ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শরৎ এক বৈচিত্রময় ঋতু। শিউলী ঝরা সকাল, নদী তীরে কাশবন, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, হাওড়-নদী-বিল-ঝিলে বর্ষার দাপট কাটিয়ে একটু প্রশান্তি। প্রকৃতি আর মানুষের মন আনন্দে ভরপুর। আসে শারদোৎসব-শরৎকালীন দুর্গা পূজা।
সনাতন ধর্ম্বালম্বীদের প্রধান উৎসব। ‘‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’’ এই আদর্শ নিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন উৎসব। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের চেয়েও এখানে উৎসবের দিকটি প্রাধান্য পায়। আলোক সজ্জায় ঝলমল রাস্তা-ঘাট-পাড়া-পূজামণ্ডপ। মণ্ডপে মণ্ডপে কীর্তন, যাত্রাপালা, নাটক, সাংস্কৃতিক কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠান, দরিদ্র নারায়ণে বস্ত্র বিতরণ, প্রতি সন্ধ্যায় কোন না কোন অনুষ্ঠান না হলেই যেন নয়। ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ যে মেলবন্ধন তৈরি করে তা ভক্তদের আপ্লুত করে। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন ঘর-বাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধোয়া-মোছা করে পূজার প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করা হয়, ভাবখানা এই; পূজা যেন সার্বজনীন নয়, ভক্তের নিজ বাড়িতেই হচ্ছে। সকলেই নতুন কাপড় পরে এক ব্যতিক্রমী আমেজে মত্ত হয়। মূলতঃ পূজা অনুষ্ঠিত হয় চার দিন। ষষ্ঠীতে পূজা শুরু, তবে প্রতিমায় নয়- মণ্ডপের এক পাশে একটি বেল গাছের শাখা পুঁতে তাতেই দেবীর অধিষ্ঠান ভাবা হয়। আর বেল শাখাতেই দেবীর পূজা করা হয়। ততক্ষণে দেবীর প্রতিমায় শেষ আঁচড় পড়ে। শিল্পীর মনের মাধুরীতে সাজেন মা দুর্গা আর তাঁর সঙ্গী কার্ত্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী; বিচিত্র ভঙ্গিতে অসুর, সিংহ, ময়ূর, পেঁচা ও ইঁদুর। দেখে দেখে শিশু কিশোর আবাল বৃদ্ধ বণিতা কারও যেন সাধ মিটে না। এ রঙ নয় ও রঙ করলে ভালো হত। এ কাপড় নয় ঐ রঙের কাপড় কেন পরানো হয়নি? কত কথা, তবুও সপ্তমীতে দেবীর পূজা প্রতিমায় করা হয় না। দেবী নবপত্রিকায় প্রবেশ করেন। করা হয় নবপত্রিকায় পূজা। নবপত্রিকা হচ্ছে নয়টি গাছের সমন্বিত রূপ। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান। এই নয়টি গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতার লতা দ্বারা বেঁধে কাপড় পড়িয়ে ‘কলাবউ’ সাজানো হয়। সমষ্টিগত ভাবে মা দুর্গার প্রতিনিধি রূপে এদের অর্চনা করা হয়। নবপত্রিকা উদ্ভিদ জগতের প্রতিনিধি। মা দুর্গা উদ্ভিদ জগতেরও অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই নিখিল বিশ্বের সমস্ত উদ্ভিদে মহামাতৃরূপে স্থিতা জগন্মাতা দুর্গা। ‘কলাবউ’ এর মাধ্যমে প্রণাম জানিয়ে ভক্ত প্রার্থনা করেন- মা, নিখিল বিশ্বে বিরাজমানা তুমি আমাদের সকল ভয় থেকে রক্ষা কর, আমাদের যথার্থ কল্যাণ বিধান কর। পরদিন আসে মহাঅষ্টমী তিথি। অনুষ্ঠিত হয় যথাবিহিত মায়ের পূজা। কোথাও কোথাও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মা দুর্গার স্বরূপ হিসেবে কুমারী কোন মানব শিশুকে পূজা করা হয়। জগতের সকল নারীতেই মা দুর্গার অধিষ্ঠান। সকল নারীই তাঁর বিগ্রহ। তাই ভক্তের কাছে সকল নারী মাতৃস্বরূপা। শাস্ত্রে আছে, ‘যেখানে নারীরা শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সেখানেই দেবতা বিরাজ করেন।’ মহামায়ারূপী নারীশক্তি সকল শক্তির আধার। দুর্গা পূজার মধ্য দিয়ে ভক্ত সেই বিশ্বপ্রসবিনী জগতপালনী মহামায়াকে পূজা করেন। যাঁর কৃপা ভিন্ন ইহ ও পরত্র কোন লোকেই মানুষ বাঞ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। তারপর অনুষ্ঠিত হয় যথাবিহিত সন্ধি পূজা ও মা কালীর পূজা। পরবর্তী দিন মহানবমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় মা দুর্গার নবমী বিহিত মহাপূজা। তার পরদিন বিজয়া দশমী। যথাবিহিত পূজা শেষে করা হয় দেবীর বির্সজন। মহিষাসূরমর্দিনী মহাদেবীর ডান পাশে ধন ঐশ্বর্যের আধাররূপা মহালক্ষ্মী এবং সর্ব সিদ্ধিদাতা গণেশরূপী গণদেবতা, বামে জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী বিদ্যারূপিনী বাগদেবী সরস্বতী এবং শৌর্য-বীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কৌমার্য্য শক্তির আধাররূপী দেব সেনাপতি কার্ত্তিক বিরাজমান। ঊর্ধ্বে চালচিত্রে সদা মঙ্গলময় মহাদেব শিব। দেবীর দক্ষিণ পদতলে মহাবল বাহন সিংহ এবং বাম পদতলে ছিন্নমুণ্ড মহিষের দেহ থেকে উত্থিত দুর্ধর্ষ মহিষাসুর বিরাজিত। সিংহ পশুরাজ ও মহিষাসুর অসুরপতি। তারা সমগ্র পশু শক্তি ও অসুর শক্তির প্রতীক। উভয়ই দেবীর পদানত। অর্থাৎ মা দুর্গা সমস্ত পশু শক্তির ও অসুর শক্তির ঊর্ধ্বে বিরাজিতা। অতএব যাবতীয় পাশবিক ও আসুরিক স্তর অতিক্রম না করলে দেবীর কৃপা হয় না। মায়ের দশ হাতে দশ প্রহরণ ধারণ করে শরণাগত দীনার্তকে সর্বদা দশ দিক থেকে তিনি রক্ষা করছেন। আবার ঐসকল অমোঘ অস্ত্র সকল সমস্ত অসুরকূল অর্থাৎ অসুরশক্তি বিনাশেও সর্বদা সমুদ্যত। দেবী প্রকৃতপক্ষে সমস্ত দেবাত্ম শক্তির বিগ্রহ রূপা। মানুষের মধ্যে দেবাত্ম শক্তির জাগরণ ও বিকাশ না হলে মানুষের অন্তরস্থিত কামরূপী, লোভরূপী, ক্রোধরূপী, হিংসারূপী, বিবেকহীনতারূপী, পশু ও অসুরের বিনাশ সম্ভব নয়। পশু ও অসুরের মিলিত রূপ মহিষাসুর। এই মহিষাসুর তো আমাদেরই মধ্যস্থিত আমাদের কলঙ্কিত সত্তা । আবার দেবতেজ সম্ভবা দুর্গা বা দেব শক্তিও মানুষের অন্তরস্থিত সত্তা। কিন্তু সেই সত্তা থাকে পশু ও অসুর সত্তার দ্বারা আছন্ন। বিবেকের অঙ্কুশ যখন আমাদের চেতনাকে বিদ্ধ করে তখনই আমাদের প্রথম জাগরণ ঘটে। নিদ্রাভঙ্গের সেই প্রার্থিত প্রহরে আমাদের মধ্যে দেবসত্তার প্রথম উন্মেষ ঘটে। সেই উন্মেষকে বাঞ্চিত পথে পরিচালিত করতে হয়। সেই পথে অগ্রগতির জন্য প্রথমে চাই এই সচেতনতা; আমাদের শক্তি যেন বহুধা বিভক্ত না হয়, আমাদের শক্তিকে ‘সংহত’ বা কেন্দ্রীভূত করতে হবে। কেন্দ্রীভূত শক্তির অর্থ বা তাৎপর্য ‘সম্পদ’ আহরণ। এই সম্পদ নিছক ঐহিক সম্পদ নয়, এই সম্পদ বুদ্ধিকে শুভ ব্রতে স্থির ও সদা জাগ্রত রাখার কৌশল। শুভ ব্রতে বুদ্ধিকে স্থির ও সদা জাগ্রত রাখলে নিত্য ও অনিত্যের জ্ঞান বিকশিত হয়। কেন্দ্রীভূত শক্তি, বুদ্ধির স্থিরত্ব এবং জ্ঞানের বিকাশকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন ‘যোদ্ধৃত্ব’ ও ‘বীর্য’। এই সমস্ত যখন পূর্ণ বিকশিত হয় তখনই আমাদের অন্তরে দেব শক্তি বা দেবীর বিকাশ সম্পূর্ণ হয়। সেই বিকাশই শিব বা সর্বদা কল্যাণের নিধান। এসো মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, জগজ্জননী! সকল অশুভ বিনাশ কর। মা, তোমাকে প্রণাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন