সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

গিরি! প্রাণগৌরী আন আমার


দুর্গা পূজা বাঙালি হিন্দুর প্রাণের উৎসব-একথা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন। কিন্তু কখন, কোথায় এ উৎসবের শুরু হয় তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে পূজার ক্রিয়াকাণ্ড, উপচারাদি ও লোকায়ত চেতনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; আদি যুগে বাংলাদেশেই হয়েছিল
দেবী দুর্গার আর্বিভাব। সুজলা-সুফলা বাংলার মাটির সাথে দেবী পূজার সম্পর্ক বিদ্যমান। মৃন্ময়ী প্রতিমায় স্বপরিবারে দেবী কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দু কর্তৃকই পূজিতা হন। আর শরৎকালেই প্রধানত্ব বাংলার শস্য ঋতুর শুরু হয় আর বসন্তে হয় শেষ। তাই তো শরৎ থেকে বসন্ত দেবী অর্চনার মোক্ষম কাল। শারদীয় দুর্গা পূজার মধ্য দিয়ে দেবী পূজা আরম্ভ; ক্রমান্বয়ে লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজা, বাসন্তী পূজা ও অন্নপূর্ণা পূজায় এর বার্ষিক সমাপ্তি। দুর্গা পূজার প্রথম অঙ্গ হল ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষমূলে দেবীর বোধন। এক্ষেত্রে একটি বিল্ববৃক্ষ শাখা মাটিতে পূঁতে দেবী জ্ঞানে এর পূজা করা হয়। বিল্ব বা বেল মহাদেব শঙ্করের প্রিয় বলে দেবীর স্বরূপত্ব লাভ করেছে। এরপর সপ্তমী তিথিতে নবপত্রিকায় দেবীর পূজা সম্পন্ন হয়। এই নব পত্রিকা কী? একটি কলাগাছের সহিত কালকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধানগাছ একত্রে বেঁধে নির্মিত শস্য-বধূই নবপত্রিকা। একেই দেবীর প্রতীক বলে গ্রহণ করে প্রথমে পূজা করতে হয়। দুর্গাপূজার বিধিতে কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রাহ্মণী, কাল-কচুর কালিকা, হলুদের দুর্গা, জয়ন্তীর কার্ত্তিকী, বেলের শিবা, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধানের লক্ষ্মী। এর মাধ্যমে পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সাথে শস্য দেবীকে সর্বাংশে মিলিয়ে নেয়ার একটি সচেতন প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়। ফলত দুর্গা পূজার ভিতরে আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকাংশে মিলিত হয়ে আছে। নবপত্রিকায় ব্যবহৃত উদ্ভিদসমূহ ছাড়াও অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুর, আমের শাখা, অপরাজিতা লতা, বেলপাতা, তুলসীপাতাসহ ধান, দূর্বা, তিল, সরিষা, হরতকী, পান, সুপারি, চাল, যব, কলাই, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফল, ফুল, অন্ন, ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন, দুধ, দই, ঘি, খই, গোময়, গোমূত্র, কাঠ, চন্দন, সিদ্ধি, মাটি, বালি, জল ইত্যাদি সবই দেবী দুর্গার পূজায় সমাদরে আহৃত ও ব্যবহৃত হয়। এই সব কিছুই বাংলাদেশের চিরন্তন কৃষি-সম্পদ-নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার দ্যোতক। দেবী দুর্গা এই পূজার প্রধানা দেবী হলেও বাংলাদেশে তিনি সপরিবারে পূজিতা হন। এ যেন বাংলাদেশের যৌথ পরিবারেরই প্রতিচ্ছায়া। দেবী যেন সাধারণ বাঙালি পরিবারের প্রতিচ্ছায়া। দেবী যেন সাধারণ বাঙালি পরিবারের গৃহকর্ত্রী, মমতাময়ী, সন্তান বৎসলা মাতার ভূমিকায় অবর্তীণা। এখানে তিনি এসেছেন পুত্র কার্ত্তিক-গণেশ ও কন্যা-লক্ষ্মী-সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। পুত্র কন্যাদের সঙ্গে আবার এসেছে তাঁদের পোষ্য ময়ূর, ইঁদুর, পেঁচা ও হাঁস। একই কাঠামোর মধ্যে সকলের আসন। ওপরের চালচিত্রে রয়েছেন স্বামী শিব। রয়েছেন তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য-সকল মতের দেবদেবীরই সম্মিলিত উপস্থিতি এই অপূর্ব চালচিত্রে। দেবী সিংহবাহনা, কিন্তু প্রবল প্রতাপ ও বিক্রমশালী হিংসাশ্রয়ী সিংহ এখানে পরম মিত্র। সে মায়ের একান্ত অনুগত অনুচর। নিজের জীবন পণ করেও দেবী ও তাঁর সন্তান-সন্ততিদের সেবায় সে যেন সদা নিরত। সে যেন অতন্ত্র প্রহরী। মায়ের অসুর বিনাশকারী ভূমিকায় সে-ই প্রধান সহযোগী। তবে বাঙালি হিন্দুগণ যেভাবে দুর্গাপূজাকে সমাজ ও জাতীয় জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তেমনভাবে আর কেউ করতে পারেন নি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা (মা দুর্গা) বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। শিব পুরাণে কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর মহিষী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। বৎসরান্তে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি হিন্দু পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে-তাই বাঙালির ঘরে ঘরে দেখা যায় আনন্দের শিহরণ। আগমনী গানে শোনা যায় মায়ের আকুতি, ‘গিরি! প্রাণগৌরী আন আমার’। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুড়বাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র তিন দিনের জন্য-তাই আমরা সমস্ত দু:খ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজাই, নতুন জামা-কাপড় পরি, দু:খকে তিনদিনের জন্য বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে উঠি। কন্যারূপী দেবীর আগমনকে নিয়ে গীত হয় আগমনী, যা আমাদের জীবন প্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। বিজয়া দশমীর দিন আমাদের ঘরের মেয়ে উমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবার কৈলাসে ফিরে যাবেন তাই নবমীর রাত্রেই আমাদের হৃদয়ে দেখা দেয় এক সকরুণ বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা। যেতে দিতে মন চায় না, তবু যেতে দিতে হয়। মেয়ে উমা বাপের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন বলেই পাড়ার সধবা রমনীরা চির আয়ুষ্মতী উমাকে সিঁদুর পরিয়ে দেন এবং সেই সিঁদুর নিজেদের সিঁথি ও কপালে ধারণ করেন। তাঁরা উমাকে মিষ্টিমুখ করান, পান খাওয়ান এবং বারংবার বলতে থাকেন, ‘‘আবার এসো, আমাদের এই দু:খ-দৈন্যের ঘরে আনন্দময়ীরূপে তুমি আবার এসো।’’ প্রকৃতপক্ষে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন; মা দুর্গা আবার কবে আসবেন, পতিগৃহ থেকে কন্যা উমা আবার কবে আসবে। তাই তো বাঙালির জীবনে শারদীয় দুর্গাপূজা এক মহোৎসব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন