স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য, নীতি ও পদ্ধতি
স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক নির্ধারিত
উদ্দেশ্য, মূল নীতি ও পদ্ধতিতে পরিচালিত শিশু, কিশোর ও যুবকদের জন্য স্কাউটিং একটি
স্বেচছাসেবী, অরাজনৈতিক ও শিক্ষামূলক আন্দোলন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে স্কাউটিং
সকলের জন্য উন্মুক্ত।
স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য
স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল ছেলে মেয়েদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক,
সামাজিক আধ্যাত্মিক ও মানসিক দিকগুলো পরিপূর্ণ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বিকাশে অবদান রাখা যাতে করে তারা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি, দায়িত্বশীল
নাগরিক এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের
সদস্য হিসাবে জীবনযাপন করতে পারে।
স্কাউট আন্দোলনের মূলনীতি
স্কাউট আন্দোলন নিম্নবর্ণিত তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত (প্রতিজ্ঞা ও আইনের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে)-
১। স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন (আধ্যাত্মিক দিক)।
২। নিজের প্রতি কর্তব্য পালন (ব্যক্তিগত দিক)।
৩। অপরের প্রতি কর্তব্য পালন (সামাজিক দিক)।
স্কাউট পদ্ধতি
স্কাউট পদ্ধতি একটি ধারাবাহিক স্ব-শিক্ষামূলক প্রক্রিয়া, যার উপাদান গুলো
হচ্ছেঃ
১। প্রতিজ্ঞা ও আইনের চর্চা এবং তার প্রতিফলন।
২। হাতে-কলমে শিক্ষা
৩। ছোট ছোট দলের সদস্য হিসেবে কাজ করা (যেমন- ষষ্ঠক/উপদল পদ্ধতি)
৪। ক্রমোন্নতিশীল ও উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম (ব্যাজ পদ্ধতি)
৫। বয়স্ক নেতার সহায়তা
৬। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ
৭। প্রতিকী কাঠামো
সকল ধরণের স্কাউট কার্যক্রম ও প্রোগ্রাম স্কাউট পদ্ধতিতে
বাসত্মবায়ণ করতে হয় যাতে করে স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে।
স্কাউটদের জন্য যে সকল কাজ স্কাউট পদ্ধতিতে করা হয় না, তা স্কাউট প্রোগ্রাম বা
কার্যক্রম বলে বিবেচনা করা যায় না।
স্কাউটিং শিশু কিশোর, যুব বয়সীদের লেখা পড়ার অবসরে বয়স
উপযোগী আনন্দদায়ক কার্যাবলীর মাধ্যমেস উপস্থাপিত শিক্ষা সম্পূরক কার্যক্রম। এই
বয়সীদের প্রধান ও প্রথম কাজ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য এবং স্কাউট আন্দোলনের লক্ষ্য এক হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তারা এই লক্ষ্য অর্জনের বাস্তব অনুশীলনের সুযোগ পায় না। অপরদিকে স্কাউটরা মুক্তাঙ্গনে হাতে-কলমে কাজে অংশ গ্রহণ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা ব্যক্তি জীবনে
অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মস্ত করার সুযোগ লাভ করে।
স্কাউট আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
স্কাউটি আন্দোলন তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে সারা বিশ্বে আজও সমাদৃত। স্কাউটিংয়ের
বৈশিষ্ট্যের কতগুলো দিক হচ্ছে-
১। স্কাউটরা স্কাউট প্রতিজ্ঞা নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং
তার জীবনে প্রতিজ্ঞা মেনে চলার চেষ্টা করে।
২। স্কাউটরা সাফল্য বা বিফলতার কথা না ভেবে যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
৩। স্কাউটরা সকল কাজ হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শেখে।
৪। স্কাউটরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করে ও শেখে। একে
উপদল পদ্ধতি বলে।
৫। স্কাউটদের কাজের স্বীকৃতি ব্যাজের মাধ্যমে দেয়া হয়।
একে ব্যাজ পদ্ধতি বলে। নিজ নিজ বিষয় নির্বাচন করে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনে সফল হলে ব্যাজ প্রদান করা হয়।
৬। স্কাউটরা নির্ধারিত পোশাক, স্কাউট ব্যাজ ও স্কার্ফ প্রদান করে।
৭। স্কাউটরা নির্ধারিত তিন আঙ্গুলের বিশেষ কায়দায় সালাম দেয় ও
গ্রহণ করে।
৮। স্কাউটরা ডান হাতে পরস্পরে করমর্দন করে।
৯। স্কাউটরা নিজস্ব কায়দায় তাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে
থাকে - যেমন ক্যাম্পুরী, জাম্বুরী, মুট, ক্যাম্পফায়ার, স্কাউটস ওন, ক্রু
মিটিং/ট্রুপ মিটিং/ প্যাক মিটিং ইত্যাদি।
বয়স ভিত্তিক স্তর
বিন্যাস
স্কাউট আন্দোলন সকল ধরণের ছেলে মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত।
সুষ্ঠু পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশে স্কাউটিং তিনটি শাখায় বিভক্ত -
১। কাব স্কাউট- যে সকল বালক/বালিকার বয়স ৬ বছরের বেশী
কিন্তু এগার বছরের কম।
২। স্কাউট- যে সকল কিশোর / কিশোরীর বয়স ১১ বছর বা তার চেয়ে বেশী কিন্তু ১৭
বছরের কম।
৩। রোভার স্কাউট- যে সকল তরুণ / তরুণী
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অথবা যাদের বয়স ১৭ বা তার চেয়ে বেশী কিন্তু ২৫ বছরের কম। রেলওয়ে, বিমান ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে চাকুরীজীবীদের জন্য
বয়স ৩০ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য।
কাব প্রতিজ্ঞা
আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে,
‘‘আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন
করতে
প্রতিদিন
কারো না কারো উপকার করতে
কাব
স্কাউট আইন মেনে চলতে
আমি
আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’’
(অন্য ধর্মালম্বীগণ ‘‘আল্লাহ’’ শব্দের পরিবর্তে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস মতে সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করতে পারে)
কাব স্কাউট আইন
১. বড়দের কথা মেনে চলা।
২. নিজেদের খেয়ালে
কিছু না করা।
স্কাউট প্রতিজ্ঞা
আমি
আমার আত্মমর্যাদার উপর নির্ভর করে প্রতিজ্ঞা করছি যে,
‘‘আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন
করতে
সর্বদা
অপরকে সাহায্য করতে
স্কাউট
আইন মেনে চলতে
আমি
আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’’
(অন্য ধর্মালম্বীগণ ‘‘আল্লাহ’’ শব্দের পরিবর্তে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস মতে সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করতে পারে।)
স্কাউট আইন
১. স্কাউট আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী
২. স্কাউট সকলের বন্ধু
৩. স্কাউট বিনয়ী ও অনুগত
৪. স্কাউট জীবের প্রতি সদয়
৫. স্কাউট সদা প্রফুল্ল
৬. স্কাউট মিতব্যয়ী
৭. স্কাউট চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল।
(মনে রাখার সুবিধার্থে- বিশ্বাসী, বন্ধু,
বিনয়ী, সদয়, প্রফুল্ল,
মিতব্যয়ী, নির্মল রয়।)
স্কাউটদের মটো
‘‘সেবার
জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা।’’ সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য স্কাউট মটো-
কাব, স্কাউট ও রোভারদের মধ্যে নিম্নভাবে ভাগ করা হয়েছে
কাব মটো ‘‘যথাসাধ্য
চেষ্টা করা’’
স্কাউট মটো ‘‘সদা
প্রস্তুত’’
রোভার মটো ‘‘সেবা’’
এই মটোকে সামনে রেখে কাব, স্কাউট, ও রোভাররা তাদের বয়স
বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
বিশ্ব স্কাউটিং ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব
প্রথম অবস্থায় বিশ্বজুড়ে বালকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে স্কাউটিং
আরম্ভ হয়নি, কিন্তু স্কাউট আন্দোলনের প্রবর্তক রবার্ট স্টিফেনশন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল এর (সংক্ষপে বিপি) চিন্তাধারা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি যা কল্পনাতীত রূপে
বিভিন্ন দেশে গৃহীত ও প্রয়োগ হয়। দেশের পর দেশ অনুধাবন করতে পারে যে বালকদের কাছে
স্কাউটিং যে আবেদন সৃষ্টি করে অন্য কোন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি তেমন আর পারেনা।
এইভাবে স্কাউটিং বিশব জনগণের মধ্যে তার একটি ঐক্যবন্ধন সৃষ্টি
করেছে। বিশ্ব স্কাউট ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হচ্ছে
ষষ্ঠক/উপদল । একজন নবাগত কাব/স্কাউট/রোভার দলে যোগদান
করার পর নিজ ষষ্ঠক/উপদলের সকলের সাথে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এই গণ্ডি ষষ্ঠক/উপদল অতিক্রম করে বিস্তার লাভ হয়ে দল/ গ্রুপের সকল সদস্যদের মধ্যে, পরবর্তীতে এই ভ্রাতৃত্ব বিস্তার ঘটে থানা/জেলা স্কাউটসের সকল কাব, স্কাউট, রোভারদের মধ্যে, পরবর্তীতে এই ভ্রাতৃত্বের বিস্তার ঘটে আঞ্চলিক জাতীয়
ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
ইউনিট / গ্রুপ তাঁবু বাস থানা/জেলা স্কাউটস কর্তৃক আয়োজিত স্কাউট
সমাবেশ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান এবং আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ক্যাম্পুরী, সমাবেশ, রোভারমুট, জাম্বুরী,
ইউয়ুথ ফোরাম ইত্যাদি স্কাউট অনুষ্ঠানে যোগদান করে একজন স্কাউট এর মনে এই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ আরো নিবিড়তর হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন