ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি সকল কিছুর নিয়ন্তা । তিনিই সৃষ্টি কর্তা । এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী, তিনিই সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি বিস্তারের ইচ্ছায় তিনি ব্রহ্মারূপে প্রথম পুরুষ স্বায়ম্ভুব মনু ও নারী শতরূপাকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তো মনুর সন্তান বলে আমরা মানব নামে
পরিচিত। দেশ, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, আচার-আচরণ ভিন্ন হলেও সবাই একই মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত। সকলেই সমান। সকলের সমান অধিকার রয়েছে। মননশীল জীব বলে আমরা মানুষ। মনুর বংশধর বলেই আমাদের মনুষ্য বলা হয়। সকলেই ‘অমৃতের পুত্র’ (শ্বেতাশ্ব.উপ.২/৫)। তাই বিশ্বের সবাই ভাই ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করব। সকল দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হব। কেউ কাউকে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, কেউ কারো অনিষ্ট করবে না, একে অপরের উপকার করবে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম অবলম্বন করলেও সকলেরই গন্তব্য এক। শিবমহিম্নঃ স্তোত্রে বলা হয়েছে- রুচিনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।। অর্থাৎ, হে প্রভো, বিভিন্ন পথে গিয়েও যেরূপ সকল নদী একই সমুদ্রে পতিত হয়, ভিন্ন ভিন্ন রুচিহেতু সরল ও কুটিল প্রভৃতি নানা পথগামীদেরও তুমিই সেইরূপ- একমাত্র গম্যস্থান। শ্রীমদভগবদগীতাও এই অদ্ভূত সত্যেরই পোষকতা করছে, বলছে- যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। অর্থাৎ, যে যেরূপ মত আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার নির্দিষ্ট পথেই চলে থাকে। বিভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারীদের প্রতি গীতায় আরও বলা হয়েছে- ‘‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখেদুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদাসমাহিত চিত্ত, সদা সংযত স্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ় নিশ্চয় এবং মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত’ (গীতা, ১২/১৩-১৪)। তাই তো বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য বিরোধী মতাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদের নির্দেশ- ‘‘সম্বিলিত হও, একত্রে বাক্যালাপে নিয়োজিত হও।..........তোমাদের প্রার্থনা অভিন্ন হোক, এক হোক তোমাদের বাসনা ও উদ্দেশ্য এবং অভিন্ন হোক তোমাদের সাফল্য। তোমাদের অভিন্ন প্রার্থনার কথা পুণরাবৃত্তি করছি এবং অভিন্ন নৈবেদ্যের প্রস্তাব করছি। তোমাদের অভিপ্রায় অভিন্ন হোক, অভিন্ন হোক তোমাদের হৃদয়, অভিন্ন হোক তোমাদের চিন্তা যার ফলে তোমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বাঙ্গীন ঐক্য।’’(ঋগ্বেদ, ১০/১৮৭/২-৪)। কোন ধর্মেই হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, নিন্দা প্রভৃতি থাকতে পারে না। সকল ধর্মই বিশেষ বিশেষ নৈতিক মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। শুধুমাত্র নৈতিক মূল্যই মানবজাতিকে ঐক্যের জন্য উৎসাহিত করতে পারে, মানুষের মধ্যে সংহতি প্রকাশ করতে পারে। মানব জাতি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হতে পারে। প্রতিষ্ঠা পেতে পারে ভ্রাতৃত্ববোধ। এ প্রসঙ্গে শ্রীমা সরদা দেবীর জীবনী থেকে একটি ঘটনা জানব। আমজদ নামক এক ব্যক্তি শ্রীমা সারদা দেবীর বাড়ির দেওয়াল প্রস্তুত করেছিল। একদিন মা তাকে বাড়ির ভেতরে নিজের ঘরের বারান্দায় খেতে দিয়েছেন; আর তাঁর ভাইজী নলিনী দিদি উঠানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পরিবেশন করছেন। মা তা দেখে বলে উঠলেন, ‘‘অমন করে দিলে মানুষের কি খেয়ে সুখ হয়? তুই না পারিস, আমি দিচ্ছি।’’ নলিনীদিদি মা-কে ঐরূপ করতে দেখে, ‘‘ও পিসীমা, তোমার জাত গেল,’’ ইত্যাদি বলে আপত্তি করতে লাগল। মা তাকে ধমক দিলেন, ‘‘আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, এই আমজদও তেমন ছেলে।’’ একজন ত্যাগী সন্ন্যাসী, অন্যজন কুখ্যাত ডাকাত। এ ঘটনার পর থেকে মাতা-পুত্রের নিবিড় সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। ভাল-মন্দ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মা সকলকে আপন করে নিতেন। তিনি বলতেন, “দোষ তো মানুষের লেগেই আছে। কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা জানে ক’জনে।............................ যদি শান্তি চাও, কারো দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।’’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন