সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

মা দুর্গা : সনাতন ধর্মের মূর্ত প্রতীক


ব্রহ্ম বা ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজিত। প্রতিটি প্রাণীর সমগ্র সত্তায়, প্রতিটি প্রাণীর সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও তাঁর উপস্থিতি। এই সর্বব্যাপকতাই সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের মূল সুর। আর্য ঋষিরা এই সর্বব্যাপক-সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আরাধনা মাতৃরূপেও করেছেন। শাস্ত্র
বলছেন-‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’।-অর্থাৎ সাধকের সাধনার সুবিধার্থে ব্রহ্মের বিভিন্ন দেবতার রূপপরিগ্রহ। দেবী দুর্গা সেই মাতৃরূপিণী ঈশ্বর- যিনি ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের দৃষ্টিতে প্রকৃতিরূপিণী ব্রহ্ম। তিনি মহাবীর্যবতী ও মহাতেজস্বিনী। সনাতন ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য, যা না জানলে বা না বুঝলে হিন্দু ধর্মকে বোঝা যায় না , তা হল- অসীমই সসীম হয়েছেন। নিরাকারই আকার নিয়েছেন। ধর্মগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে এই সত্য ব্যক্ত হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেখা যায় রাজা সুরথের প্রশ্নের উত্তরে মেধা ঋষি এই বিশিষ্ট সত্যেরই উল্লেখ করেছেন- ‘‘সেই মহামায়া নিত্যা (জন্মমৃত্যুরহিতা), আবার এই জগৎ প্রপঞ্চই তাঁর বিরাট মূর্তি। তিনি সর্বব্যাপী এবং নিত্যা হলেও তাঁর বহুপ্রকার আবির্ভাবের বৃত্তান্ত আমার নিকট শ্রবণ করুন।’’ (শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১।৬৪ ) যিনি নিত্য, যিনি সনাতন- তিনিই আবার ব্যক্ত, তিনিই আবার বিশ্বরূপ। যিনি নিরাকার, তিনি কেমন করে সাকার হতে পারেন! এ কেমন করে সম্ভব! এই ধর্মতত্ত্বটি দেবী দুর্গার মূর্তির মাধ্যমে অপূর্বভাবে ব্যক্ত হয়েছে। পুরাণে দেবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে এক অদ্ভুত কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে। ভাল এবং মন্দে মিশ্রিত এই জগৎ। যা কিছু ভাল, তাকে বলা হয় ‘দেবতা’। দেবতা শব্দের অর্থ- দ্যুতি বা প্রকাশ। এর ঠিক বিপরীত দিকে রয়েছে ‘অসুর’। ভাল ও মন্দ, আলো ও অন্ধকারের দ্বন্দ্বকে নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে দেবাসুর সংগ্রাম। সেই অসুরদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিশালী মায়াবী মহিষাসুর। তাঁর অত্যাচারে সব দেবতা শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন, ফলে আলো কমে গিয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল জগৎ। অনাচার, ব্যভিচার, হিংসা, নরহত্যা, নারীপীড়ন, লুণ্ঠন প্রভৃতি যাবতীয় অমানবিক মানসিকতায় প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিল মানব সমাজ। অধার্মিক হয়ে গিয়েছিল বেশিরভাগ মানুষ। এরকম অবস্থায় দেবতারা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের তিন মহান দেবতা, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবের কাছে উপস্থিত হলেন। কেমন করে এই দুঃসহ অবস্থা থেকে ভগবানের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে রক্ষা করা যায় তার উপায় তাঁরা জানতে চাইলেন। মানব মনে অমানবিকতার এই বীভৎস অবস্থার কথা জেনে তিন দেবতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের শরীর থেকে জ্ঞানের জ্যোতি নির্গত হতে লাগল। তখন ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি প্রমুখ সমস্ত দেবতা নিজের নিজের শক্তিকেও প্রকাশিত করলেন। সমস্ত দেবতার সম্মিলিত সেই শক্তি ‘জ্বলন্তমিব পর্বতম্’ -বিশাল এক জ্বলন্ত পর্বতের আকার ধারণ করল। আর সেই জ্যোতির মধ্য থেকে ‘একস্থং নারী অভূৎ ’- এক অপূর্ব সুন্দরী দীপ্তিময়ী মাতৃরূপ প্রকাশিত হল। জগতের দুর্গতি বা কষ্ট দূর করবেন বলে এঁর নাম হল ‘দুর্গা’। মায়ের দশহাত দশদিকের প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত। বিভিন্ন অস্ত্র ও শস্ত্র ঈশ্বরের সর্বশক্তির প্রতীক। বহু হাজার বছর আগে বেদ, বেদান্ত, পুরাণে যে সত্যটি ব্যক্ত করা হয়েছে -সেই ‘একম্ সৎ’ ( ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তিমান ) এর মতো বিমূর্ত ধারণাকে সর্বসাধারণের বোধগম্য করার জন্য দেবী দুর্গার এই রূপ কল্পনা করা হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেখা যায়, দৈত্যরাজ শুম্ভ দেবীকে পরাজিত করে বন্দি করতে শত শত যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। তখন তাঁর মনে পড়েনি, যুদ্ধ একের সঙ্গে একের হওয়ার বিধি। দেবীও তাই তাঁর বিভিন্ন শক্তির মাধ্যমে দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। যখন শুম্ভর মহাশক্তিশালী প্রাণতুল্য ভাই নিশুম্ভর মৃত্যু দেবীর হাতে হল আর সৈন্যবলও বিনষ্টপ্রায় তখন শুম্ভ দেবীর অন্যান্য শক্তিমূর্তি দেখিয়ে তাঁকে কোপান্বিত হয়ে বলল, ‘‘হে বলগর্বে উদ্ধতা দুর্গা, তুমি গর্ব করো না। কারণ অতিগর্বিতা হয়েও তুমি অন্যান্য দেবীর শক্তি (বল) আশ্রয় করেই যুদ্ধ করছো’’ ( শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১০।৩ )। তখন দৈত্যরাজের এই ভ্রান্ত ধারণাকে চুরমার করে দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল সেই বিখ্যাত কথা, যা সনাতন ধর্মের মূলসূত্র- ‘‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’’-‘একা মাত্র আমিই এই জগতে বিরাজিতা। মদ্ব্যতিরিক্ত( আমার সহায়ভূতা অন্যা ) দ্বিতীয়া আর কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি ( শক্তি )। এই দেখ, এরা আমাতেই বিলীন হচ্ছে’ ( শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১০।৫ )। দেখালেন জগৎ ও জগন্ময়ী শক্তিতঃ অভেদ বলে তাঁর অতিরিক্তা দ্বিতীয়া আর কেউ নেই। তাইতো সর্বভূতে, সর্বপ্রাণীতে, সর্বত্র বিভুরূপে অবস্থিত এই পরমাত্মাকে জানার, উপলব্ধি করার নামই ধর্ম। মহাশক্তি বা পরব্রহ্ম বা পরমাত্মা যে সর্বত্র বিরাজিত তা বোঝানোর জন্য দুর্গা পূজায় বনের মহীরুহ থেকে লতাগুল্ম -সব কিছুর আবশ্যকতা দেখা যায়। যেমন- অশ্বত্থ, বট, অশোক, যজ্ঞডুমুর ও আমের শাখা, অপরাজিতা লতা, বেলপাতা, তুলসীপাতা, তিল, দূর্বা, হরতকী, কলা, কালকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, মানকচু, ধান প্রভৃতি বনস্পতি। উদ্ভিদ ও লতাগুল্মের প্রতিনিধিরা সমমর্যাদায় উপস্থিত এই মহাপূজায়। আবার দেবীপ্রতীমার কাঠামোতে দেখা যায়, রয়েছেন লক্ষ্মী- ঐশ্বর্য যা বৈশ্যশক্তি, গণেশ- শ্রম অর্থাৎ শূদ্রশক্তি, সরস্বতী- জ্ঞান বা ব্রাহ্মণ্য শক্তি, কার্ত্তিকেয় ক্ষাত্র শক্তির দেবতা। রয়েছে তাঁদের পোষ্য পেঁচা, ইঁদুর, হাঁস ও ময়ূর। একই কাঠামের মধ্যে সকলের আসন। ওপরে চালচিত্রে রয়েছেন সদামঙ্গলময় দেবাদিদেব শিব। শিব- কল্যাণদাতা, আর দুর্গা- দুর্গতিনাশিনী। জীবনে কল্যাণ তখনই নেমে আসে যখন, গণসংহতি বা ঐক্যশক্তি, লক্ষ্মীর ধনশক্তি, সরস্বতীর জ্ঞানশক্তি এবং কার্ত্তিকেয়র বীর্যশক্তি সমন্বিত হয়। তখনই জীবনে দুর্গার অধিষ্ঠান হয় অর্থাৎ সকল দুর্গতির অবসান ঘটে, সকল দুদৈব অন্তর্হিত হয়। দেবীর দক্ষিণ পদতলে রয়েছে মহাবল বাহন সিংহ। বাম পদতলে ছিন্নমুণ্ড মহিষের দেহ থেকে সমুত্থিত দুর্ধর্ষ মহিষাসুর বিরাজিত। সিংহ পশুরাজ ও মহিষাসুর অসুরপতি। তারা সমগ্র পশুশক্তি ও অসুরশক্তির প্রতীক। উভয়ই দেবীর পদানত, অর্থাৎ মা দুর্গা সমস্ত পশুশক্তি ও অসুরশক্তির ঊর্ধ্বে বিরাজিতা। অতএব যাবতীয় পাশবিক ও আসুরিক স্তর অতিক্রম না করলে দেবীর প্রসাদ লাভ করা যায় না। এই পূজায় দেবী দুর্গা ঈশ্বরীরূপে যেমন পূজিতা, তেমনি শত্রু হলেও অসুরকেও সমান শ্রদ্ধায় অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। একইভাবে এই পূজায় দেখা যায় সিংহ বনের হিংস্র প্রাণীদের, ময়ূর স্থলচর পক্ষীকূলের, নিশাচর পেঁচা খেচর প্রাণীদের, ইঁদুর স্থলচর এবং হাঁস উভচর প্রাণীদের প্রতিনিধি হিসেবে দেবদেবীর পাশে পূজিতের আসনে আসীন। এখানে অসুর নিগ্রহে সরীসৃপ প্রতিনিধি বিষধর সর্পের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। একই চালচিত্রে সকলকে স্থান দিয়ে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে মা সর্বভূতে বিদ্যমান। তিনি সর্বজ্ঞ। এই মহাশক্তি, যা প্রতিটি মানুষের অন্তরে সতত বিদ্যমান, তাঁকে লাভ করতে হলে অসুরকে অর্থাৎ পাশবিক স্বার্থপর চিন্তাগুলোকে ধ্বংস করতে হবে; তাহলে মায়ের কৃপা পাওয়া যাবে। আর জগত্তারিণীর কৃপা পেলেই ঋদ্ধি, সিদ্ধি, বিদ্যা ও ধন অর্থাৎ মানুষের সকল ইচ্ছাই পূর্ণ হয়ে যাবে। তাইতো মায়ের পাশেই আমরা কার্ত্তিক, গণেশ, সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে অবলোকন করি। আবার এ পূজায় মহাস্নানের জন্য প্রয়োজন হয় মরু-পাহাড়-পর্বত-সমভূমি প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত তীর্থরাজির পবিত্র মৃত্তিকা। প্রয়োজন হয় নদ-নদী, বৃষ্টি, ঝরনা, সরোবর, সাগর-মহাসাগর, পুকুর, কুয়া প্রভৃতি নানা স্থানের জল। সবুজ ঘাসের সূক্ষ্মশীর্ষে জমে থাকা শিশিরবিন্দুরও প্রয়োজন হয়। মায়ের পূজায় যে মাটি প্রয়োজন হয় তা ব্রাহ্মণ, রাজা ও বারাঙ্গনার বাড়ি থেকে আনার বিধি রয়েছে। মা যে সর্বত্র বিদ্যমান, তিনি যে উচ্চ-নীচ, পবিত্র-অপবিত্র- এসবের ঊর্ধ্বে, এই বিধি তার প্রমাণ। এখানে জগন্ময়ী ও জগৎ অর্থাৎ স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি সমশ্রদ্ধায় পূজিতা। তাইতো বিশালতার বিগ্রহ মা দুর্গার উদ্দেশ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ নতমস্তকে উচ্চারণ করেন- ‘‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে/ শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্ত্ত তে।’’(শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১১।১০)। -হে সকল মঙ্গলের মঙ্গলত্বরূপিণী, হে কল্যাণকারিণি (শিবে), হে চতুর্বর্গদায়িকে ( ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ ), হে ত্রিভুবনজননী (ত্রি-অম্বকে), হে শুদ্ধসত্ত্বপ্রধানা (গৌরি), হে শরণযোগ্যা নারায়ণ-শক্তি, আপনাকে প্রণাম। মা দুর্গাই সনাতন ধর্মের মূর্ত প্রতীক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন