সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

শুভ দীপাবলী


দীপাবলী অর্থ আলোর উৎসব। এ-কে দেওয়ালীও বলা হয়। এর সময়কাল কার্তিক মাসের অমাবস্যার সন্ধ্যা। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সর্বত্র এ উৎসব পালিত হয়। তবে আলো-কে আমন্ত্রণ-বরণ করার উপাচার অনেকটা পৃথিবীর সর্বব্যাপী । বৌদ্ধ, জৈন ও খৃস্টানরাও
অন্যভাবে আলোর উৎসব পালন করেন। আমাদের অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দীপাবলী আর কালীপূজা একাকার। কিন্তু ভারতের অন্য প্রান্তে কালীপূজা ছাড়াই আলোর উৎসব হয়। বাংলাদেশে তন্ত্র শাস্ত্রের প্রাধান্য রয়েছে তাই এখানে কালী পূজা। রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধার করে চৌদ্দ বছর বনবাস শেষে রামচন্দ্র স্বস্ত্রীক নিজ রাজ্য অযোধ্যায় যখন ফিরে আসেন, তখন প্রজারা এই দীপাবলীর উৎসব শুরু করেছিল। বৌদ্ধরা দীপাবলী পালন করেন গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগ অর্থাৎ সন্ন্যাস ব্রতের স্মরণে। আবার গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মহামোগগলায়নের পরিনির্বাণ উপলক্ষ্যেও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ দীপাবলী পালন করেন। আশ্বিন কৃষ্ণ চতুর্দশীর রাতে জৈন তীর্থঙ্কর নির্বাণ লাভ করেছিলেন আবার খ্রিসমাস বা বড়দিনে যীশুখৃস্ট ধরা ধামে এসেছিলেন তাই খৃস্ট ধর্মাবলম্বীগণ এ উপলক্ষ্যে আলোর উৎসব করে থাকেন। মহামানবেরা আলোর দিশারী, তাই অন্ধকারে আলোর ঠিকানা পেতে তাঁদের স্মরণে আলোর উৎসব, মন্দ কি? সেটাই প্রার্থিত। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা আর দীপাবলীর মত পূজা-উৎসব ঘোর অমাবস্যায় আর একটিও নেই। সন্ধ্যায় আলোর উৎসব দীপাবলী আর মধ্যরাতে করাল-বদনী কালীর পূজা। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শক্তির দেবী হিসেবে যুগ যুগ ধরে কালী পূজা বা শ্যামা পূজার আয়োজন করে আসছেন। এ উপলক্ষ্যে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। যে রাত, দেবীর গায়ের বর্ণের মতনই ঘোর কালো। মূলত ঋক বেদের ‘রাত্রি সূক্তে’ যে দেবীর খোঁজ মেলে তাঁকেই কালীর আদি সূত্র বলে মেনে নেওয়া হয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে দীপাবলীর সন্ধ্যায় তেল দিয়ে সহস্র মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। আবার মাটির প্রদীপের পরিবর্তে কলাগাছের খোলে প্রদীপ জ্বালানোও লক্ষণীয়। এখনও অনেক স্থানে এ সব প্রথা চালু আছে। তবে বর্তমানে শহরাঞ্চলে অনেকে তেলের প্রদীপের পরিবর্তে মোমবাতি ব্যবহার করেন। দীপাবলীতে সন্ধ্যায় প্রতি গৃহে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মা লক্ষ্মীদেবীর স্মরণ ও পূজা করে থাকেন। কেউ কেউ করে থাকেন সিদ্ধিদাতা গণপতি বা গণেশের পূজা। তবে শ্যামা কালীর পূজাই প্রসিদ্ধ। দুর্গাপূজার পরে পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার মাধ্যমে দেবী পক্ষের সমাপ্তি হলেও পরবর্তী অমাবস্যার রাতেই দীপাবলীর আয়োজন। অমাবস্যা রজনীর সমস্ত অন্ধকার দূর করে পৃথিবীকে আলোকিত করার অভিপ্রায়ে এই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। পৃথিবীর সকল অমানিশা-অন্ধকার দূর করতেই এই আয়োজন। অশুভ শক্তির হাত থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে রক্ষা করতেই অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করার প্রয়াস মানুষ সেই আদিকাল থেকেই করে আসছে। বলা আবশ্যক যে, পুরো কার্তিক রজনীতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ আকাশ বাত্তি বা আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে একটি দীর্ঘ বাঁশের মাথায় ছোট বাঁশের ফ্রেমে, হরেক রঙিন কাগজে মোড়া বাক্সে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বেলে তুলে দেওয়া হয়। দূরে থেকে গ্রামের এমন আলো আজও কোথাও কোথাও দেখা যায়। আবার কোথাও তুলসী তলায় একটি লম্বা খুঁটির মাথায় প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়। দীপাবলীর রাতে এই আকাশ প্রদীপ বা স্বর্গ বাতি জ্বলে পুরো চার প্রহর। মৃত আত্মীয়গণ স্বর্গ থেকে পথ দেখে আসার জন্য তাদের উত্তর পুরুষরা এই আয়োজন করে থাকেন। লোক-বিশ্বাস, এই আলোর পথে পূর্ব পুরুষেরা স্বর্গলোক থেকে নেমে এসে দেখে যাবেন তাঁদের রেখে যাওয়া ভিটেতে তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছেন । সে যা হোক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক শুভ দেওয়ালী বা দীপাবলী। অশুভ অকল্যাণের প্রতীক অন্ধকারকে দূর করে শুভ ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠায় এ উৎসব পালন করা হয়। সুখ, শান্তি, জ্ঞান ও সম্পদ দেওয়ার জন্য এ উৎসবের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। তাই এই আলোর উৎসবে প্রার্থনা- সকলের মধ্যে সর্বত্র এই কল্যাণ আলোক ছড়িয়ে পড়ুক, সকলেই যেন এই মঙ্গল আলোকে আলোকিত হই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন