সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

আদি দেবী শারদীয় দুর্গা


বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দেবী এখানে মৃন্ময়ী প্রতিমায় স্বপরিবারে পূজিতা। দশভুজা হলেও এক নারীমূর্তি, মাতৃমূর্তি। কিন্তু ‘দুর্গা’ কে? ‘দুর্গ’-শব্দের শেষে ‘আ’-কার যুক্ত হয়ে ‘দুর্গা’ শব্দ গঠিত। ‘দুর্গ’-অর্থ- দৈত্য, মহাবিঘ্ন, ভববন্ধ, কুকর্ম,
শোক, দুঃখ, নরক, যমদ-, জন্ম, মহাভয়, অতিরোগ, ‘আ’-কারের অর্থ নাশক। অতএব ‘দুর্গা’ অর্থ এসব দুর্গতিসমূহের নাশক। তিনি পুরুষ কিংবা নারী নন; মহাশক্তি। যিনি ভগবান, যিনি মূলাশক্তি, যে শক্তি সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া কাজ করছে; সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কারিনী, জ্ঞানস্বরূপা, অমৃত-স্বরূপা, নিত্য-স্বরূপা। শক্তি শব্দটি স্ত্রীবাচক তাই ঈশ্বরের নারীরূপ ভাবনা করে মাতৃরূপে শক্তির আরাধনা ও উপাসনা করা হয়। দুর্গা পূজার ক্রিয়াকান্ড, উপচারাদি ও লোকায়ত চেতনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-আদিযুগে বাংলাদেশেই হয়েছিল দেবী দুর্গার পূজার আর্বিভাব। আদি যুগে বাঙালির সমাজ ছিল নারী শাসিত, মাতৃতান্ত্রিক। সুজলা-সুফলা বাংলার মাটিতে বীজ বুনলেই শস্য ফলত। শস্য-উৎপাদনে বাঙালি ভারতের আর সব অঞ্চলের অধিবাসীদের সহজেই পিছনে ফেলেছিল। আদিম বাঙালি সমাজে কৃষির তত্ত্বাবধান করত নারী। তাই এই সমাজে পুরুষের ওপর দাপট ছিল নারীর। আর এই কারণেই দেখা যায়, বাঙালি (হিন্দু) সমাজে নারী দেবতার প্রাধান্য। কালী-দুর্গা-লক্ষ্মী পূজার এত ছড়াছড়ি। গুপ্তযুগে বাংলা গুপ্তরাজাদের অধীনে এলে নারী দেবতার পূজা অবাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এযুগে নারী দেবতার প্রাধান্য মেনে নিয়ে পুরাণে তাঁদের ঠাঁই দেওয়া হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে মহাদেবীর উল্লেখ আছে, তাঁর সঙ্গে মহাদেব বা শিবের যোগ নেই। বিভিন্ন দেবতার সম্মিলিত তেজ থেকে তাঁর উদ্ভব। তিনি মহিষমর্দিনী। বাঙালির আদি দেবী। আদিম বাঙালি সমাজে দুর্গা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মহিষমর্দিনী। বনের মোষ ছিল কৃষির শত্রু, মানুষের শত্রু। কাজেই কৃষির বিকাশের স্বার্থে বনের মোষকে দমন করা আর তাকে পোষ মানিয়ে কৃষির কাজে ব্যবহার করা একান্তভাবে দরকার হয়ে পড়েছিল। আর এই কাজ চালিত হয়েছিল নারীর তত্ত্বাবধানে। মহিষমর্দিনী-মূর্তি হচ্ছে তারই প্রতীক। বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত ভাস্কর্য থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে গুপ্ত পরবর্তী যুগ অর্থাৎ সপ্তম, অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপটি শিল্পীদের প্রিয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ঋগ্বেদের ভিতরে পৃথিবীর মাতৃরূপের যে বর্ণনা রয়েছে তারই একটি পূর্ণ বিকশিত শক্তিময়ী ও মহিমময়ী মূর্তি অর্থববেদের ‘পৃথিবী সূক্ত’-এর মধ্যে পাওয়া যায়। পৃথিবী দেবী এবং তাঁর পূজা থেকেই আবার শস্য দেবী এবং শস্যপূজার উদ্ভব হয়েছে। আমাদের দেবী পূজার ভিতরে এই শস্যপূজা নানাভাবে মিশ্রিত আছে। প্রধানত: শরৎকাল থেকেই বাংলাদেশের শস্যঋতুর আরম্ভ; দেবী পূজার আরম্ভ তাই শরৎকালে হয়ে থাকে। বসন্তের শেষে আমাদের শস্য ঋতুর প্রকৃতপক্ষে শেষকাল। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শরৎ থেকে বসন্ত পর্যন্তই হল বাংলাদেশের সকল প্রকার দেবী পূজার কাল। শারদীয় অম্বিকা পূজা দ্বারা দেবী পূজার আরম্ভ; তারপরে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজা, বাসন্তী পূজা ও অন্নপূর্ণা পূজায় বাৎসরিক দেবী পূজার সমাপ্তি। উল্লেখ্য যে, ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’-এ পৃথিবীকে ‘শ্রী’ বলা হয়েছে। ‘নারায়ণ উপনিষদ’-এ মাটির এই পৃথিবীই দেবী। তিনি শ্রী বা লক্ষ্মীরূপে অর্চিতা। ‘কালিকা পুরাণ’ সূত্রে জানা যায়, পৃথিবী দেবী জগদ্ধাত্রীরূপে জনক রাজাকে দর্শন দান করেছিলেন। ‘মার্এণ্ডয় পুরাণ’-উক্ত চন্ডীর মধ্যে মহীস্বরূপেও দেবী নিজেই স্থিতা। তাছাড়া চণ্ডীতে দেবী ভ্রামরী, শাকম্ভরী তথা অন্নদা বা অন্নপূর্ণারূপে আর্বিভূতা হয়েছেন। এ সব দেবী যেমন দেবী দুর্গার এক একটি রূপ তেমনি পৃথিবী দেবীর এক একটি রূপ ছাড়াও আর কিছু নয়। দুর্গা পূজার প্রথম অঙ্গ হল ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষমূলে দেবীর বোধন। এক্ষেত্রে একটি বিল্ববৃক্ষ শাখা মাটিতে পূঁতে দেবী জ্ঞানে এর পূজা করা হয়। বিল্ব বা বেল মহাদেব শঙ্করের প্রিয় বলে দেবীর স্বরূপত্ব লাভ করেছে। এরপর সপ্তমী তিথিতে নবপত্রিকায় দেবীর পূজা সম্পন্ন হয়। এই নব পত্রিকা কী? একটি কলাগাছের সহিত কালকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু এবং ধানগাছ একত্রে বেঁধে নির্মিত শস্য-বধূই নবপত্রিকা। একেই দেবীর প্রতীক বলে গ্রহণ করে প্রথমে পূজা করতে হয়। দুর্গাপূজার বিধিতে কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রাহ্মণী, কাল-কচুর কালিকা, হলুদের দুর্গা, জয়ন্তীর কার্ত্তিকী, বেলের শিবা, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধানের লক্ষ্মী। এর মাধ্যমে পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সাথে শস্য দেবীকে সর্বাংশে মিলিয়ে নেয়ার একটি সচেতন প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়। ফলত দুর্গা পূজার ভিতরে আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকাংশে মিলিত হয়ে আছে। নবপত্রিকায় ব্যবহৃত উদ্ভিদসমূহ ছাড়াও অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুর, আমের শাখা, অপরাজিতা লতা, বেলপাতা, তুলসীপাতাসহ ধান, দূর্বা, তিল, সরিষা, হরতকী, পান, সুপারি, চাল, যব, কলাই, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফল, ফুল, অন্ন, ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন, দুধ, দই, ঘি, খই, গোময়, গোমূত্র, কাঠ, চন্দন, সিদ্ধি, মাটি, বালি, জল ইত্যাদি সবই দেবী দুর্গার পূজায় সমাদরে আহৃত ও ব্যবহৃত হয়। এই সব কিছুই বাংলাদেশের চিরন্তন কৃষি-সম্পদ-নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার দ্যোতক। দেবী দুর্গা এই পূজার প্রধানা দেবী হলেও বাংলাদেশে তিনি সপরিবারে পূজিতা হন। এ যেন বাংলাদেশের যৌথ পরিবারেরই প্রতিচ্ছায়া। দেবী যেন সাধারণ বাঙালি পরিবারের প্রতিচ্ছায়া। দেবী যেন সাধারণ বাঙালি পরিবারের গৃহকর্ত্রী, মমতাময়ী, সন্তান বৎসলা মাতার ভূমিকায় অবর্তীণা। এখানে তিনি এসেছেন পুত্র কার্ত্তিক-গণেশ ও কন্যা-লক্ষ্মী-সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে। পুত্র কন্যাদের সঙ্গে আবার এসেছে তাঁদের পোষ্য ময়ূর, ইঁদুর, পেঁচা ও হাঁস। একই কাঠামোর মধ্যে সকলের আসন। ওপরের চালচিত্রে রয়েছেন স্বামী শিব। রয়েছেন তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য-সকল মতের দেবদেবীরই সম্মিলিত উপস্থিতি এই অপূর্ব চালচিত্রে। দেবী সিংহবাহনা, কিন্তু প্রবল প্রতাপ ও বিক্রমশালী হিংসাশ্রয়ী সিংহ এখানে পরম মিত্র। সে মায়ের একান্ত অনুগত অনুচর। নিজের জীবন পণ করেও দেবী ও তাঁর সন্তান-সন্ততিদের সেবায় সে যেন সদা নিরত। সে যেন অতন্ত্র প্রহরী। মায়ের অসুর বিনাশকারী ভূমিকায় সে-ই প্রধান সহযোগী। তবে বাঙালি হিন্দুগণ যেভাবে দুর্গাপূজাকে সমাজ ও জাতীয় জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তেমনভাবে আর কেউ করতে পারেন নি। মাতৃরূপে বা শক্তি রূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা (মা দুর্গা) বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। শিব পুরাণে কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর মহিষী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। বৎসরান্তে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি হিন্দু পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে-তাই বাঙালির ঘরে ঘরে দেখা যায় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুড়বাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র তিন দিনের জন্য-তাই আমরা সকল দু:খ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজাই, নতুন জামা-কাপড় পরি, দু:খকে তিনদিনের জন্য বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে উঠি। কন্যারূপী দেবীর আগমনকে নিয়ে গীত হয় আগমনী, যা আমাদের জীবন প্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। বিজয়া দশমীর দিন আমাদের ঘরের মেয়ে উমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবার কৈলাসে ফিরে যাবেন তাই নবমীর রাত্রেই আমাদের হৃদয়ে দেখা দেয় এক সকরুণ বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা। যেতে দিতে মন চায় না, তবু যেতে দিতে হয়। মেয়ে উমা বাপের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন বলেই পাড়ার সধবা রমনীরা চির আয়ুষ্মতী উমাকে সিঁদুর পরিয়ে দেন এবং সেই সিঁদুর নিজেদের সিঁথি ও কপালে ধারণ করেন। তাঁরা উমাকে মিষ্টিমুখ করান, পান খাওয়ান এবং বারংবার বলতে থাকেন, ‘‘আবার এসো, আমাদের এই দু:খ-দৈন্যের ঘরে আনন্দময়ীরূপে তুমি আবার এসো।’’ প্রকৃতপক্ষে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন-মা দুর্গা আবার কবে আসবেন, পতিগৃহ থেকে কন্যা উমা আবার কবে আসবে। তাই তো বাঙালির জীবনে শারদীয় দুর্গাপূজা এক মহোৎসব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন