঞা (শঙ্‌গাঁ), সংবর্ত (শঙ্‌বর্‌তো) ইত্যাদি।

১০. ঃ (বিসর্গ)  :    সংস্কৃত ‘ঃ’ (বিসর্গ) এর উচ্চারণ ছিল অনেকটা ‘অর্ধ-হ্’-এর মতো। বাংলায় কেবল বিস্ময়-সূচক অব্যয়ের ক্ষেত্রে আমরা প্রাচীনকালের ‘ঃ’ (বিসর্গ) উচ্চারণের রেশ শুনতে পাই। যেমন : আঃ (আহ্), বাঃ (বাহ্), উঃ (উহ্), ওঃ (ওহ্) ইত্যাদি।
এ-ব্যতিরেকে আধুনিক বাংলা ভাষায় ‘ঃ’ (বিসর্গ)-এর উচ্চারণ সাধারণত হয় না। তবে শব্দের অন্তিমে বিসর্গ থাকলে সংস্কৃতের মতো সর্বত্র অর্ধ-‘হ্’ উচ্চারিত না হলেও শেষের ‘অ’-এর উচ্চারণ ওকারান্ত হয়ে থাকে।        যথা : পুনঃ (পুনো), প্রণত (প্রোনতো) ইত্যাদি।
পদের মধ্যে ‘ঃ’ (বিসর্গ) থাকলে, বাংলা উচ্চারণে, বিসর্গ-পরবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণটি দু’বার উচ্চারিত হয়ে থাকে।   যথা : অতঃপর (অতোপ্‌পর), নিঃশঙ্গ (নিশ্‌শঙগো), নিঃশেষ (নিশ্‌শেশ), নিঃসন্তান (নিশ্‌শন্‌তান), নিঃসম্বল (নিশ্‌শম্‌বল্/-বোল্), দুঃখ (দুক্‌খো), অন্তঃসার (অন্‌তোশ্‌শার্), দুঃসময় (দুশ্‌শময়্), পুনঃপুন (পুনোপ্‌পুনো) দুঃসাহস (দুশ্‌শাহোশ্) ইত্যাদি।  

১১. ঁ (চন্দ্রবিন্দু)  :    ঁ (চন্দ্রবিন্দু) এ-ধ্বনির ভূমিকা প্রসঙ্গে মুহম্মদ আবদুল হাই-এর মন্তব্য : “ বাংলায় স্বরধ্বনিকে সানুনাসিক করার চিহ্ন (ঁ) চন্দ্রবিন্দু; ইংরেজি নাম moon-dot ।” এ-সব অনুনাসিক স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয় নাক ও মুখের মিলিত দ্যোতনায় (“ Combined resonance of nose and mouth”)। একে অনেকে ‘নাকিসুরে’ উচ্চারণ বলে থাকেন। বাংলাদেশের সর্বত্র এ-উচ্চারণ নিখুঁত হয় না (এমনকি বহু শিক্ষিত লোকেরও)। কিন্তু এর উচ্চারণ বিকৃতি বা বিলুপ্তির জন্যে শব্দের অর্থগত বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। যথা : কাদা (কর্দম), কাঁদা (ক্রন্দন), শাখা (ডাল), শাঁখা (শঙ্খ), রাধা (রাধিকা), রাঁধা (রন্ধন), পাক (পবিত্র, রান্না), পাঁক (পঙ্ক), বাধা (প্রতিবন্ধক), বাঁধা (বন্ধন), ফোড়া (ব্রণ, স্ফোটক), ফোঁড়া (ছিদ্র করা),ছাদ (আচ্ছাদনী), ছাঁদ (ছন্দ, গঠন, ধরন), তাত (আঁচ, উষ্ণতা), তাঁত (তন্তু, কাপড় বোনার যন্ত্র), চাচা (কাকা, পিতৃব্য), চাঁচা (মার্জিত), গাদা (ঠাসা), গাাঁদা (ফুলবিশেষ), গাথা (পালাগান), গাঁথা (গ্রন্থন করা), কাটা (ছেদন, কর্তন, বিভক্ত), কাঁটা (কন্টক), ফোটা (বিকশিত হওয়া),  ফোঁটা (বিন্দু, তিলক), খাড়া (সোজা), খাঁড়া (খড়্‌গ), গোড়া (মূল, শিকড়), গোঁড়া (অন্ধবিশ্বাসী), দাড়ি (শ্মশ্রু), দাঁড়ি (তুলাদণ্ড) ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়-- যেসব মূল শব্দ বর্গের পঞ্চম বর্ণ-সহযোগে (ঙ, ঞ, ণ, ম) গঠিত, সেসব মব্দের পরিবর্তিত (তদ্ভব) রূপেই সাধারণত নাসিক্য (ঁ) প্রতীক ব্যবহৃত হয়। যথা : চাঁদ (< চন্দ্র), ছাঁদ (< ছন্দ), দাঁত (< দন্ত), কাঁটা (< কন্টক), ষাঁড় (< ষণ্ড), ভাঁড় (< ভাণ্ড), দাঁড় (< দণ্ড), পাঁচ (< পঞ্চ), আঁচল (< অঞ্চল), আঁধার (< অন্ধকার) ইত্যাদি।

            পরিশেষে বলতে হয়, আমাদের উচ্চারণ-দুর্বলতার প্রধান প্রমাণ আমরা বর্ণমালার অনেক বর্ণকেই বিশেষণ-সংযুক্ত করে চিহ্নিত করি। অর্থাৎ তিনটি ‘শ’ (শ, ষ, স), দুটো ‘জ’ (জ, য), দুটো ‘ন’ (ণ, ন) ইত্যাদি সমোচ্চারিত বর্ণের ক্ষেত্রে যেমন, তালব্য, মূর্ধন্য, দন্ত্য, বর্গীয়, অন্তঃস্থ এ-ধরনের বিশেষণ প্রযুক্ত করে লিপি-স্বাতন্ত্র্য জ্ঞাপন করি, তেমনি, ব-এ শূন্য, ড-এ শূন্য এবং ঢ-এ শূন্য বলে র, ড় এবং ঢ়-এর পার্থক্য বুঝিয়ে থাকি। অথচ এদের ধ্বনিগত পার্থক্য বিলুপ্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে শব্দের অর্থ বিপর্যয় ঘটায়। যথা :
ড় স্থানে র : আমড়া--- আমরা, নাড়ী--- নারী, মাড়ী--- মারী, তাড়ি--- তারি, বাড়ি--- বারি, পাড়ি--- পারি,    চড়--- চর, ধড়--- ধর, চুড়ি--- চুরি, ঘোড়া--- ঘোরা, সাড়া--- সারা, জোড়--- জোর, মোড়--- মোর,    পড়ে--- পরে, মাড়--- মার, জাড়--- জার, দেড়--- দের, পাড়া--- পারা, পোড়া--- পোরা, ভেড়ি--- ভেরি ইত্যাদি। 
ঢ় স্থানে ড় : মূঢ়--- মুড়, গূঢ়--- গুড়, গাঢ়--- গাড়, প্রৌঢ়--- প্রৌড় ইত্যাদি।
        তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণধ্বনি উচ্চারণেও একাকার হয়ে যায়। অনেক শিক্ষিত লোককেও বানানের ক্ষেত্রে বড় ‘ক’, ছোট ‘ক’, ঘোড়ার ‘গ’ প্রভৃতি বলতে শোনা যায়। এসব ক্ষেত্রে শুধু প্রমিত উচ্চারণকেই বিপর্যস্ত করে না, অর্থেরও বিপর্যয় ঘটায়। তাই প্রমিত উচ্চারণের জন্য বর্ণের ধ্বনিভিত্তিক উচ্চারণ অনুশীলন করা একান্ত আবশ্যক। এতে মাতৃভাষার ঋদ্ধিকল্পে অনুরক্তিও প্রকাশিত হবে।

সহায়ক গ্রন্থ :
১. বাংলা একাডেমী, বাঙলা উচ্চারণ অভিধান, নরেন বিশ্বাস, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম               পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি, ২০০৩
২. বাংলা একাডেমী, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংস্করণ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, সপ্তদশ পুনর্মুদ্রণ,           জানুয়ারি, ২০১৪
৩. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ, ডিসেম্বর,      ১৯৮৮
4. Oxford Advanced Learner’s Dictionary, A S Hornby, Fourth Edition 1989, Oxford University Press, Great Britain

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন