সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

মহালয়ার তাৎপর্য


আশ্বিন মাস। দিগন্তজোড়া সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। নদীতীরে শূচিশুভ্র কাশবন। শিউলী ঝরা সকাল। এসেছে আশ্বিন কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম তিথি; সর্বপিতৃ অমাবস্যা- মহালয়া। মহালয়া এলেই যেন বাংলার মাটি-নদী-আকাশ মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করতে প্রস্তুত হয়।
মহালয়া এলেই দেবী বন্দনার সুর বাংলার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। ঢাকের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসে। বুকে জাগে আনন্দ শিহরিত কাঁপন; মা আসবেন। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ এই মনোভাব নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শরৎকালীন দুর্গাপূজা। সার্বজনীন উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ আর উপভোগে সফল উৎসব। মহালয়া, অতি পুণ্যময় এক তিথি। শাস্ত্রে আছে, এ তিথিতে পৃথিবী পবিত্র স্বর্গলোকে পরিণত হয়। স্বর্গত পিতৃপুরুষগণ স্বীয় বংশধরদের দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হন। প্রিয় দ্রব্যাদি গ্রহণ করেন আর প্রাণভরে আর্শীবাদ করেন। তাই অনন্তকাল ধরে মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে পিতৃ তর্পণ ও পিতৃ শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে এই দিনে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি নর-নারী তাদের পূর্ব পুরুষদের স্মরণ করে চলেছেন। পূর্ব পুরুষদের প্রতি মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করে চলেছেন। নিবেদন করছেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম। শাস্ত্রে রয়েছে, মহালয়া এমন এক পুণ্যময় তিথি, যে তিথিতে নিয়মের বাইরেও সকল পূর্ব পুরুষের শ্রাদ্ধ করা যায়। যে সকল ব্যক্তি নির্ধারিত তিথিতে তাদের কোন পূর্ব পুরুষের শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তারাও এ তিথিতে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। প্রিয় দ্রব্যাদি দান না করতে পারলেও শুধুমাত্র জল প্রাপ্তিতেই পিতৃপুরুষগণ তৃপ্ত হন। ত্রেতা যুগে অবতার শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে থাকাকালে শুধু জল দ্বারাই পিতৃপুরুষের তর্পণ করেছিলেন। ‘ব্রহ্মলোক অবধি যাবতীয় লোকে অবস্থিত সকল জীব, দেবতা ও মানুষ সকলে তৃপ্ত হোন। সমুদয় মানবগনের পিতৃপিতামহাদি এবং ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হোন’ বলে তিনি তর্পণের মন্ত্রে উল্লেখ করেন। রামের বনবাস সঙ্গী অনুজ লক্ষ্মণ ব্যস্ততার কারণে মন্ত্র সংক্ষিপ্ত করে বলেন, ‘ব্রহ্ম হতে তৃণ পর্যন্ত জগৎ তৃপ্ত হোক।’ তর্পণকালে আজও কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ জগতের কল্যাণমূলক অনুরূপ প্রার্থনাই করে থাকেন। এমনি করে উদার ভাবনায় অবগাহন করতে ভক্তকে সুযোগ করে দেয় মহালয়া। পিতৃপুরুষদের আর্শীবাদ আবার উদার ভাবনায় ভাবিত সংযমী মন, দেবী দশভুজা মহামায়া দুর্গাকে বরণ করতে পূর্ণ প্রস্তুত করে তোলে। পরদিন প্রতিপদ। দেবী পক্ষের শুরু। কোথাও কোথাও এ তিথি থেকেই নবমী পর্যন্ত নয় দিন ব্যাপী চলে নবরাত্রি উৎসব; আবার কোথাও দশেরা। কিন্তু বাংলাদেশে অতি প্রত্যুষে শঙ্খ ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে আবাহন ঘটে দেবী দুর্গার। ধ্বনিত হয় আগমনী সঙ্গীত, ‘বাজল তোমার আলোর রেণু’। দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মর্ত্যলোকে। চিরায়ত প্রথায় শুরু হয় বাঙ্গালি হিন্দুর শ্রেষ্ঠ উৎসবের। পূর্বাহ্নে মন্দিরে মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় মহালয়ার ঘটস্থাপন, বিশেষ পূজা আর সন্ধ্যায় চলে নানা অনুষ্ঠান। ঘোষিত হয় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী মোট কথা পাঁচ দিন পর আমাদের মাঝে শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার হরণ করে আমাদের মধ্যে আগমন করেন মা দুর্গা। তাই শুভ, মঙ্গল, আনন্দদায়ক ও আলোর দিশারী অসুরবিনাশিনী মা-কে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়। ষষ্ঠী তিথিতে হয় মায়ের বোধন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে পূজা শেষে বিজয়া দশমীতে মা মর্ত্যলোক ত্যাগ করেন। তাইতো মহালয়া শারদীয়া দুর্গোৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহালয়ায় পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই। তাই মহালয়া আমাদের জীবনেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন