জহি শত্রুং
মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ ।। গীতা ৩।৪৩
-নির্মল চন্দ্র শর্মা
এবম্ = এই প্রকারে বুদ্ধেঃ = বুদ্ধি থেকে পরম্ = পর অর্থাৎ সূক্ষ্ম, বলশালী ও শ্রষ্ঠ স্বীয় আত্মাকে বুদ্ধ্বা = স্বীকার করে, আত্মনা
= বুদ্ধির দ্বারা আত্মানম্ = মনকে সংস্তভ্য = বশ
করে, মহাবাহো = হে মহাবাহো! দুরাসদম্ = দুর্জয় কামরূপম্ = কামরূপ শত্রুম্
= শত্রুকে জহি = তুমি বিনাশ
কর ।। গীতা ৩।৪৩
এই শ্লোকটিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়-
এটি কোন প্রশ্নের প্রক্ষিতে উপস্থাপিত জবাবের উপসংহার। চুম্বক কথায়- শ্লোকটিতে
রয়েছে, কামরূপ শত্রু বিনাশের উপায় ও আদেশ। সুতরাং শ্লোকটির তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে
হলে এর প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা আবশ্যক।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে
বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তন্মধ্যে একটি- “লোকে কার দ্বারা প্রয়ুক্ত হয়ে অনিচ্ছা
সত্ত্বেও যেন কিছুটা বলপূর্বক নিযুক্ত হয়ে পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়”?১ জিজ্ঞাসামূলক প্রশ্ন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের
প্রয়োজন নেই- সরাসরি জবাব দেয়া যায়। ভগবানও অন্যথা করেননি, জবাব দিয়েছেন- “ইহা
কাম, ইহা ক্রোধ রজোগুণ থেকে ইহার উৎপত্তি”।২ অর্থাৎ প্রকৃতির রজোগুণজাত কাম, ক্রোধ বশেই
মানুষ পাপ করে। কাম অর্থ- কামনা, বিষয় বাসনা, সাংসারিক যে কোনরূপ ভোগ বাসনা। কাম
প্রতিহত হলেই ক্রোধে পরিণত হয়। কেউ আমাদের ইচ্ছার বিরূদ্ধে কাজ করলেই আমাদের ক্রোধ
জন্মে। কাম অনলের ন্যায় দুষ্পূরণীয়, এর কিছুতেই তৃপ্তি নেই। উপভোগে কখনও এর
নিবৃত্তি হয় না।৩ যেমন আগুনে
ঘি ও ইন্দন দিলে আগুন বেড়েই যায়, তেমনই মানুষ যেমন যেমন ভোগ উপভোগে রত হয় তার
ভোগতৃষ্ণা তেমন তেমনই বাড়তে থাকে। শ্রীমদ্ভাগবতে দেখা যায় যে, রাজা যযাতি অনেক
ভোগ্যবস্তু অনেক কাল ধরে ভোগ করার পর শেষ কালে বললেন, “বিষয়গুলোর উপভোগ দ্বারা
‘কাম’ কখনও শান্ত হয় না; বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে অগ্নি যেমন বর্ধিত হয়ে যায়,
তেমনই কামও বর্ধিত হতে থাকে”।৪ কাম সাধকদের অন্তঃকরণে বিবেক, বৈরাগ্য ও
নিষ্কাম ভাবকে স্থির হতে দেয় না। তাদের সাধনায় নানা বাধা, বিপত্তি উপস্থিত করতে
থাকে। সেজন্য মানুষের কখনও মনে করা উচিত নয় যে, ভোগের প্রলোভন দেখিয়ে কামকে সাম ও
দান নীতির সাহায্যে জয় করে নিব। এটি অতিশয় উগ্র, সংসারে বা মোক্ষপথে এটি দুর্জয়
শত্রু।৫ এই দুর্জয় শত্রু কামকে
ত্যাগ করার জন্য গীতায় স্থানে স্থানে বলা হয়েছে,৬ ষোড়শ অধ্যায়ে আবার একে নরকে গমনের দ্বার বলা
হয়েছে,৭ এটি সাংসারিক বিষয়- ভোগ কামনা। ভগবানের সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা,
তাঁর ভজন-ধ্যান করার অথবা সাত্ত্বিক কর্মের অনুষ্ঠান করার যে শুভ ইচ্ছা, তাকে কাম
বলে না; তা মানুষের কল্যাণের হেতু এবং তা হলো এই বিষয় ভোগরূপ কামের বিনাশী। আমাদের
আলোচ্য শ্লোকে শ্রীভগবান তার প্রিয় ভক্ত মহাবাহো অর্জুনকে এই দুর্জয় কামরূপ শত্রু
বিনাশের উপায় ও আদেশ করেছেন। সমগ্র মানব জাতির প্রতিনিধি হিসেবে অর্জুন তা গ্রহণ
করেছেন। কামনা বা বাসনা মানুষের জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে কীভাবে মনুষ্য জীবনরূপ অমূল্য
সম্পদকে ব্যর্থ করে দেয় এক্ষেত্রে সে সম্পর্কেও শ্রীভগবান বর্ণনা করেছেন।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য-
ষড়রিপু; মানুষের ছ’টি শত্রু। শাস্ত্রকারদের মতে, এই রিপুসমূহ আত্মোন্নতির প্রধান
অন্তরায়। কারণ, এই কাম থেকেই ক্রোধের ন্যায় একে একে অপরাপর রিপুর উদ্ভব। কামনা বা
বাসনা মিষ্টরসাদি বা ধনাদির দিকে অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হলেই তাকে লোভ বলে। এই বিষয়
বাসনাই আমাদেরকে অনিত্য বস্তুতে আসক্ত করে রাখে, আমাদের আত্মজ্ঞান আচ্ছন্ন করে
রাখে, উহার অতীত যে নিত্যবস্তু তা দেখতে দেয় না। এরই নাম মোহ, অজ্ঞান বা মায়া।৮
এই অজ্ঞানতাটাই যখন “আমি ধনী”, “আমি জ্ঞানী” এরূপ অহমিকার আকার ধারণ করে তখন তাকে
বলে মদ। এই অহমিকাটা আবার যখন পরের উন্নতি দেখে বাধাপ্রাপ্ত বা সংকুচিত হয় অর্থাৎ
অমুক আমার চেয়ে ধনী, অমুক আমার চেয়ে জ্ঞানী, এই অপ্রীতিকর সত্যটা যখন আমার ধনগর্ব
বা জ্ঞানগর্বকে খর্ব করে দেয় তখন যে চিত্ত ক্ষোভ উপস্থিত হয়, তারই নাম মাৎসর্য বা
পরশ্রীকাতরতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রিপুগুলোর সকলের মূল হচ্ছে কাম অর্থাৎ কামনা
বা বাসনা এবং এরা এক বস্তুরই বিভিন্ন বিকাশ, একভাবেরই বিভিন্ন বিভাব। তাই অর্জুনের
প্রশ্নের উত্তরে শ্রীভগবান বলেছেন, কামনাই সকল অনর্থের মূল, উহাই মানবের একমাত্র
শত্রু, এই কামনা ত্যাগ করতে পারলেই সকল অনর্থ ঘুচে পরমার্থ লাভ হয়। ৯ আবার মানুষের মনে কামনা বা বাসনা থাকলে
আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না।১০ কেবলমাত্র বিষয় বাসনা বিদূরিত হলেই আত্মজ্ঞানের
উদয় হয়। যেমন জরায়ুতে আবৃত থাকা সত্ত্বেও সন্তান ঐ আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে সমর্থ
হয় আর অগ্নি যেমন প্রজ্বলিত হয়ে আপন আবরণকারক ধূমকে নাশ করে দেয়, সেইরকম যে সময়ে
কোন সন্ত মহাপুরুষ বা শাস্ত্রের উপদেশের ফলে আত্মজ্ঞান তথা পরমাত্মা তত্ত্বের
জ্ঞান জাগ্রত হয়, সেই সময়ে কামের দ্বারা আবৃত হলেও তা কামকে বিনাশ করে স্বয়ং
প্রকাশিত হয়ে উঠে।
এই কাম মানুষের মনকে আশ্রয় করে
বহুবিধ সুখের কল্পনা করে, বুদ্ধিকে আশ্রয় করে নিশ্চয় করে, শ্রোত্রাদি
জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহকে আশ্রয় করে রূপ-রসাদি বিষয় ভোগ করে, হস্তপদাদি
কর্মেন্দ্রিয়সমূহকে আশ্রয় করে বিরূদ্ধ কর্ম করে। এইভাবে মানুষের মন, বুদ্ধি ও
ইন্দ্রিয়গুলোতে প্রবিষ্ট হয়ে তার বিবেকশক্তিকে নষ্ট করে দেয় আর ভোগে সুখের লোভ
দেখিয়ে তাকে পাপে প্রবৃত্ত করে, যার ফলে মানুষের অধঃপতন হয়ে যায়। এই কল্যাণবিরোধী
দুর্জয় শত্রু কাম- ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সাহায্যে বিষয় সুখরূপ প্রলোভনের দ্বারা
জীবাত্মার জ্ঞানকে আচ্ছাদিত করে রাখে, মানুষের পরমাত্মা তত্ত্বের জ্ঞান উদ্ভাসিত
হতে দেয় না। ফলে মানুষ মোহময় সংসাররূপ কারাগারে আবদ্ধ থাকে এবং পরমাত্মার
প্রাপ্তিরূপ প্রকৃত সম্পদ থেকে বঞ্চিত থেকে তার অমূল্য জীবনকে বিনাশ করে দেয়।
কাম সর্বপ্রথম ইন্দ্রিয়ে প্রবিষ্ট
হয়ে সেগুলোর দ্বারা মন ও বুদ্ধিকে মোহিত করে, জীবাত্মাকে মোহিত করে। মন, বুদ্ধি ও
ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে এর আবাসস্থল বা অবলম্বন। তাই প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজের বশে
এনে এই কামরূপ শত্রুর বিনাশ করতে হবে। এর বাসস্থানসমূহ রুদ্ধ করে দিলেই এই কামরূপ
শত্রুকে মারার পথ সুগম হবে। অতএব প্রথমেই ইন্দ্রিয়গুলোকে তারপর মনকে নিজের বশে
আনতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর জীবাত্মার আধিপত্য বিস্তার
না হবে, ততক্ষণ সেই জীবাত্মা আপন সামর্থ্যকে ভুলে তাদের অধীন হয়ে থাকবে এবং সেই
পর্যন্ত ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি তাকে ধোঁকা দিয়ে, বলপূর্বক বিপথে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ
ইন্দ্রিয়গুলোই প্রথমে মনকে বিষয় সুখে প্রলোভন দিয়ে নিজের মতে নিয়ে আসে । তারপর মন
ও ইন্দ্রিয় একত্র হয়ে বুদ্ধিকে কুপথে টেনে নেয় এবং সবাই মিলে আত্মাকেও অধীন করে
ফেলে। কিন্তু বাস্তবে তো ইন্দ্রিয়গুলো অপেক্ষা মন, মন অপেক্ষা বুদ্ধি আর সকলের
থেকে আত্মা শ্রেষ্ঠ ও বলবান। এইজন্য কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, যার বুদ্ধিরূপ সারথি
বিবেকশীল, মনরূপ লাগাম যার নিয়মানুসারে নিজের অধীন, তার ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়াও শ্রেষ্ঠ
ঘোড়ার মত বশে থাকে এবং এরূপ মন, বুদ্ধি আর ইন্দ্রিয়সহ পবিত্রাত্মা মানুষ ঐ পরমপদ
প্রাপ্ত হয়, যেখানে গিয়ে আর ফিরে আসতে হয় না অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুরূপ পৃথিবীতে আর
পুনর্জন্ম হয় না।১১ গীতাতেও
অধিকৃত মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় দ্বারা যুক্ত আত্মাকে মিত্র আর অনধিকৃত মন,
বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়কে নিজের শত্রুর সমান বলা হয়েছে।১২ অতএব প্রকৃতপক্ষে অনধিকৃত ইন্দ্রিয়গুলো
মন, বুদ্ধি অপেক্ষা বলহীন হয়েও বাস্তবে শক্তিশালী হয়ে থাকে।
আমাদের মধ্যে বহু সম্প্রদায়ের মানুষ
এখনও আছেন যারা মনে করেন ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করে ইন্দ্রিয় ও মনকে বশীভূত করা যায়। প্রাচীন
কাল থেকেই এ ধারণার প্রচলন রয়েছে। ভগবান বুদ্ধও সাধারণ মানুষের মতই তপস্যা বলতে
প্রথমে বুঝেছিলেন শরীরকে তপ্ত করে, উৎপীড়িত করে, বিশীর্ণ করে মনকে বশীভূত করা।
তিনি ছ’বছর দুষ্কর কৃচ্ছ্র সাধন করেন, ফলে তাঁর শরীর বিশীর্ণ হয়ে উঠে। একদিন উঠতে
গিয়ে তিনি মুর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এরূপ মৃতকল্প অবস্থায় তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,
ঐ ধরনের তপস্যায় ঈপ্সিত বস্তু পাওয়া যাবে না। প্রাণ ধারণের জন্য যতটুকু দরকার,
ততটুকু আহার গ্রহণ আবশ্যক। এরূপ বিবেচনা করে তিনি সুজাতা নামক একটি বালিকা প্রদত্ত
পায়েশ গ্রহণ করলেন। সুজাতার পরমান্ন গ্রহণ করে তিনি আবার ধ্যানে বসলেন সেই রাত্রেই
তাঁর বোধি লাভ হলো। তিনি বুঝলেন, মধ্যম পন্থাই অবলম্বনীয়। পরবর্তী কালে তা-ই তিনি
প্রচার করেছিলেন।
উপবাসাদি কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে
ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করে ইন্দ্রিয়াদিকে বশীভূত করা যায় না। উপবাসাদি কৃচ্ছ্র সাধন করলে
ইন্দ্রিয়গণ দুর্বল হয়ে বিষয় উপভোগে অশক্ত হয় বটে, কিন্তু তাতে বিষয় তৃষ্ণা নিবৃত্ত
হয় না। ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ভোগ না করলেই জিতেন্দ্রিয় হয় না। জরাগ্রস্ত, রুগ্ন, বিকলেন্দ্রিয়
ব্যক্তিগণ উপভোগে অসমর্থ, লোক নিন্দা ভয়ে অনেকেই ইন্দ্রিয় ভোগে বিরত থাকেন আবার
স্বর্গাদি ফল কামনায় অনেকে কৃচ্ছ্র সাধন তপস্যাদিতে নিযুক্ত থাকেন, তাদের উপভোগ
নেই বটে কিন্তু বাসনার অভাব নেই। তাদের ইন্দ্রিয়গণ বিষয়োপভোগে বিরত থাকে ঠিকই
কিন্তু তাদের বিষয়াভিলাষ বিদূরিত হয় না। আবার অত্যধিক উপবাসাদি কৃচ্ছ্র সাধনও গীতা
অনুমোদন করেন না।১৩ তাছাড়া
বিবেক বিচার দ্বারাও ইন্দ্রিয় জয় করা সম্ভব নয়। কারণ দুর্জয় ইন্দ্রিয়গণ বিবেকীরও
চিত্ত হরণ করে থাকে। ইন্দ্রিয়গণ সূক্ষ্ম প্রকাশক ও দেহাদির পরিচালক বলে স্থূল ভূত
হতে উহা শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্রিয়গণ মন হতে শ্রেষ্ঠ। মনকে অন্তরিন্দ্রিয় বলে। তাই উহা
বহিরিন্দ্রিয় হতে শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধি মনকে চালায় অর্থাৎ বুদ্ধি কিছু স্থির নিশ্চয় করে
দিলে মন সেদিকে ধাবিত হয়, সেই কার্যে আসক্ত হয়। তাই বুদ্ধি মন হতে শ্রেষ্ঠ। এই
বুদ্ধি হতে যিনি শ্রেষ্ঠ; যিনি সাক্ষিরূপে সকলের অন্তরে বিদ্যমান-তিনিই পরমাত্মা,
পরমেশ্বর।১৪ তিনি সকল ইন্দ্রিয় হতে শ্রেষ্ঠ ও স্বতন্ত্র, বুদ্ধিরও উপরে
অবস্থিত। একমাত্র তাতে চিত্ত সমাহিত হলেই বিষয় বাসনা দূর হয়। কিন্তু তাতে কার
চিত্ত সমাহিত হয়? শ্রীভগবান বলছেন, “যুক্ত আসীত মৎপরঃ”- যে ‘মৎপরঃ’, আমার একান্ত
ভক্ত, আমার শরণাগত,১৫ তারই চিত্ত সমাহিত হয় ( এই উক্তিটি “মন্মনা ভব
মদ্ভক্তঃ’১৬ ’মামেকং শরণং ব্রজ’১৭ প্রভৃতি কথায় বিশেষভাবে
স্পষ্টীকৃত হয়েছে।)। ঈশ্বরানুরাগ জন্মিলে বিষয়ানুরাগ দূরীভূত হয়, চিত্ত নির্মল হয়,
ইন্দ্রিয় সংযত হয়ে আসে। এক্ষেত্রে উপায় দু’টি- অভ্যাস ও বৈরাগ্য।
প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে মানুষের
স্বাভাবিক রাগ-দ্বেষ অর্থাৎ অনুকূল বিষয়ে অনুরাগ ও প্রতিকূল বিষয়ে বিদ্বেষ আছে, বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হওয়ার সময়
যখনই রাগ-দ্বেষের অবসর উপস্থিত হবে তখনই সাবধানের সঙ্গে বুদ্ধির দ্বারা বিচার করে
রাগ-দ্বেষের বশবর্তী না হবার চেষ্টা করলে ধীরে ধীরে রাগ-দ্বেষ ক্রমশঃ কমতে থাকবে।
বুদ্ধির বিচার করে ইন্দ্রিয়গুলোর ভোগে দুঃখ ও দোষ বার বার চিন্তা দ্বারা বিষয় ভোগে
অরুচি উৎপন্ন হওয়ার নাম বৈরাগ্য এবং ব্যবহার কালে স্বার্থ ত্যাগ ও ধ্যানের সময়
মনকে পরমেশ্বরের চিন্তায় নিয়োজিত করা এবং মনকে ভোগের প্রবৃত্তি থেকে সরিয়ে
পরমেশ্বরের চিন্তায় বার বার নিয়োজিত করার নাম অভ্যাস। অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা
মনকে বশে আনার কথা ভগবান গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে বলেছেন।১৮
আমরা দেখেছি এই তৃতীয় অধ্যায়েই ভগবান
বলেছেন, ‘প্রাণিগণ প্রকৃতির বশবর্তী হয়ে কর্ম করে। জ্ঞানবান ব্যক্তিও নিজ প্রকৃতির
অনুরূপ কর্ম করে থাকেন’।১৯ ‘কাম
প্রকৃতির রজোগুণ থেকে উদ্ভূত’।২০ তাহলে কি জীবের আত্ম-স্বাতন্ত্র্য ও আত্মোন্নতির
উপায় নেই? জীব কি সর্বোতোভাবে প্রকৃতিরই বশীভূত? না, তা ঠিক নয়। যে জীব প্রকৃতির
বশীভূত সে ‘কাচা আমি’, আভাস আত্মা, সে মনে করে আমি
কামনা করি; কর্ম করি; মন, বুদ্ধি ইন্দ্রিয় সকলেই আমার, আমিই কর্তা; কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রিয়াদি প্রকৃতির যন্ত্র
এবং কর্ত্রীও প্রকৃতিই। এই দেহেন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধিরও উপরে যিনি আছেন তিনিই ‘পাকা
আমি’, প্রকৃত আত্মা; তিনি নিত্যমুক্ত-স্বভাব হয়েও দেহোপাধিবশতঃ বদ্ধ বলে প্রতীয়মান
হন এবং দেহাধিষ্ঠিতকালে জীবাত্মা বলে কথিত হন; বস্তুত তিনি বদ্ধ নন। তিনি প্রকৃতির
বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বতঃই প্রেরণা দিচ্ছেন- জীব যখন তাঁকে জানতে পারে,
তাঁর প্রেরণা বুঝতে পারে, তখন আর তার প্রকৃতির বশ্যতা থাকে না; ‘আমি’ ‘আমি’ মোহ
থাকে না, কামনা-কলুষ থাকে না, ‘পাকা আমি’-র জ্ঞানের দ্বারা ‘কাচা আমি’ দূরীভূত হন।
এ-কেই বলে সংস্তভ্যাত্মনাত্মনা- আত্মার দ্বারা আত্মাকে স্থির করা বা নিজেই নিজেকে
স্থির করা এরই নাম আত্ম-স্বাতন্ত্র্য। জ্ঞানমার্গে আত্ম তত্ত্বের স্মরণ, মনন,
নিদিধ্যাসন দ্বারাই এই আত্ম-স্বাতন্ত্র্য লাভ করা যায়। যোগমার্গে প্রত্যাহার
ধ্যান-ধারণাদি দ্বারা মনকে নিশ্চল করলে এই আত্মস্বরূপ প্রকাশিত হন। ভক্তিমার্গে
বলা হয়- আত্মজ্ঞান বা আত্মার শুদ্ধ প্রেরণা পরমাত্মারূপ শ্রীভগবান হতেই আসে, তাতে
চিত্ত সমাহিত করতে পারলেই বা অনন্য ভক্তিযোগে তার কাছে আত্ম সমর্পণ করলেই প্রকৃতির
বন্ধন দূর হয়, ইন্দ্রিয় বিষয়ে রাগ-দ্বষ লোপ পায়, কামনা দূর হয়।
আলোচ্য শ্লোকে বুদ্ধি অপেক্ষা আত্মা
উপরে অর্থাৎ সূক্ষ্ম, বলবান ও অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ স্বীকার করে২১ কামকে
বিনাশ করার জন্য আদেশ করেছেন। কারণ, মানুষের জ্ঞান অনাদি কাল থেকে অজ্ঞানের দ্বারা
আবৃত্ত রয়েছে; সে কারণে মানুষ নিজের আত্ম-স্বরূপ ভুলে আছে; স্বয়ং সব থেকে শ্রেষ্ঠ
হয়েও নিজের শক্তিকে ভুলে গিয়ে কামরূপ শক্তির বশীভূত হয়ে রয়েছে। লোকপ্রসিদ্ধি ও
শাস্ত্রে বর্ণিত আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠত্ব শ্রবণ করেও বাস্তবে মানুষ একে সর্বশ্রেষ্ঠ
বলে স্বীকার করে না। যদি আত্ম-স্বরূপকে ভাল রূপে বুঝে স্বীকার করে, তবে আসক্তিমূলক
কাম সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য আত্ম-স্বরূপকে জানা ও স্বীকার করাই কামকে হত্যা
করার সহজ উপায়। এজন্য ভগবান আত্মাকে বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়স্কর স্বীকার করে কামকে বিনাশ করার আদেশ দিয়েছেন।
আত্মার অনন্ত বল ও শক্তি। তিনি
নিশ্চয়ই কামকে বিনাশ করতে পারেন। কিন্তু তিনি আপন মহাশক্তি ভুলে রয়েছেন। আত্মা তাই
আপনার বুদ্ধি, মন আর ইন্দ্রিয়ের অধীন হয়ে কাম প্রেরিত উচ্ছৃঙ্খলতাপূর্ণ মনের ইচ্ছার
মূক সমর্থন প্রদান করেন। এজন্য বুদ্ধি, মন আর ইন্দ্রিয়গুলোর অভ্যন্তরে গোপনে থাকা
কাম জীবাত্মাকে বিষয়ের প্রলোভন দিয়ে তাকে সংসারের ফাঁদে ফাঁসিয়ে রাখে।২২
যদি আত্মা আপন স্বরূপকে জেনে আপনার শক্তির উপলব্ধি করে বুদ্ধি, মন ও
ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করে, এদের খুশিমত আচরণ করার অনুমতি প্রদান না করে তাহলে
বুদ্ধি, মন বা ইন্দ্রিয় কারো শক্তি নেই যে সে কিছু করবে কিংবা কামের সামর্থ নেই যে
সে ক্ষণমাত্রও ঐখানে ঠিক থাকে। বস্তুতঃ কামের কোন শক্তি নেই সে আত্মার শক্তিতে
শক্তিমান হওয়া বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়গুলোতে টিকে থাকার স্থান পাওয়ার কারণে সেগুলোর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে আছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয় আপন বশে না আসে, ততক্ষণ তাদের দ্বারা আত্মার
বল শক্তি কাম-এ সঞ্চারিত হয়। এইজন্য কামকে অত্যন্ত শক্তিশালী মনে করা হয়। আর
সেজন্যই কাম-কে ‘দুর্জয়’ বলা হয়েছে। কিন্তু কামের এই দুর্জয়তা ততক্ষণেই টিকে থাকে,
যতক্ষণ না আত্মা নিজের স্বরূপকে জেনে বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়কে নিজের বশ করে
নিচ্ছে।
সুতরাং বুদ্ধিযুক্ত ইচ্ছার সাহায্যে
ধৈর্য্য সহকারে ধীরে ধীরে সকল প্রকার মানসিক চিত্ত-বিক্ষেপ থেকে মুক্ত হতে হবে।
আত্মশক্তি বা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি দ্বারা মনকে স্থির করে পরমাত্মাতে সমাহিত করতে
হবে। অপর কোন বিষয়ে কখনও চিন্তা করা চলবে না। চঞ্চল ও অশান্ত মন যেখানেই যাক, তাকে
গুটিয়ে আনতে হবে এবং তাকে পরমাত্মার বশীভূত করতে হবে। তবেই- কামরূপ দুর্জয় শত্রু
বিনাশ হবে এবং নিষ্কাম কর্মযোগ সাধনে সিদ্ধিলাভ হবে।
তথ্যসূত্র
১। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৬
২। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৭
৩। মনুস্মৃতি, ৩৯
৪। শ্রীমদ্ভাগবত, ৯।১৯।১৪
৫। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৭
৬। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ২।৭১, ৬।২৪
৭। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৬।২১
৮। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৯
৯। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ২।৭১-৭২
১০। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৮
১১। কঠোপনিষদ, ১।৩।৬, ৮
১২। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৬।৬
১৩। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৬।১৭, ১৭।৬
১৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৪২
১৫। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ২।৬১
১৬। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৮।৬৫
১৭। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৮।৬৬
১৮। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৬।৩৫
১৯। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৩
২০। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৩।৩৬
২১। কঠোপনিষদ, ১।৩।১০-১১
২২। কঠোপনিষদ, ১।৩।৫, ৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন