সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০১৬

ভারতে মাতৃসাধনা : শ্রীমা সারদাদেবীর দিব্যসাধনা



ভারতে মাতৃসাধনা : শ্রীমা সারদাদেবীর দিব্যসাধনা
লেখক : নির্মল চন্দ্র শর্মা
ভারতের অধ্যাত্ম-সাধনায় জননীরূপ একটি  বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন এবং প্রসবান্তে কোলে তুলে স্তন্য পান করান। শিশু চোখ খোলেই মাকে পায় স্নেহ, পুষ্টি, তুষ্টি, সৌন্দর্য, পালন প্রভৃতি গুণরাশির একমাত্র আকররূপে। সাধনক্ষেত্রে সাধক তাই জগদম্বাকে দেখতে চায় এরই পরাকাষ্ঠারূপে। সাধক চায়, তার ইষ্ট কৃপাপরবশ হয়ে এবং তার সমস্ত দুর্বলতা, সর্বপ্রকার অক্ষমতা ভুলে পরিপূর্ণ স্নেহে তাঁকে কোলে তুলে নিবেন। ধ্যেয় ইষ্টমূর্তির মুখে সে এই বিচারশূন্য-স্নেহপূর্ণ হাসি দেখে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চায়।
শৈশব থেকে মায়ের মুখে সে এই উচ্চভাব দেখতে অভ্যস্ত; সাধনার ক্ষেত্রেও সে কেন এ থেকে বঞ্চিত থাকবে? অহেতুক করুণাময় গুরু শিষ্যকে উচ্চ তত্ত্বের পরিচয় ও উপদেশ দিয়ে তার মনে জাগতিক ভোগ-সুখের প্রতি বৈরাগ্যের সঞ্চার করেন। অশেষ ঐশ্বর্যময়ী সর্ব গুণালঙ্কৃতা ইষ্টদেবী জাগতিক সসীমতা ও পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে অবস্থানপূর্বক সাধকের সম্মুখে এক অনবদ্য, অতিলোভনীয় আদর্শ তুলে ধরে তার মনে তা লাভ করার জন্য অবিরাম প্রেরণা জাগাতে থাকেন। কৃপা সুমুখী, সদাহাস্যবদনা মা সন্তানের হৃদয় স্নেহে দ্রবীভূত করে তার দুঃখময় অতীত ভুলিয়ে দেন এবং প্রবল আকর্ষণে এক অনির্বচনীয় নিশ্চিন্ততাময় আনন্দ সাগরের দিকে তাকে টেনে নিয়ে চলেন। বিশেষতঃ এই পবিত্র ভাবে আবিলতার স্পর্শমাত্র নেই; আর নেই এখানে স্বার্থলেশ অথবা অর্থহীন উচ্ছ্বাস। এই সংযমের প্রতিমূর্তি ও প্রসাদময়ী মায়ের তুলনা নেই। সাধক মায়ের অঞ্চল ধরে, মাতৃক্রোড়ে নির্ভয়ে বসে সংসারকান্তার অতিক্রম করতে পারে। তা ছাড়া মাতৃজাতির প্রগতির পথেও ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এক জটিল সমস্যা উপস্থিত হয়েছিল। ইংরেজ-বিজিত ভারত তখন পাশ্চাত্যের ভাবধারায় প্লাবিত। প্রতীচ্যের বিদ্যা, বুদ্ধি, শক্তি ও সম্পদের দুর্নিবার মোহে পরাধীন ভারত তখন ইউরোপীয় ভাবগুলোকে গ্রহণ করতে লালায়িত। ভোগলোলুপ ও ইহলোকসর্বস্ব মানব সমাজকে উচ্চতর অনুভূতিরাজ্যে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শ্রীভগবতীর এই যুগে মাতৃমূর্তিতে অবতীর্ণ হওয়া একান্ত আবশ্যক ছিল।
হিন্দু ধর্মমতে শক্তি ব্রহ্মেরই প্রকাশ এবং তাঁকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক করা যায় না। ব্যাপারটি আগুন এবং তার দাহিকা শক্তির মতো। শক্তি নিজে কাজ করতে অক্ষম। সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম, তাঁর সান্নিধ্য দ্বারা শক্তিকে ক্রিয়াশীল করেন। এর নাম- রূপের উৎপত্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমা সারদাদেবীর স্বরূপ জানতেন। তিনি তাঁকে জ্ঞানদায়িনী এবং তাঁর শক্তি বলেছেন। সেজন্য সারদাদেবীকে পরমেশ্বরী বা মহাশক্তি এবং ঐশী শক্তির বিশেষ প্রকাশ বলে গণ্য করা হয়। একবার জনৈক ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর পরে কেউ আর হিন্দুধর্মের ছোটখাট দেবীদের পূজা করবেন না। উত্তরে শ্রীমা বলেছিলেন, “কেন, তাঁরা তো আমারই অংশ”। নিজের ঐশী সত্তা সম্পর্কে সচেতন থেকেই শ্রীমা তাঁর শিষ্যদের ভিতর আধ্যাত্মিকতার স্ফূলিঙ্গ জ্বেলেছিলেন, তাঁদের পূজা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁদের মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন।
শ্রীমায়ের জীবনের এই মর্মার্থ শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ অবগত ছিলেন এবং শ্রীমাকেও তিনি তা বলে গিয়েছিলেন। উত্তরকালে জনৈক উৎসুক ভক্ত একদিন শ্রীমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মা, অন্যান্য অবতারগণ নিজ নিজ শক্তির পরে দেহরক্ষা করেছেন; কিন্তু এবার আপনাকে রেখে ঠাকুর পূর্বে চলে গেলেন কেন?” তদুত্তরে শ্রীমা বললেন, “বাবা, জানো তো, ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন”।
পুরাণাদি-মুখে কথিত অবতারতত্ত্ব যেখানে আলোচিত হয়েছে, সেখানে দেখা যায় যে, অবতার জন্মগ্রহণ করেন যুগের প্রয়োজনে, যুগধর্ম প্রচারের জন্য এবং আপনি আচরি ধর্ম জীবকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। স্বয়ং শ্রীভগবান যখন অবতীর্ণ হন, তখন তাঁর সঙ্গে তাঁরই দ্বিতীয় স্বরূপ হিসেবে তাঁর অবতারলীলা সহচরী আবির্ভূত হন। এই লীলা সহচরী এমন এক নারী, যিনি আপন জীবনে অবতার প্রচারিত ধর্ম সাধিত করে নারীজাতি তথা মানবজাতির সম্মুখে একটি আদর্শ রেখে যান। তাইতো জগতে মাতৃভাব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘অবতারবরিষ্ঠ’ শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাসঙ্গিনীরূপে ঊনবিংশ শতকে দেবী সারদামণির প্রকাশ।
ভগবান শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা যা আচরণ করে থাকেন, অপর সাধারণেও তা-ই করে থাকে’। (৩/২১)  আবার বলেছেন, ‘হে পার্থ, আমি যদি অনলস ভাবে কর্মানুষ্ঠান না করি তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমার পথই অনুসরণ করবে। (৩/২৩) তাই জ্ঞানী ব্যক্তিগণ কর্মে আসক্ত না হয়ে লোকশিক্ষার জন্য সেইভাবেই কর্ম করে থাকেন’ (৩/২৫) তাই তো দেখা যায়- ব্রহ্মরূপিনী পরমা আদ্যাশক্তি শ্রীমা সারদাদেবী দেহ ধারণ করে আজীবন নীরবে দিব্য সাধনায় মগ্ন হন।
শৈশবে মা-বাবা ও ছোটভাইদের সেবার মধ্যদিয়েই শুরু হয় তাঁর সাধনা। নগণ্য একটি গ্রামের দরিদ্র মাতা-পিতার গৃহে তাঁর জন্ম। শৈশবেই কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে পরিচয়। নানাভাবে দরিদ্র মাতা-পিতার পরিশ্রম লাঘবের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি হাসিমুখে দরিদ্র মাতা-পিতাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করেন, ছোট ছোট ভাইদের স্নেহে লালন করেন, কখনও ক্ষুধার্ত গরুর হাম্বারব শুনে পুকুরে নেমে দলঘাস কাটেন, কখনও ক্ষেতে মজুরদের জন্য মুড়ি-গুড় দিতে ছুটে চলেন। আবার দুর্ভিক্ষের সময় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বসে থাকেন ক্ষুধার্তের পাশে। ছোট হাতপাখা নিয়ে ক্ষুধার্তের অন্ন ঠাণ্ডা করেন। সব কাজেই তিনি তৎপর। কোন প্রতিকূল অবস্থাই তাঁর কাছে অজেয় নয়। তাঁর এই নিরলস নিরভিমান সেবাতেই বুঝি পরবর্তীকালের শ্রীরামকৃষ্ণ-সংঘের সূচনা।
শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত পাঁচ বছর বয়সে শ্রীমা সারদামণির শুভ পরিণয় হয়। মূলতঃ এ সময় থেকেই শ্রীশ্রী মায়ের দিব্যসাধনার সূচনা। বিয়ের পর তিনি পিত্রালয় (জয়রামবাটী) ও শ্বশুরালয় (কামারপুকুর) উভয় স্থানেই দিন যাপন করেন। তবে, শ্রীশ্রীঠাকুর কামারপুকুরে এলে শ্রীমা অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রায়ই শ্রীমা সারদা ও তাঁর সঙ্গিনীদের কাছে তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যাপার নিয়ে আর নিজস্ব অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতেন। কখনও কখনও অল্প বয়স্কা বধূ ক্লান্ত হয়ে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তেন। তখন তাঁর সঙ্গিনীরা তাঁকে জাগিয়ে দিয়ে বলতেন, “তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে; অমূল্য কথাগুলি শুনতে পেলে না”। তাতে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “ওকে জাগিও না। ও যদি আমি যা বলি সব শোনে, তা’হলে সে আর এ জগতে থাকবে না; ডানা মেলে উড়ে যাবে”।
শ্রীশ্রীমায়ের স্বরূপ সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের সুস্পষ্ট ধারণা এবং এত সচেতনতা দেখা গেলেও এবারে তাঁর মধ্যে তাৎপর্যময় ভাব লক্ষ্য করা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুরে এসেছেন। একাধারে গৃহী ও সন্ন্যাসী। শ্রীমা এখন তের-চৌদ্দ বছরের কিশোরী। শ্রীমাকে তিনি নানাভাবে শিক্ষা দিতে অগ্রসর হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে মা সারদার প্রত্যক্ষ শিক্ষার এই শুরু। যেমন গুরু, তেমন শিষ্যা। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন শ্রীমাকে আদর্শ জীবনসঙ্গিনী করে গড়ে তুলতে আগ্রহী, শ্রীমা সারদাও তেমনই দেবকল্প রামকৃষ্ণের যোগ্যা লীলাসঙ্গিনী হতে উন্মুখ। শ্রীরামকৃষ্ণ কিশোরীর হৃদয় ভালবাসার দ্বারা জয় করে নিয়েছেন। এখন নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করতে ব্যস্ত। একদিকে সাংসারিক বিষয়, অপরদিকে ভজন, কীর্তন, ধ্যান, সমাধি, ঈশ্বরতত্ত্ব প্রভৃতির শিক্ষা। শিক্ষাদানে রামকৃষ্ণ অনলস, সারদাও শিক্ষাগ্রহণে অনন্যমনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ শেখাচ্ছেন, জীবনের আদর্শ ত্যাগ। শেখাচ্ছেন- পবিত্র, সুন্দর চরিত্র কিভাবে গঠন করতে হয়, শেখাচ্ছেন দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজ, শেখাচ্ছেন সমস্ত কর্তব্য সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গেই কিভাবে ঈশ্বর-আরাধনায় নিমগ্ন থাকা যায়, শেখাচ্ছেন গুরুজন ও স্নেহভাজনদের প্রতি আচরণ, শেখাচ্ছেন সেবাপরায়নতা। “যখন যেমন, তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন” –এই নীতিকে ভিত্তি করে শিক্ষা দিচ্ছেন লোক ব্যবহার। এমনকি, প্রদীপের সলতেটি কেমন করে রাখতে হয়, তা পর্যন্ত শিক্ষাসূচি থেকে বাদ যায় নি। শ্রীরামকৃষ্ণের এই শিক্ষা পল্লীবালাকে আনন্দে বিভোর করে রেখেছিল। তা তিনি পরে স্বয়ং স্ত্রীভক্তদের নিকট প্রকাশ করেছেন-“হৃদয়মধ্যে আনন্দের পূর্ণঘট যেন স্থাপিত রহিয়াছে, ঐ কাল হইতে সর্বদা এইরূপ অনুভব করিতাম। সেই ধীর, স্থির, দিব্য উল্লাসে অন্তর কতদূর কিরূপ পূর্ণ থাকিত, তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে”।  অন্তরের এই উল্লাস শ্রীমাকে প্রগল্ভা করে নি। তিনি এখন আরও শান্ত, আরও সংযত, আরও কর্তব্যনিষ্ঠ, আরও আত্মমগ্ন। হৃদয়ে তাঁর ‘আনন্দের পূর্ণঘট’ সদা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ফিরে এলেন জয়রামবাটীতে- পিতৃগৃহে। দারিদ্র্য, গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশ, অনুদার সমাজ ও বিগত যুগের আবিলতাময় নানা সংস্কারএসবের মধ্যে থেকেও পরিস্ফূট হতে থাকে তাঁর অসামান্য নিরাসক্তি, অভিমানশূন্যতা আর দোষদৃষ্টিরাহিত্যতাঁর ‘ক্ষমারূপ তপস্যা’-র রূপ। পল্লীর কেউ তাঁর কাছে মন্দ নয়। যে তাঁকে কষ্ট দেয়, সে-ও নয়। অপরের দোষ না দেখার এই কৌশলটি শিশুকাল থেকেই আয়ত্ব করে নিয়েছিলেন বলে সকল পরিস্থিতিতে সকলের অপরাধ তিনি ক্ষমা করে নিতে পারতেন। পিতৃগৃহের সাধারণ সংসারে শ্রীমা সারদা কর্তব্য-দায়িত্ব পালন করেছেন নীরবে, অথচ তাঁর মধ্যে প্রকাশিত মনের অদ্ভূত অনাসক্তি। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনাসক্তি। এই অনাসক্তির জন্যেই তাঁর মধ্যে ক্ষমারূপ তপস্যার পরিপূর্ণ প্রকাশ। কিন্তু সর্বোপরি আশ্চর্য নীরবতা। কেউ জানে না, চেনে না শ্রীমা সারদাকে। তাঁর ক্রমবিকাশ সকলের দৃষ্টির অন্তরালে। কেউ লক্ষ্য করে নাশ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যের পরসারদার কাজকর্ম, চলাফেরা, আচরণের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এ এক নতুন সারদা। তবু এ শুধু প্রস্তুতি।
দীর্ঘ চার বছর অতিবাহিত হলো। গ্রামে খবর এসে পৌঁছুল যে, দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এ ব্যাপারে শ্রীমা সারদা খুবই উদ্বিগ্না হলেন। তাঁর মনে হলো, সত্যিই যদি শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁর এসময় সেবা করার জন্য স্বামীর কাছে থাকা উচিত। এমন সময় দক্ষিণেশ্বর যাবার সুযোগও এসে গেল। গ্রামের কয়েকজন  সে সময় গঙ্গায় পুণ্য স্নানের জন্য কলকাতায় যাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে  শ্রীমা সারদার যাবার অভিপ্রায় জানতে পেরে পিতা রামচন্দ্র তাঁকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ষাট মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাত্রা করার তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে রাত ৯টায় দক্ষিণেশ্বরে এসে উপস্থিত হন। দূর পথ হাঁটায় অনভ্যস্তা শ্রীমা দ্বিতীয় দিনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও ছুটে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরেহৃদয়ের টানে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে স্নেহ এবং আদরের সঙ্গেই গ্রহণ করলেন এবং পরের দিনই তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। আসার সময় শ্রীমা যে মানসিক উৎকণ্ঠা নিয়ে এসেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের সদয় ব্যবহারে তা দূরীভূত হলো। সাধকশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ তাঁর সহধর্মিণী সারদাকে পরম সমাদরে তাঁর ঘরে স্থান দিলেন। শুরু হলো শ্রীমায়ের দিব্যসাধনার আর এক অধ্যায়।
দক্ষিণেশ্বরে শ্রীমা সারদার তপস্যা আরও কঠোর ও মহিমামণ্ডিত। এখানেই তাঁর ত্যাগ ও সেবার পূর্ণ পরিণতি। সকলের অলক্ষ্যে নীরবে, নিভৃতে তাঁর চৌদ্দ বছরের কঠোর তপস্যার কাহিনী স্বল্পজ্ঞাত, প্রায় অলিখিত। নিরন্তর প্রয়াসে নিজের আচরণ, ত্যাগোজ্জ্বল জীবন চর্যার সমস্ত গৌরবকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির সকল কিছুই যার নখদর্পণে সেই খাজাঞ্চীর উক্তি : ‘তিনি আছেন শুনেছি, কিন্তু কখনও দেখতে পাইনি”। শ্রীমা নিজেও বলেছেন, ‘এত বছর ছিলুম, একদিনও কারও সামনে পড়িনি’। এই আত্মবিলুপ্তি তপস্যার শ্রেষ্ঠ ফলশ্রুতি। সেবার আড়ালে এই আত্মবিলুপ্তি অধ্যাত্মসাধনার ইতিহাসে বিরল।
প্রথমবারে দক্ষিণেশ্বরে আসার পর শ্রীশ্রীমায়ের অধিকাংশ সময় শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরেই কাটত। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার উপর আমার কিছু কর্তব্য আছে। কি গো, তুমি কি আমায় সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ?” লক্ষ্যে স্থিত, সরলা পল্লীবালার সপ্রতিভ উত্তর : “না, আমি তোমাকে সংসার পথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথে সাহায্য করতেই এসেছি।” এ তপস্বিনী সারদারই যোগ্য উত্তর। সত্য বলতে কি, শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ব্রহ্মোপলব্ধির দৃঢ়তা পরীক্ষার জন্য শ্রীমাকে আট মাস একই শয্যায় শয়ন করতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের উভয়ের মন আধ্যাত্মিক আনন্দে এতই পূর্ণ হয়ে থাকত যে, তাঁদের মনে পার্থিব উপভোগস্পৃহা কখনও জাগেনি। প্রতিরাতে শ্রীরামকৃষ্ণের গভীর সমাধিস্থরূপ প্রত্যক্ষ করে শ্রীমা মাঝে মাঝে ভীত হয়ে পড়তেন। ভয়ে ভয়ে ভাবতেন কখন রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটে উঠবে। আবার কখনও তিনি নিজেই ভগবানের নাম শুনিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রকৃতিস্থ করতে সক্ষম হতেন। এভাবেই সাধক রামকৃষ্ণের অভূতপূর্ব সাধনযজ্ঞের তিনি ছিলেন নেপথ্য-সহায়িকা। এই আত্ম পরীক্ষার পর শ্রীরামকৃষ্ণকেও স্বীকার করতে হলো : ‘ও (সারদা) যদি এত ভাল না হতো, আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমণ করত, তা হলে (আমার) সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে দেহবুদ্ধি আসত কি-না কে বলতে পারে?” প্রশ্ন হতে পারে কোন্ দুশ্চর সাধন বলে তিনি আত্মসংযমের এই শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হতে পেরেছিলেন? শ্রীমা সারদার পূর্বোক্ত একটিমাত্র কথাতেই তাঁর এই তপশ্চর্যা এবং তপঃসিদ্ধির কথা ঘোষিত : ‘তোমার ইষ্টপথে সাহায্য করতেই এসেছি”। ব্রতধারিণীর এই আত্মত্যাগের তুলনা মেলে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ ব্রতধারিণী সারদার পবিত্রতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁর আধ্যাত্মিকতা পূর্ণভাবে জাগরিত করার জন্য উৎসুক হলেন। ফলহারিণী কালীপূজার রাত। কালীমন্দিরে যখন সকলে পূজায় ব্যস্ত, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নিজের ঘরে  ষোড়শীপূজার আয়োজন করলেন। রাত তখন নয়টা। তিনি শ্রীমা সারদাকে ডেকে পাঠালেন। শ্রীমা এলে তিনি ইঙ্গিতে তাঁকে দেবীর জন্য নির্দিষ্ট পিঁড়িতে বসতে বললেন। তারপর তিনি ষোড়শী (জগজ্জননীর  ষোড়শ বর্ষীয়া কুমারীরূপ) পূজার মন্ত্রোচ্চারণসহ পুষ্প, নৈবেদ্য দ্বারা তাঁকে পূজা করতে আরম্ভ করলেন। পূজার শেষ পর্যায়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমা সারদা উভয়ই বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। পূজা শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবীরূপী সারদার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিবেদন করলেন এবং তাঁর পদতলে নিজেকে ও তাঁর জপমালা প্রভৃতি সর্বস্ব বিসর্জন করলেন। এভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের দীর্ঘ সাধনকাল সমাপ্ত হলো। জাগরিত হলো শ্রীমা সারদার মাতৃভাব আর
রচিত হলো দুশ্চর তপশ্চর্যার এক বিস্ময়কর অধ্যায়একমাত্র সাক্ষী দক্ষিণেশ্বরের নহবতের এক তলার ছোট ঘরটি। এই ঘরটিতে কাটে তাঁর জীবনের চৌদ্দ বছর।
পঞ্চাশ বর্গফুটেরও কম ছোট্ট ঘরখানি দরমা দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই দৈনন্দিন প্রয়োজনের যাবতীয় জিনিসপত্র। তারই মধ্যে রান্না, খাওয়া, থাকা সব। শ্রীশ্রীঠাকুরের দুই-তিনজন স্ত্রীভক্ত প্রায়ই তাঁর সঙ্গে একই সঙ্গে রাত কাটাতেন। দোতলার ঘরে আছেন শাশুড়ী।  প্রতিদিনের রান্নাই অনেকঠাকুরের জন্য, ভক্তদের জন্য, আলাদা আলাদা; আবার এক এক জনের জন্য এক এক রকমের রান্না। যে কোন সময় যে কোন রান্নার ফরমাস আসে। তিন-চার সের ময়দার রুটি হয়। এ- সব কিছুর ওপর আছে শাশুড়ীর সেবা। শ্রীমা সারদা অবিচল ধরিত্রীর মতো নিঃশব্দে, সানন্দে ও সযত্নে সব কাজ সম্পন্ন করেন। এভাবে তাঁর অলৌকিক শ্রমে শ্রীরামকৃষ্ণের জগৎ সচল থাকে। কিন্তু শ্রীমা সারদার অস্তিত্ব থাকে সবার অগোচর। শ্রীশ্রীমায়ের নিজের কথায় এই সময়কার সুন্দর ছবি পাওয়া যায় : ‘রাত চারটেয় নাইতুম। দিনের বেলায় বৈকালে সিঁড়িতে একটু রোদ পড়ত, তাইতে চুল শুকাতাম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল। নীচের একটুখানি ঘর, তা আবার জিনিসপত্রে ভরা। উপরে সব শিকে ঝুলছে। রাত্রে শুয়েছি, মাথার উপর হাঁড়ি কলকল করছেঠাকুরের জন্য শিঙ্গি মাছের ঝোল হতো কি-না! তবু আর কোন কষ্ট জানিনি, কেবল যা শৌচে যাবার কষ্ট। দিনের বেলায় দরকার হলে রাত্রে যেতে পারতুমগঙ্গার ধারে, অন্ধকারে। কেবল বলতুম “হরি হরি, একবার শৌচে যেতে পারতুম!” ‘শৌচের জন্য আর নাওয়ার জন্য যত কষ্ট হতো’। কিন্তু এত কৃচ্ছ্রসাধনসত্ত্বেও শ্রীমার প্রাণে আনন্দের অভাব নেই, অশান্তি কি জিনিস তা তিনি জানেন না। তাই আবার তাঁর কথা শুনি : ‘চটের উপর পটপটে মাদুর পাততুম আর সেই ফেঁসোর বালিশ মাথায় দিতুম। তখনও তাইতে শুয়ে যে ঘুম হতো, এখন এই সবে (খাট বিছানায়) শুয়েও তেমনি ঘুমোইকোন তফাৎ বোধ হয় না’।১০ দৈনন্দিন এত কাজকর্ম, এত অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যহ রাত তিনটায় শয্যাত্যাগ শেষে শ্রীমা পশ্চিম ধারের বারান্দায় বসে ধ্যান করতেন। এ বিষয়ে কোন ব্যতিক্রম হতো না। ধ্যানাভ্যাসের ফলে শ্রীমা সারদার স্বভাবতঃ অন্তমুর্খীন মন সেই প্রথম অবস্থাতেই একেবারে তন্ময় হয়ে যেত। একদিন তিনি কথা প্রসঙ্গে নলিনীদিদিকে বলেছিলেন, “আমি তোদের বয়সে কত কাজ করেছি। এ সব করেও রোজ এক লক্ষ জপ করতুম।”১১ এই ধ্যান জপের সঙ্গে তাঁর মনে অবিরাম প্রার্থনাও চলত। তিনি সজল নয়নে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করতেন, ‘চন্দ্রেও কলঙ্ক আছে- আমার মনে যেন কোন দাগ না থাকে’। ‘তোমার ঐ জোছনার মতো আমার অন্তর নির্মল করে দাও’।১২ এ প্রসঙ্গে তাঁর এ উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য : “খাটতে হয়, না খাটলে কি কিছু হয়? সংসার কাজকর্মের মধ্যেও একটি সময় করে নিতে হয়। আমার কথা কি বলব, মা, আমি তখন দক্ষিণেশ্বরে রাত তিনটের সময় উঠে জপে বসতুম- কোন হুঁশ থাকত না”।১৩
দিনে যিনি সেবিকা, রাতের গভীরে তিনিই ইষ্ট-আরাধনায় মগ্ন তপস্বিনী। কখনও ধ্যানে তন্ময়- সমাধিস্থা। তারপরও তাঁর মনের আকুতি মেটে না, তাঁর অভিলাষ জ্ঞাপনার্থে যোগীন-মাকে বলেন, “ওঁকে (শ্রীরামকৃষ্ণ) বলো, যাতে আমার একটু ভাব-টাব হয়; লোকজনের জন্য ওঁকে একথা বলবার আমার সুযোগ হয়ে উঠছে না”।১৪ একহাত সেবায় সদাব্যস্ত, অপরহাতে জ্বালিয়ে রাখেন অন্তরের পূজার প্রদীপ। একসঙ্গে  একহাতে পূজা, অপরহাতে সেবার অপূর্ব সমন্বয়দেহ কর্মে, মন ঈশ্বর চিন্তায়। এই আদর্শই পরে শ্রীরামকৃষ্ণ-সংঘের আদর্শ হিসেবে রূপ নেয়।
লোকশিক্ষার জন্য সাধারণ ব্রত উপবাসও শ্রীমা সারদা করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ অসুখের সময় তাঁর নিরাময় কামনায় তারকেশ্বরে গিয়ে শিবমন্দিরে হত্যা দিয়েছিলেন। দু’দিন নিরম্বু উপবাস করে মন্দিরের চাতালে পড়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পরে প্রাণের বিরহজ্বালা প্রশমিত করতে শ্রীমা পঞ্চতপা ব্রত করেছিলেন। পাঁচ হাত অন্তর চারদিকে চারটি অগ্নিকুণ্ড। দাউ দাউ জ্বলছে। মাথার উপর গ্রীষ্মকালের মার্তণ্ড! ভয়াবহ দৃশ্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এর মধ্যস্থলে বসে নিরন্তর ভগবানের নাম জপ; এভাবে পর পর সাতদিন করে ব্রত সমাপ্ত। আগুনে শরীর ঝলসে গেল, গায়ের রঙ পুড়ে কালো হলো। এ তপস্যাতেও তাঁর কোন অহংকার নেই। তপস্যার অহংকার- ত্যাগও তপস্যা। শ্রীমা এই তপস্যাতেও সিদ্ধা। পরবর্তীকালে তাঁর কাছে এই ব্রতের প্রসঙ্গ তুললে তিনি সেই নিদারুণ কৃচ্ছ্রসাধনকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে অতি সাধারণভাবেই বলতেন : ‘পঞ্চতপা-টপা এসব মেয়েলীযেমন ব্রত সব করে না?’১৫ শ্রীমা সারদার নিজের আধ্যাত্মিক পূর্ণতার জন্য এর কোন প্রয়োজন ছিল না। তবুও যে তিনি এই কঠোর ব্রতটি পালন করেছেন, তার সম্বন্ধে নিজেই পরবর্তীকালে বলেছেন : “তপস্যা দরকার। ......... পার্বতীও শিবের জন্য করেছিলেন। ........ এসব করা লোকের জন্য। নইলে লোকে বলবে, ‘কই, সাধারণের মতো খায় দায়, আছে”।১৬ এভাবে প্রচলিত প্রথায় তপস্যার জীবন দেখাবার জন্য আজন্ম তপস্বিনী শ্রীমা সারদা আনুষ্ঠানিকভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের তপস্যাও করলেন। জগৎ দেখল তিনি লোকপ্রচলিত রীতি, প্রথা ও সংস্কারকে উপেক্ষা করছেন না। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো তিনিও কোন কিছু ভাঙতে আসেন নি, সবকিছু মেনে নিয়ে, সব কিছুর মধ্যে তিনি সামঞ্জস্য স্থাপন করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবন-ভাষ্য-স্বরূপিনী শ্রীমা লোকচক্ষুর অন্তরালে, এই সমাজ সংসারের গার্হস্থ্য পরিবেশেই যে আদর্শ আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা মানব সমাজের সুস্থ ও পবিত্র জীবনযাত্রার একমাত্র পথ নির্দেশ। বিশ্বে মাতৃভাব প্রকাশের জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনসঙ্গিনীরূপে তাঁর লীলা। মাতৃভাবের মধ্যেই সকল পবিত্র এবং কল্যাণকর ভাবের প্রকাশ। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, ‘মাতৃভাব সাধনার শেষ কথা’।১৭ তাই শ্রীমা-র জীবনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। এ-ও এক নতুন তপস্যা। যিনি এতদিন অন্তরালে আত্মগোপন করেছিলেন এবারে তিনি জননী হয়ে সন্তানদের কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন, তাদের জাগতিক পারত্রিক সমস্ত ভার গ্রহণ করলেন। এ তপস্যা সন্তানদের জন্য তপস্যা। ত্যাগী সন্তানদের মঙ্গল কামনায় অহরহ তাঁর প্রার্থনা- যাতে তাঁদের মাথা গোঁজবার একটা ঠাঁই হয়, যেখানে তাঁরা প্রেমসূত্রে আবদ্ধ থাকবেন আর সংসার তপ্ত মানুষ তাঁদের সংস্পর্শে এসে শীতল হবে। শ্রীমা সারদার সেই প্রার্থনার ফলে গড়ে ওঠে নবযুগের ধর্মসংঘশ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ। ত্যাগের সাধনা, সেবার সাধনা, ক্ষমার সাধনা আর নিয়ম-নিষ্ঠার প্রতি লক্ষ্য স্থির রেখে সংঘটি যাতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেসে দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি। সংঘজননীরূপে সকল সন্তানের মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাধনা চলে অব্যাহত। কিন্তু তিনি তো শুধু সংঘজননীই নন, মুষ্টিমেয় ত্যাগী-সন্তান যাঁরা তাঁর ভাষায় ‘দেবশিশু’, দেবের আরাধ্য ধন,’ তাঁদেরই তো জননী নন শুধু; যারা ত্যাগ করতে পারে নি বা ত্যাগ করতে শেখে নি, তাদেরও তিনি জননী। ‘অবতার বরিষ্ঠ’ শ্রীরামকৃষ্ণকেও যিনি সন্তানরূপে দেখেছেন।  সন্তানের সুখের জন্য, পরিতৃপ্তির জন্য যে কোন শারীরিক কষ্ট তাঁর কাছে তুচ্ছ। লোক দেখানো নয়, স্বার্থ কলঙ্কিত নয়, নীরব স্নেহস্নিগ্ধ সেবা। কেবল লোককল্যাণের সেবা। তাই বিশ্বজননী হয়ে তিনি সব শরণাগতের ভার গ্রহণ করেছেন; গুরুরূপে সকল সন্তানের সেবা করে চলেছেন। সন্তানের কল্যাণে, সন্তানের তৃপ্তিতে তাঁর তৃপ্তি। জাতি-ধর্ম-পাপী-পুণ্যবান নির্বিশেষে মানুষকে তিনি তাঁর স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় দিচ্ছেন। সকল সেবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেবা জীবকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান। শ্রীশ্রীমা দীর্ঘ প্রায় চৌত্রিশ বছর এই সেবাময় তপস্যায় নিজেকে তিলে তিলে উৎসর্গ করেছেন। সন্তানরা জন্মজন্মান্তরের পাপ ঢেলে দেয় ‘পরিত্রতাস্বরূপিণী’র পায়ে। পা জ্বলে পুড়ে যায়, কখনও বা ‘মনে হয় যেন বোলতায় কামড় দিলে’।১৮ তবুও করছেন, করেই চলেছেন সেবারূপ তপস্যা। এ তপস্যার বিরাম নেই, ফাঁক নেই। কারণ তিনি যে মা, জন্মজন্মান্তরের মা, ‘সত্যিকারের মা- গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়- সত্যিকারের মা”।১৯
শ্রীরামকৃষ্ণ কঠিন সাধনান্তে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যে মাতৃদর্শন করেছিলেন পরবর্তীকালে তিনি জগৎকে বাস্তবে সেই মাতৃদর্শন করালেন। ‘দেবী এখানে সাক্ষাৎ, সচলা, রক্তমাংসের দেহবিশিষ্টা-শ্রীরামকৃষ্ণ পূজিতা, ঁভবতারিণী ও স্বীয় গর্ভধারিণীর সহিত অভিন্না-শ্রীমা’।২০ যিনি তিন দেহেই ভক্ত সন্তানদের সেবা করে চলেছেন; তাঁর স্থূলদেহে, সূক্ষ্ম দেহে এবং কারণদেহে। তাঁর দিব্যসাধনার অনির্বাণ জ্যোতি হোক আমাদের জীবনের চির-পথনির্দেশক।
তথ্যসূত্র
১। শ্রীমা সারদাদেবী, আলোকচিত্রে জীবন কথা। কলকাতা : আশ্বিন, ১৩৯৭। পৃ : ৯০
২। শ্রীমা সারদাদেবীস্বামী গম্ভীরানন্দ, কলকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০৯। পৃ : ৯৫-৯৬
৩। শ্রীমা সারদাদেবী, আলোকচিত্রে জীবন কথা। কলকাতা : আশ্বিন, ১৩৯৭। পৃ : ১৫
৪। শ্রীমা সারদাদেবীস্বামী গম্ভীরানন্দ, কলকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০৯। পৃ : ২৮
৫। শ্রীশ্রীমায়ের কথা (অখণ্ড), দ্বিতীয় ভাগ। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০১। পৃ : ১৯৩
৬। ঐ, প্রথম ভাগ, পৃ : ৬৪
৭। শ্রীমা সারদাদেবীস্বামী গম্ভীরানন্দ, কলকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০৯। পৃ : ৩৮
৮। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গস্বামী সারদানন্দ, প্রথমভাগ। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, শ্রাবণ ১৪০০। পৃ : ২০৭
৯। শ্রীশ্রীমায়ের কথা (অখণ্ড), দ্বিতীয় ভাগ। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০১। পৃ : ১৯৩
১০। ঐ, প্রথম ভাগ, পৃ : ৬৪
১১। শ্রীমা সারদাদেবীস্বামী গম্ভীরানন্দ, কলকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০৯। পৃ : ৮৮
১২। ঐ, পৃ : ৮৮-৮৯
১৩। ঐ, পৃ : ৮৮
১৪। ঐ, পৃ : ৮৯
১৫। ঐ, পৃ : ১৩৬
১৬। ঐ, পৃ : ১৩৬
১৭। ঐ, পৃ : ৯৫
১৮। শ্রীশ্রীমায়ের কথা (অখণ্ড), প্রথম ভাগ। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০১। পৃ : ৮৮
১৯। শ্রীমা সারদাদেবী, আলোকচিত্রে জীবন কথা। কলকাতা : আশ্বিন, ১৩৯৭। পৃ : ৯৮
২০। ঐ, পৃ : ৯৪

সহায়ক গ্রন্থাবলি
১. গম্ভীরানন্দ, স্বামী; শ্রীমা সারদাদেবী। কলকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০৯।
২. শ্রীমা সারদাদেবী, আলোকচিত্রে জীবন কথা। কলকাতা : আশ্বিন, ১৩৯৭।
৩. শ্রীশ্রীমায়ের কথা (অখণ্ড)। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, মাঘ, ১৪০১।
৪. সারদানন্দ, স্বামী; শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথমভাগ। কলিকাতা : উদ্বোধন কার্যালয়, শ্রাবণ ১৪০০।
৫. শতরূপে সারদা। কলকাতা : রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্ক, আগস্ট, ১৯৯৩।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন