বৈচিত্র্যময় আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ। ওপরে অনন্ত
আকাশ। সেই আকাশে চন্দ্র-সূর্যসহ কত গ্রহ-উপগ্রহ রয়েছে, রয়েছে অগণিত জ্যোতিষ্ক।
এই পৃথিবীও কত বৈচিত্র্যময়। কোথাও মৌন কঠিন
পর্বতমালা, শিখরে তাদের শ্বেত-তুষারের সূর্যোজ্জ্বল মুকুট শোভা পায় আর তাদের বুক
চিরে নৃত্যের ছন্দে নেমে আসে ঝর্ণাধারা। সেই ঝর্ণাধারা থেকেই সৃষ্ট হয়েছে নদ-নদীর
স্রোতধারা। কলতান তুলে যা সুবিশাল সাগরে গিয়ে মেশে।
নদীতীরে কোথাও শ্যামল প্রান্তর। কোথাও ধু ধু
মরুভূমি। কোথাও গভীর অরণ্য। মাঝে মাঝে আছে লোকালয়। বনে প্রান্তরে বা লোকালয়ে কত
রকমের বৃক্ষ-লতা। বৃক্ষে বৃক্ষে নানা বর্ণের পাখির কণ্ঠে নানা ছন্দের কাকলি।
প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে,
তেমনি এক গভীর। ঐক্যের পরিচয়ও পাওয়া যায় । ঋতুচক্রের আবর্তন, দিবা-রাত্রির
পালাবদল. গ্রহদের আপন কক্ষ পথে একই নিয়মে
ঘুরে ঘুরে চলা- এর মধ্যে একটা গভীর
ঐক্য ও শৃঙ্খলা রয়েছে।
এই যে অনন্ত বিস্ময়কর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং
বৈচিত্র্যের ঐক্য, এর মূলে রয়েছেন এক সুমহান স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। তিনিই ঈশ্বর।
তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেই সব কিছুর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা বা ঐক্য রয়েছে। ঈশ্বরকে
প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে উপলব্ধি করে তার বিভিন্ন সত্ত্বাকে প্রাচীনকাল থেকেই
বন্দনা করা হচ্ছে। মোটকথা আমরা আমাদের চোখের সামনে প্রকৃতি ও পরিবেশের যে বিস্ময়কর
রূপ প্রত্যক্ষ করি, তা ঈশ্বরেরই রূপ। জীব ও জগতের বৈচিত্র্য ঈশ্বরেরই বৈচিত্র্য। এ
সকলের সেবা ও বন্দনার মধ্যে ঈশ্বরের আরাধনাই প্রকাশিত।
উল্লিখিত
ধারণার মধ্যে এক মহান ধর্ম বিশ্বাস রয়েছে। সেই ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম। ‘সনাতন’
শব্দের অর্থ চিরন্তন, চিরস্থায়ী, নিত্য। যা ছিল, আছে ও থাকবে- তা ই সনাতন ।এই ধর্ম
আর্য মুনি-ঋষিদের সাধনালব্ধ সমন্বিত জ্ঞানের ফল। এটি কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন
ব্যক্তি বিশেষের প্রত্যাদেশ পাওয়া বা প্রবর্তিত ধর্ম নয়। কালের অগ্রগতির সাথে সাথে
যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এটি ক্রমশঃ বিকশিত হচ্ছে। তবে এর মৌলিক তত্ত্বের কোন
পরিবর্তন হয় নি তাই এ ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলা হয়। সনাতন ধর্মই ‘হিন্দুধর্ম’ নামে
পরিচিত।
‘হিন্দু’
শব্দের উৎপত্তি পারসিকদের দ্বারা। পারস্য ছিল বর্তমান ইরানের প্রাচীন নাম।
পারস্যের অধিবাসীরাই ছিলেন পারসিক। তাঁরা ‘স’ এর স্থলে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। তাই
তাঁরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশের সময় সিন্ধুকে
বলতেন হিন্দু। এ থেকে ভারতবর্ষের আর একটি নাম হয় হিন্দুস্থান। হিন্দু স্থানের
অধিবাসীরা হিন্দু আর তাদের ধর্মের নাম হয় হিন্দুধর্ম। হিন্দুধর্ম খুবই প্রাচীন
ধর্ম। এ ধর্মকে সামনে রেখেই সেকালে বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্ম ও নানা মত ও পথের
উদ্ভব হয়েছে।
ঈশ্বর হিন্দু ধর্মের মূল। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।
তিনি সব কিছুর নিয়ন্তা। তিনি সর্ব শক্তিমান। তিনি সর্বত্র রয়েছেন। তিনি এই জগতের
সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং ধ্বংস কর্তা। তাঁর অনন্ত ভাব, অনন্ত তাঁর রূপ। জ্ঞানীর
কাছে তিনি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত, সর্বজ্ঞ, জ্যোতির্ময়, নিরাকার,
সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান। এই ব্রহ্মই জীবদেহে আত্মা; আবার এ ব্রহ্ম যখন সবার উপর
প্রভূত্ব করেন তখন তিনি হন ঈশ্বর বা পরমেশ্বর। ভক্তের কাছে তিনিই ভগবান। ভগবান
গুণময়; তিনি অনন্তগুণ ও অশেষরূপের আধার। তিনি রসময়, আনন্দময়। ভগবানে মধ্যে ভক্ত
তাঁর অভীষ্ট রূপ ও ভাব প্রত্যক্ষ করতে পারেন। ভগবান রূপ ধারণ করে ভক্তকে দেখা দেন,
লীলা করেন।
এই জীব ও জগৎ সৃষ্টির আদি কারণ ঈশ্বরকে জানা,
নিজেকে জানার পাশাপাশি সৃষ্টিকে জানার ইচ্ছা ঔৎসুক্যও ভক্তের মনে জেগে ওঠে। আমাদের
ধর্মগ্রন্থে সেই সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।
বিশ্বব্রহ্মা-- সৃষ্টির আদিতে প্রাণি বা বস্ত্ত
কিছুই ছিল না । ‘অপ এব সসর্দাদৌ’ -প্রথমে জলের সৃষ্টি হলো। এই ব্রহ্মা-ব্যাপী মহাসমুদ্রের উপর বিষ্ণু মহানিদ্রায় শায়িত
ছিলেন। তাঁর নাভি কমলে ছিলেন ব্রহ্মা। এদিকে বিষ্ণুর কানের ময়লা থেকে মধু ও কৈটভ
নামে দুই দৈত্যের জন্ম হলো। দৈত্যরা
ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা মহামায়া ও বিষ্ণুর স্তব করতে
লাগলেন। মহামায়া প্রসন্ন হলে বিষ্ণুর মায়ানিদ্রা দূর হলো। তিনি মধু ও কৈটভকে বধ
করলেন। ঐ দুই দৈত্যের মেদ থেকে মেদিনী অর্থাৎ পৃথিবী সৃষ্টি হলো। আকাশ, বাতাস,
স্বর্গ, পাতাল, স্বপ্তদ্বীপা বসুন্ধরা ক্রমে সবই সৃষ্টি হলো। বিশ্ব ছিল সম্পূর্ণ
তমসাচ্ছন্ন। চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি সৃষ্টি করে ঈশ্বর অন্ধকার দূর করলেন।
এদিকে কশ্যপ মুনির দুই পত্নী- দিতি ও অদিতি, দিতি
থেকে দৈত্যদের এবং অদিতি থেকে জন্ম হলো দেবতাদের। এখন মানুষ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
ব্রহ্মা সৃষ্টি বিস্তারের জন্য তাঁর মানসপুত্র
ঋষিদের সৃষ্টি করলেন। কিন্তু ঋষিরা বংশবিস্তারে মনোযোগ না দিয়ে তপস্যায়
মগ্ন হলেন। ব্রহ্মাই প্রথম নারী ও পুরুষের সৃষ্টি করলেন। প্রথম সৃষ্ট পুরুষের নাম
স্বায়ম্ভুব মনু, নারীর নাম শতরূপা। আমরা মনুর সন্তান বলে মানব নামে পরিচিত।
স্বায়ম্ভুব
মনু ও শতরূপার প্রিয়ব্রত ও জ্ঞানপদ নামে দুই পুত্র এবং আকুতি, দেবাহুতি ও
প্রসূতি নামে তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করল। তারপর পৃথিবীতে এলো মানুষ। মানুষ পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের উপাসনায়, পূজায় মুখরিত হলো পৃথিবী, সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা
পেলেন সার্থকতা। স্রষ্টাকে জেনে সৃষ্টিও পেল পরম আনন্দ। স্রষ্টাকে পাবার জন্য তার
অন্তরে জেগে রইল অসীম আকুতি। সেই আকুতি থেকেই উপাসনা, পূজা, বন্দনা-সাধনা, আরাধনা
প্রভৃতির উদ্ভব।
হিন্দুধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করা যায়। জীবনে সৎ ও
মহৎ হওয়া যায়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘ধারণাদ্ ধর্ম। অর্থাৎ যা কিছু ধারণ
শক্তি সম্পন্ন তাই ধর্ম। কোন বস্ত্তর অস্তিত্ব সম্পর্কিত গুণসমূহই তার ধর্ম।
যেমন-আগুনের ধর্ম দহন করা, জলের ধর্ম শীতলতা ইত্যাদি। আবার ধর্মের নিজের কোন রূপ
বা পরিচয় নেই। এটি জলের ন্যায় পাত্রকে আশ্রয় করে থাকে। সুতরাং ধর্মের নিজের রূপ বা
পরিচয় পাওয়া যায় ধার্মিকের মধ্যে। অর্থাৎ
কোন ব্যক্তি কতকগুলো সদ্গুণের অধিকারী হলে আমরা তাকে ধার্মিক বলি।
মনুসংহিতায় (৬/৯২) ধর্মের দশটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে-
ধৃতিঃ
ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ ।
ধীর্বিদ্যা
সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্ ।।
এর তাৎপর্য হচ্ছে-ধর্মের রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়
সেই ব্যক্তির মধ্যে যিনি সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, মনঃসংযম, চুরি না করা, পবিত্রতা,
ইন্দ্রিয়দমন, বুদ্ধি, জ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা ও ক্রোধশূন্যতা প্রভৃতি গুণের অধিকারী যিনি
তিনিই ধার্মিক, এরূপ ব্যক্তির মধ্যেই ধর্মের রূপ বা পরিচয় নিহিত। অতএব
ধার্মিক ব্যক্তির এসব সদ্গুণই ধর্মের স্বরূপ। আবার শাস্ত্রে হিংসা না করা, চুরি না
করা, সংযমী হওয়া, শুচি বা পবিত্র থাকা ও সত্যাশ্রয়ী হওয়া এই পাঁচটিকে মনুষ্যত্ব
তথা মানব ধর্মের লক্ষণ বলেও উল্লেখ করা
হয়েছে।
ভগবান
সমগ্র সৃষ্টির মূল তাই ধর্মের মূলও তিনি। সুতরাং তাঁকে লাভ করে, তাঁকে আশ্রয় করে
থাকাই নিশ্চিত মঙ্গল। এটি জীবনের প্রধান লক্ষ্য, জীবনের চরম সার্থকতা। কিন্তু জীবন
যাপনের উপায় না থাকলে ধর্ম সাধনা সম্ভবপর নয়। জীব মাত্রই সুখ কামনা করে এবং দুঃখকে
পরিহার করতে চায়। কিন্তু একমাত্র ধর্ম হতেই ইহলোক ও পরলোক সুখ শান্তি লাভ হয়।
বৈশেষিক দর্শনে বলা হয়েছে, ‘যতো বাহভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ।’ অর্থাৎ যা হতে অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স লাভ হয় তা-
ই ধর্ম। ‘অভ্যুদয়’ মানে সাংসারিক উন্নতি, যেমন- ধন, মান, যশ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি।
‘নিঃশ্রেয়স’ মানে নিশ্চিত মঙ্গল। তা হলে বলা যায়, যা হতে জাগতিক উন্নতি ও
পারমার্থিক কল্যাণ হয় তা- ই ধর্ম। অতএব জীবিকা নির্বাহের জন্য সংসারী লোকের পক্ষে
সাংসারিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করা ধর্ম সাধনের একটা দিক। তবে সৎপথে ও ন্যায় পথে
থেকেই তা করতে হবে। শত দুঃখ কষ্টেও ধর্মপথ ত্যাগ করতে নেই। তা হলেই একদিন দুঃখ
কষ্টের অবসান ঘটবে। প্রকৃতপক্ষে যা হতে ইহলোক ও পরলোকে সুখ-শান্তি লাভ হয়, তা-ই
ধর্মের বিশেষ লক্ষণ।
হিন্দু
ধর্মের কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-
ঈশ্বরে
বিশ্বাস -
হিন্দুধর্ম
বিশ্বাস করে- ঈশ্বর আছেন, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র তিনিই
ছিলেন, আর কিছুই ছিল না। বিশ্বের সবই ঈশ্বর হতে উৎপন্ন হয়েছে, আবার তিনিই চরাচর
বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন। তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি সমগ্র বেদময়। বেদাদি
শ্রাস্ত্র তাঁরই মহিমা কীর্তন করে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তা একমাত্র তিনিই।
তিনি মহাশক্তি। শক্তি শব্দটি স্ত্রীবাচক তাই ঈশ্বরের মাতৃরূপ ভাবনা করে শক্তির
আরাধনা ও উপাসনা করা হয়।
বেদের
অপৌরুষেয়তা-
হিন্দু
ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ যা দ্বারা জানা যায়। অপর
কথায় বেদ অর্থ হলো সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডার। বেদের মন্ত্রগুলি বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন
মনীষীদের মণীষায় আবির্ভূত হয়। ঐ সব মনীষী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নামে খ্যাত। তাঁরা
মানস নেত্রে মন্ত্র দর্শন করে সুর সংযোগে তা গান করতেন। সে সময়ে ঋষি-পরিবারের
লোকেরা ঐ সমস্ত মন্ত্র শুনে শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলে বেদের এক নাম শ্রুতি।
বেদ চিরদিনই গুরু পরম্পরায় শ্রুতি হয়ে এসেছে। ঋষিদের ধ্যানলব্ধ জ্ঞান বা দর্শনের
বাণীবদ্ধ প্রকাশ বেদ। ঋষিরা বলেছেন, তাঁরা এর স্রষ্টা নন, দ্রষ্টা মাত্র। তাই
বেদকে বলা হয় অপৌরুষেয় অর্থাৎ কোন পুরুষ বা ব্যক্তি তা রচনা করেন নি।
জন্মান্তর
ও কর্মফল-
হিন্দু
ধর্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল আত্মার অবিনশ্বরতা, জন্মান্তর ও কর্মফলে বিশ্বাস।
ব্রহ্ম যখন সবার উপরে প্রভূত্ব করেন তখন তাকে বলে ঈশ্বর। আবার এই ব্রহ্ম যখন
জীবদেহে অবস্থান করেন, তখন তাকে বলে আত্মা। আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নেই। আত্মা
অবিনশ্বর। আত্মা দেহ ধারণ করে জন্ম গ্রহণ করে। তাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মা এক দেহ
ত্যাগ করে অন্য দেহ ধারণ করে অন্য জন্ম লাভ করে। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মার অন্য
জন্ম লাভ করার নাম ‘জন্মান্তর’। হিন্দুধর্ম এই জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। এই
জন্মান্তরের সাথে কর্মফলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে কর্ম করতে হয় এবং
সে তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করে। জীব জন্ম গ্রহণ করে তার কর্মফল ভোগের জন্য। জীব এ
জন্মে যেমন কর্ম করবে, সেই অনুযায়ী তার পরবর্তী জন্ম হবে। ভাল কর্ম করলে ভাল জন্ম
হবে। খারাপ কর্ম করলে খারাপ জন্ম হবে। আবার এ জন্মের ফল আগামী জন্মে তাকে ভোগও
করতে হবে। ভাল কর্মের দ্বারাই জীব এক সময়
মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেন। জন্মান্তর বা পুণর্জন্মের আবর্ত থেকে ব্রহ্মের সঙ্গে
জীবাত্মার মিলনই হলো মুক্তি বা মোক্ষ। এই চিরমুক্তির বা মোক্ষলাভই হিন্দু ধর্মের
মূল লক্ষ্য।
অবতারবাদ-
কর্মফল
ভোগের জন্য নয়, কোন বিশেষ কার্য সাধনের জন্য ঈশ্বরও জীবরূপে জন্ম গ্রহণ করেন।
ঈশ্বরের এই বিশেষ কার্যসাধনের নাম লীলা । ঈশ্বর যখন এই লীলা প্রকাশের জন্য জীবরূপে
পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বা নেমে আসেন, তখন তাকে অবতার বলে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা
হয়েছে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ঈশ্বর জীবরূপে পৃথিবীতে
অবতীর্ণ হন। ঈশ্বরের অবতীর্ণ হওয়ার এ তত্ত্বটিকেই বলা হয় অবতারবাদ।
জীবসেবা-
ঈশ্বরের
এক নাম পরমাত্মা। তিনি জীবের মধ্যেও অবস্থান করেন। জীবের মধ্যে অবস্থানকারী
ঈশ্বরকে আত্মা বা জীবাত্মা বলে। ঈশ্বর জীবদেহে আত্মারূপে অবস্থান করেন, তাই জীবও
ঈশ্বর। সুতরাং জীবের সেবা করলে তা ঈশ্বরেরই সেবা করা হয়, জীবকে ভালবাসলে ঈশ্বরকে
ভালবাসা হয়। তাই ভক্ত ঈশ্বর জ্ঞানে জীবের সেবা করে থাকেন।
হিন্দুধর্মে
কোন কাজটি করা সঙ্গত আবার কোন কাজটি করা ধর্ম বিরুদ্ধ তা নির্ণয়ের প্রশ্ন আসতে
পারে। এর সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রথমে আশ্রয় করতে হয় বেদ, তারপর স্মৃতি, সদাচার ও
বিবেকের বাণী।
বেদ- বেদ আদি ধর্মগ্রন্থ তাই ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে বেদ হচ্ছে উৎকৃষ্ট বা প্রথম
প্রমাণ।
স্মৃতি- বেদ সকলের বোধগম্য নয়, আবার জীবন যাপনের সব রকম কাজের কথাও বেদে নেই।
এজন্যে বেদের উদ্দেশ্য ঠিক রেখে মনু, পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিগণ
স্মৃতিশাস্ত্র তথা হিন্দুধর্মের বিধি-বিধান প্রণয়ন করলেন। মনু সংহিতা, পরাশর
সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ হচ্ছে ধর্মের দ্বিতীয়
প্রমাণ।
সদাচার- যেখানে বেদ ও স্মৃতির নির্দেশ পাওয়া যায় না, সেখানে সৎ ব্যক্তির আচার এবং
উপদেশ ধর্ম বলে গ্রহণ করা হয়।
বিবেকের
বাণী- বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, এমনকি সদাচার ও যেখানে
ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে নির্দেশ দিতে পারে না, সেখানে বিবেকের বাণীকে ধর্ম বলে গ্রহণ
করতে হয়।
উপাসনা, যজ্ঞ, পূজা, কীর্তন, তীর্থভ্রমণ প্রভৃতি
হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠানগত দিক। এই দিকগুলো ছাড়াও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন
সময়ে করণীয়; গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন,
জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন ও বিবাহ প্রভৃতি দশটি
সংস্কার বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পর্কেও হিন্দুধর্ম শাস্ত্রে সুনির্দিষ্ট
বিধি-বিধান রয়েছে। শাস্ত্রের বিধি-বিধান আশ্রয় করে হিন্দুদের সমগ্র জীবনে যেমন
অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন মাঙ্গলিক ক্রিয়া, তেমনি মৃতজনের উদ্দেশ্যেও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া,
পারলৌকিক কৃত্য প্রভৃতি সম্পাদন করার বিধি-বিধানও হিন্দুধর্মে রয়েছে।
শাস্ত্রের সকল বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক ধর্মীয়
আচার-আচরণ ও মাঙ্গলিক কর্ম সম্পাদন করে মানবজীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করে গড়ে
তোলাই হিন্দুধর্মের মূল লক্ষ্য ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন