যা আমাদের ধারণ করে তা-ই আমাদের ধর্ম। যা ধারণ করলে সমাজ
ও ব্যক্তির মঙ্গল হয় তাকে ধর্ম বলা হয়। সত্যিকার অর্থে ধর্ম কল্যাণকর, শুধু
মানুষের জন্য নয় সমগ্র পৃথিবীর জন্যই হিতকর, মঙ্গলকর। পৃথিবীতে
যত প্রকার
অকল্যাণকর কাজ হয়েছে তা ধর্মের নামে হলেও সেখানে ধর্ম ছিল না, ছিল অধর্ম।
সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, চিত্তসংযম, অস্তেও অর্থাৎ চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম ,
ধী, বিদ্যা, সত্য ও অক্রোধ - এ দশটি ধর্মের লক্ষণ (মনুসংহিতা, 6/92)। তাই যেখানেই ধর্ম আছে সেখানে
হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, নিন্দা ইত্যাদি থাকতে পারে না। জগতের সকল মানুষ এক স্রষ্টার
সৃষ্টি, বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মই এ বাস্তব সত্যে বিশ্বাসী । তাই একই স্রষ্টার
সৃষ্টি হিসেবে পরস্পরের প্রতি তো সহানুভূতি, ভালবাসা ও সৌহার্দ্যবোধ হওয়া উচিত,
এখানে হিংসা, নিন্দা, ঘৃণা বা বিদ্বেষের স্থান নেই। কারণ এটি ধর্মের বিপরীত-
অধর্ম। যেমন, সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য ধর্ম হলে অসহিষ্ণুতা বা ধৈর্য হারানো অধর্ম।
অস্তেয় বা চুরি না করা ধর্ম, চুরি করা অধর্ম, সততা ধর্ম, সুতরাং প্রতারণা বা
মিথ্যাচার বা লোক ঠকানো অধর্ম । অধর্ম মানুষকে অসৎ পথে টেনে নেয়। ধর্ম তাকে সৎ পথে
রাখে । ভগবানই ধর্মের মূল। ভগবানে বিশ্বাস রেখে সৎ পথে চলাই ধর্ম ।
আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ পায়। যে সব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস
মানুষের আচার-আচরণ ও কার্যাবলিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোর সমষ্টিকে
মূল্যবোধ বলা হয়। কোন্ কাজটি করা ভাল বা কোন্ ধরনের জীবন যাপন করা উত্তম তা
নির্ধারণ করাই হচ্ছে মূল্যবোধের লক্ষ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে সমাজে নানা ধরণের
সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য, লোকহিতসাধনার্থ কর্ম করতে হয়।
শ্রীমদভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে
বলেছেন, ‘লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি’
(৩/১০) অর্থাৎ লোকহিতসাধনার্থে বা লোক রক্ষার দিকে দৃষ্টি রেখেও তোমার কর্ম
করা কর্তব্য। কারণ -জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ যেরূপ আচরণ করেন, যা প্রামাণ্য বলে
গ্রহণ করেন, যে আদর্শ প্রদান করেন, সাধারণ লোকেও তা-ই অনুসরণ করে। কেবল ধর্ম-কর্ম
নয়, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা সকল বিষয়েই এ কথা সত্য। তাই জনকাদি
জ্ঞানী ব্যক্তিরাও কর্ম করেছেন। ভগবান বলছেন, ‘হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয়
কিছু নেই , অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নেই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত
আছি। আমি কর্ম না করলে আমার দৃষ্টান্তের অনুসরণে সকলে নিজ নিজ কর্তব্য কর্ম ত্যাগ
করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে এবং উৎসন্ন হয়ে যাবে। স্বেচ্ছাচারে বর্ণ-সঙ্করাদি
সামাজিক বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী। সামাজিক বিশৃঙ্খলায় ধর্ম-লোপ, সমাজের বিনাশ। তাই
আমি বর্ণ-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙখলার কারণ হবো এবং ধর্ম লোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের
কারণ হবো। সুতরাং লোক-সংগ্রহার্থ, লোক-শিক্ষার্থ আমি কর্ম করি, তুমিও তা কর’।
(গীতা, ৩/২১-২৪)
স্বার্থপরতা, আত্মবাদীতা ইত্যাদি সংকীর্ণ চিন্তা পরিহার
করে মানুষের কল্যাণ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্ম করাই ধর্ম। কাজটি ছোট হোক বা বড় হোক
সব অবস্থাতেই প্রশংসনীয়। কর্মফলের আশা না করে কর্তব্য জ্ঞানে অপরের কল্যাণের জন্য
কর্ম সম্পন্ন করা ঈশ্বর আরাধনার সামিল। এ কে কর্মযোগ বলা হয়।
কর্মযোগে স্বকর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়। স্বকর্ম মানে
নিজের কর্ম। নিষ্কামভাবে ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে স্বকর্ম সম্পন্ন করলে এ ধরনের কর্ম
দ্বারাই সিদ্ধিলাভ হয় -‘স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ’ (গীতা , ১৮/৪৬)।
এ সম্পর্কে ধর্মব্যাধের সাধনার কথা স্মরণ করা যায়।
ধর্মব্যাধ নামে এক জন কর্মযোগী ছিলেন । তিনি ছিলেন মাংস
বিক্রেতা । দোকানে বসে মাংস কাটেন ও তা বিক্রি করেন। প্রয়োজনবোধে ধর্মের আলাপ
করেন। তাঁর প্রাণটি ঈশ্বর চিন্তায় ভরপুর । কিন্তু ব্যাধের পুত্র ব্যাধ বলে তিনি
পশুহত্যা ও মাংস বিক্রয় স্বধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ কাজ অপরের নিকট নিন্দনীয়
হলেও এটা ব্যাধের স্বকর্ম। ব্যাধ বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ পোষণের জন্য এ কাজ অম্লান
বদনে করে যাচ্ছেন। এ কাজটি ধর্মব্যাধের কর্মযোগ। তাঁর উপলব্ধিতে ছিল ঈশ্বর তাঁকে
দিয়ে যা করাচ্ছেন, তিনি তাই করছেন। এভাবে নিত্য স্বকর্ম পালনের মধ্য দিয়ে
ধর্মব্যাধ ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন।
কর্মযোগ একদিকে কর্মযোগীকে দেয় মুক্তি, অপরদিকে জগৎকে
দেয় কল্যাণ। তাই কর্মযোগীর কর্ম হয় নিঃস্বার্থ । বিশ্ব কর্মযজ্ঞে কিছু কর্ম করার
সুযোগ পেয়ে কর্মযোগী নিজেকে ধন্য মনে করেন।
জগতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত উপনিষদে নীতিজ্ঞানের
বহু মূল্যবান উপদেশ দেখা যায়। যেমন, বেদ - অধ্যাপনান্তে আচার্য শিষ্যকে বেদের
শিক্ষা বিষয়ক উপদেশ দান করেন- ‘সত্য কথা
বলবে । ধর্মানুষ্ঠান করবে। অধ্যয়নে উদাসীন হবে না। মাতাকে দেবতা জ্ঞান করবে।
পিতাকে দেবতা জ্ঞান করবে। আচার্যকে দেবতা জ্ঞান করবে। শ্রদ্ধার সাথে দান করবে।
অশ্রদ্ধার সাথে দান করবে না । সত্য হতে বিচ্যুত হবে না। কল্যাণজনক কাজে অমনোযোগী
হবে না। সম্পদ বৃদ্ধি বিষয়ে অনাগ্রহী থাকবে না। অতিথিকে দেবতার ন্যায় সেবা করবে।
ঐশ্বর্য্যের অনুরূপ অর্থাৎ সামর্থ্য অনুসারে দান করতে হয়। বিনয়ের সাথে দান করা
উচিত। প্রীতির সাথে দান করা উচিত ।
এটাই আদেশ, এটাই উপদেশ, এটাই বেদের রহস্য আর এটাই
ঈশ্বরাজ্ঞা। এভাবে সমস্ত অনুষ্ঠান করবে আর এ প্রকারেই সব আচরণ করবে। আধ্যাত্মিক,
আধিভৌতিক , আধিদৈবিক শান্তি বর্ষিত হোক তোমার জীবনে’। (তৈঃ উঃ ১/১১/৩)
আচার্যের নিকট থেকে প্রাপ্ত এসব উপদেশ সুষ্ঠুভাবে
প্রতিপালন করলে শিষ্যের পরম কল্যাণ সাধিত হয়। মানুষ ইহ জীবনে শান্তিতে সংসার ধর্ম
প্রতিপালন করতে সক্ষম হয়।
নৈতিক মূল্যবোধে পরিপুষ্ট ও উজ্জীবিত শিষ্যের প্রার্থনাও
উল্লেখ করার মতো যা আজকের দুনিয়ায় অত্যাবশ্যক।
ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ
ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্ত্ত,
মা বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ
শান্তিঃ ।। তৈঃ উঃ ২/১/১
(ব্রহ্ম) আমাদের ( গুরু ও শিষ্য ) উভয়কে সমভাবে রক্ষা
করুন; বিদ্যার সুফল প্রকাশ করে আমাদের
উভয়কে পালন করুন। আমরা যেন সমান সামর্থ্যবান হই; অধীত বিদ্যা যেন আমাদের উভয়ের
জীবনেই তুল্যভাবে তেজোদৃপ্ত হয়; আমরা
পরস্পরকে যেন বিদ্বেষ না করি । আমাদের আধ্যাত্মিক (শারীরিক ও মানসিক রোগাদি),
আধিভৌতিক (হিংস্র প্রাণি প্রভৃতি-কৃত হিংসাদি) ও আদিদৈবিক (দৈব, প্রাকৃতিক
দুর্ঘটনা) শান্তি হোক।
শিক্ষার্থী অনুরূপ প্রার্থনা অন্তরে লালন করলে শিক্ষা সার্থক
বলে গণ্য হবে।
আমরা এখানে প্রীতি, সেবা, মানবতাবোধ, মহানুভবতা, সৎসাহস,
দেশপ্রেম, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে
আলোচনা করছি।
ক) প্রীতি
প্রীতি একটি মহৎ গুণ। প্রীতি বলতে সন্তোষ, তৃপ্তি,
অনুরাগ, বন্ধুত্ব প্রভৃতি বোঝায়। প্রীতি জীবনকে সুন্দর ও সহনীয় করে এবং
সমাজকে শান্তিময় করে তোলে। স্নেহ, ভক্তি ও
প্রীতি মূলত অনুরাগ বা প্রাণের টানকে বোঝায় । এই প্রীতি যখন ছোটদের প্রতি দেখানো
হয়, তখন তাকে বলে স্নেহ। আবার যখন গুরুজন বা ঈশ্বরের প্রতি দেখানো হয়, তখন তাকে
বলে ভক্তি।
বন্ধু স্থানীয় এবং বন্ধুদের প্রতি প্রাণের টানকে সাধারণত
প্রীতি বলা হয়।
প্রীতি জাগ্রত হলে মানুষ আর স্বার্থপর হতে পারে না। তখন
অপরের দুঃখ দূর করাতেই তাঁর আনন্দ, তাঁর তৃপ্তি। প্রীতিপূর্ণ হৃদয় সর্বাবস্থায়
সন্তুষ্ট থাকে। হাসিমুখে তিনি জীবনের সকল দুঃখ সহ্য করেন। প্রীতির কারণে বন্ধুর দুঃখ
নিজের দুঃখ বলে মনে হয়। তা দূর করার জন্য প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়। জীবের মধ্যে ঈশ্বরের
অধিষ্ঠান। তাই জীবের প্রতি প্রীতিপূর্ণ আচরণ করলে, ঈশ্বরের প্রতিই প্রীতিপূর্ণ
আচরণ করা হয়। ঈশ্বর তাতে সন্তুষ্ট হন।
প্রীতি একটি সুকুমার প্রবৃত্তি এবং ধর্মের একটি প্রধান
অঙ্গ। সহপাঠী শ্রীদামের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অসাধারণ প্রীতি ছিল, শ্রীমদভাগবত থেকে সেই উপাখ্যানটি এখন আমরা
জানব।
শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুপ্রীতি
যখনকার কথা বলছি, শ্রীকৃষ্ণ তখন কংসকে বধ করেছেন।
মথুরাবাসী অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। ভক্তরা সানন্দচিত্তে হরিগুণ
কীর্তন করছেন।
শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের অনুরোধে নন্দরাজ ব্রজধামে ফিরে
গেলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম তখন নবরূপে নতুন লীলা করতে তৎপর হলেন। কংসের পিতা
উগ্রসেনকে মথুরার সিংহাসনে বসালেন। তারপর বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাঁরা দু’জনে
সান্দীপনি মুনির আশ্রমে গেলেন। সেখানে যে সকল সহপাঠী তাঁরা পেয়েছিলেন, শ্রীদাম
ছিলেন তাঁদের একজন। শ্রীদামকে আদর করে অনেকে সুদামা বলেও ডাকে।
বিদ্যাশিক্ষা শেষ হলো । সহপাঠীরা যে যাঁর গৃহে ফিরে
গেলেন। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার রাজা আর শ্রীদাম দরিদ্র
গৃহস্থ। শ্রীদাম ছিলেন ধার্মিক ব্রাহ্মণ । তিনি ধর্মকর্ম এবং বিদ্যাচর্চায় দিন
কাটাতেন। কোনদিন আহার জুটতো, কোনদিন জুটতো না। তাঁর স্ত্রীও মলিন বসনে অনাহারে
অর্ধাহারে দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতেন।
একদিন শ্রীদামকে তাঁর স্ত্রী বললেন,
-
শুনছ?
আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিনা । আমার শরীর কাঁপছে। অনাহারে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি।
দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ তোমার বন্ধু। একসাথে একই গুরুর পাঠশালায় পাঠ গ্রহণ করেছ।
-
তা
করেছি, কিন্তু সে কথা কেন?
-
শ্রীকৃষ্ণের
প্রীতির কথা, দয়ার কথা আমি শুনেছি। তিনি দাতারূপেও বিখ্যাত। তাঁর কাছ থেকে কেউ
খালি হাতে ফিরে আসে না।
-
কিন্তু
আমি যাব বন্ধুর কাছে ভিক্ষা করতে ?
-
শুধু
বন্ধুর কাছে কেন, তুমি যাবে একজন দানবীর রাজার কাছে।
অনেক ভাবলেন শ্রীদাম। যাবেন কি যাবেন না। শেষে
ঠিক করলেন, আর কিছু হোক আর না হোক, শ্রীকৃষ্ণ দর্শন তো হবে। কিন্তু খালি হাতে তো
বন্ধুর বাড়ি যাওয়া যায় না। এদিকে ঘরে যে কিছুই নেই । তখন ব্রাহ্মণী প্রতিবেশীদের
কাছ থেকে চার মুঠো চিড়ে চেয়ে আনলেন। তারপর পুরান কাপড়ের মধ্যে সেই চিড়ে বেঁধে
দিলেন। শ্রীদাম পৌঁছলেন দ্বারকায়। অনেক মহল পার হয়ে পৌঁছলেন শ্রীকৃষ্ণের মহলের
কাছে। প্রবেশ করলেন শ্রীকৃষ্ণের কক্ষে ।
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামকে দেখলেন দূর থেকে। তাড়াতড়ি ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন শ্রীদামকে।
একজন দ্বারকার রাজা, পরনে রাজার পোশাক , আরেকজন
দরিদ্র ব্রাহ্মণ, ছেঁড়া ময়লা তাঁর কাপড়-চোপড়। দু’জনে অনেকদিন পর দু’জনকে দেখে
আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামকে নিজ পালঙ্কে বসিয়ে নিজের হাতে
তাঁর পা ধুইয়ে দিলেন। আপ্যায়নে পরিতুষ্ট করলেন বন্ধুকে। তারপর দু’জনে কত কথা !
-
শ্রীকৃষ্ণ
বললেন,
শ্রীদাম, মনে আছে, গুরুপত্নীর কথায় একদিন কাঠ
আনতে বনে গিয়েছিলাম । দু’জনে বনের মধ্যে ঝড়বৃষ্টিতে কত কষ্ট পেয়েছিলাম। পরের দিন
গুরু সান্দীপনি আমাদের খুঁজে বের করেছিলেন।
-
মনে
আছে, সব মনে আছে ।
শ্রীদাম তো দারুণভাবে আপ্যায়িত হলেন। কিন্তু
তিনিতো এনেছেন চার মুঠো চিড়ে। সেই চিড়ে বের করবেন কী করে? দারুণ লজ্জায় পড়লেন
তিনি। শ্রীকৃষ্ণের কাছে কিছুই অজানা থাকে না । তিনি নিজে সেই চিড়ে কেড়ে নিয়ে মনের
আনন্দে এক মুঠো খেয়ে নিলেন।
শ্রীদামের রাত কাটলো আনন্দে ।
কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, তার কিছুই
হলো না । কিছুই চাইতে পারলেন না তিনি। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিলেন। আর
লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে খানিকটা হেসে নিলেন।
একি! শ্রীদামের কুঁড়েঘর যেখানে ছিল, সেখানে উঠেছে
প্রাসাদ । প্রাসাদের সামনে উদ্যান। সুন্দর সরোবর, সেখানে পদ্ম আর শাপলার মেলা ।
সুগন্ধে আমোদিত চারদিক।
এগিয়ে এলেন শ্রীদামের স্ত্রী । আনন্দে তাঁর চোখে
দেখা দিল অশ্রু। না চেয়েও শ্রীদাম ও তাঁর স্ত্রী পেলেন প্রচুর ধন সম্পদ।
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ এভাবে স্থাপন করলেন বন্ধু প্রীতির এক উজ্জ্বল আদর্শ।
খ) সেবা
সেবা কথাটির নানা রকম অর্থ হয়। সেবা বলতে বোঝায়
পরিচর্যা, যেমন - অতিথি সেবা, জীবসেবা । সেবা মানে শুশ্রূষা, যেমন - রোগীর সেবা ।
সেবার একটি অর্থ- উপাসনা, যেমন- ঠাকুর সেবা । এক কথায় অপরের সন্তোষ বিধানের জন্য
যে কল্যাণকর কাজ করা হয় তাকেই বলা হয় সেবা । কাউকে কোন কিছু দান করেও সেবা করা
যায়। তবে দান আর সেবা পুরোপুরি এক নয়। দানের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু দিতে হয়।
কিন্তু দ্রব্য সামগ্রী না দিয়েও কেবল শরীর ও মন দিয়ে সেবা করা যায়। বুদ্ধি দিয়ে,
পরামর্শ দিয়ে, সহানুভূতি জানিয়ে, বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে, নানা ভাবে সেবা করা যায়।
ঈশ্বর জীবের আত্মারূপে জীবের মধ্যে বাস করেন। তাই জীবের
সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা হয় । মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এরা সবাই জীব। এদের সেবাও
জীব সেবা। উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, তাই ব্যাপক অর্থে এরাও জীব। এদের সেবাও জীব সেবা।
জীবকে সেবা করার প্রেরণার পশ্চাতে রয়েছে ঈশ্বরের
সর্বাত্মক অনুভূতি। ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বর বিদ্যমান। উপনিষদের
যুগে বলা হয়েছে, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্মঃ’- সব কিছুই ব্রহ্ম। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ
বলেছেন, ‘ঈশ্বরঃসর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি’ - হে অর্জুন , ঈশ্বর সকল
প্রাণীর হৃদয়ে অবস্থিত । জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা। সুতরাং ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে
জীবকে সেবা করতে হবে; জীবকে ভালোবাসতে হবে।
ঈশ্বর আত্মারূপে সব জীবের মধ্যেই আছেন, আর সেই ঈশ্বর
সবার সেব্য । এই বোধ যখন জন্মে, তখন অপরের অনুভূতির সঙ্গে নিজের অনুভূতি এক হয়ে
যায়। এ অবস্থায় মানুষ প্রতিটি জীবের আনন্দ বেদনাকে নিজের আনন্দ বেদনা বলে অনুভব
করে। ফলে অপরের দুঃখ বেদনাকে নিজের দুঃখ বেদনার ন্যায় দূর করতে প্রয়াসী হয়। তখন সে
নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পরের সেবায় উৎসর্গ করতে
দ্বিধাবোধ করে না। এমন এক আদর্শ জীব সেবার দৃষ্টান্ত রয়েছে সিদ্ধার্থ ও দেবদত্তের
কাহিনীর মধ্যে।
সিদ্ধার্থ হলো গৌতম বুদ্ধের বাল্য নাম। ছেলেবেলা থেকেই
তাঁর হৃদয় ছিল করুণায় ভরা । পশু, পাখি, মানুষ সবার দুঃখেই তাঁর হৃদয় কেঁদে ওঠে।
কারও দুঃখ কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না ।
এক দিন বিকেল বেলা বালক সিদ্ধার্থ বাগানে বসে আছেন। এমন
সময় তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়লো একটি হাঁস।
হাঁসটির গায়ে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে রয়েছে। আর সে ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।
এ দৃশ্য দেখে সিদ্ধার্থের হৃদয় করুণায় গলে গেল। তিনি সস্নেহে হাঁসটির দেহ থেকে তীরটি
খুলে ফেললেন এবং গভীর সহানুভূতির সাথে হাঁসটির শুশ্রূষা করতে লাগলেন।
তখন সেখানে দৌঁড়ে এসে উপস্থিত হলেন সিদ্ধার্থের খেলার
সাথী দেবদত্ত। তিনি বললেন, ‘‘সিদ্ধার্থ, হাঁসটি আমি তীরবিদ্ধ করেছি; হাঁসটি আমার ।
তুমি এটি আমায় দিয়ে দাও।’’
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘‘না দেবদত্ত, সেটি হয় না । আমি হাঁসটি
তোমার হাতে দিতে পারি না।’’
দেবদত্ত বললেন- ‘কেন দিতে পার না? এ হাঁসটি তো তোমার নয়।
এটি বুনো হাঁস । আমি এটিকে তীরবিদ্ধ করেছি; হাঁসটি এখন আমার । আমাকে এটি দিয়ে
দাও।’’
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘‘দেবদত্ত, তুমি এ কী বলছো? তোমার কি
সুখ দুঃখের অনুভূতি নেই? তোমাকে আঘাত করলে তুমি যেমন ব্যথা বোধ কর, এ হাঁসটিও
তেমনি তোমার শরে আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে; এখন আমাদের উচিত এর কষ্ট দূর করার ব্যবস্থা
করা।’’
দেবদত্ত এবার রেগে বলে উঠলেন, ‘‘সিদ্ধার্থ, তোমাকে আবার বলছি, হাঁসটি আমাকে দিয়ে দাও।’’
ধীর শান্তভাবে সিদ্ধার্থ বললেন, ‘‘দেবদত্ত, তুমি রেগে
যাচ্ছ কেন? নিজের দুঃখ চিন্তা করে পরের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করো। হাঁসটিরও তো তোমার
আমার মতো সুখ দুঃখের অনুভূতি আছে, আছে প্রাণের প্রতি ভালোবাসা। আর জেনে রাখ, জীবন
নাশ করার চেয়ে জীবন রক্ষা করা অনেক বড় কাজ । সুতরাং হাঁসটি আমি তোমার হাতে মৃত্যুর
মুখে দিতে পারি না; এর পরিবর্তে তুমি যা চাইবে তাই তোমাকে দেব; তবু হাঁসটি আমি
ছাড়ব না।’’
আহত হাঁসটি রক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধার্থের দৃঢ়সংকল্প দেখে
দেবদত্ত স্তম্ভিত হলেন। জীবের প্রতি সিদ্ধার্থের করুণা তাঁর হৃদয়কেও স্পর্শ করল।
সিদ্ধার্থ হাঁসটিকে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দিলেন।
গ) মানবতাবোধ
মানবতা মানুষের একটি গুণ বা ধর্ম। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে
বাস করে । অপরের দুঃখে তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। বিপদাপন্নের পাশে দাঁড়ায়, আর্তের সেবা
করে। মানুষের প্রতি মানুষের এই যে ভালোবাসা বা মমতা, এরই নাম মানবতা আর যে বোধে
উদ্দীপ্ত হয়ে মানুষ এ সব করে, তার নাম মানবতাবোধ। ভগবান আত্মারূপে মানুষের মধ্যে
বিরাজ করেন। তাই মানুষকে ভালোবাসা মানে ভগবানকে ভালোবাসা । সুতরাং মানবতাবোধ
ধর্মের অঙ্গ।
মানবতাবোধ সম্পর্কে আমরা একটি পৌরাণিক উপাখ্যান জানব।
রন্তিদেবের মানবতাবোধ
অনেক অনেককাল আগে এক দেশে এক রাজা ছিলেন। নাম তার রন্তিদেব।
তিনি শুধু রাজা ছিলেন না, ছিলেন রাজার রাজা মহারাজা। সম্রাট। কিন্তু সম্রাট হয়েও রন্তিদেব
পার্থিব বিষয়ের প্রতি আসক্ত নন। শ্রীকৃষ্ণের চরণকেই তিনি একমাত্র সম্পদ বলে জ্ঞান
করেন। শ্রীকৃষ্ণে সবকিছু সমর্পণ করে তিনি নিলেন অযাজক বৃত্তি। অযাজক বৃত্তি হচ্ছে,
ভিক্ষা চাওয়া যাবে না, লোকে ইচ্ছে করে যা দেবে, তাই দিয়েই দিন যাপন করতে হবে।
একবার রাজা রন্তিদেবের আটচল্লিশ দিন একনাগাড়ে অনাহারে
কাটছে । তিনিও খেতে চান নি, কেউ ইচ্ছে
করে কিছু দেয় নি। ঊনপঞ্চাশ দিনের দিন এক
ভক্ত তাঁকে অন্ন আর পায়েস দিয়ে গেলেন। এবার তাঁর উপবাস ভঙ্গ হবে। হঠাৎ তাঁর সামনে
যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল একটি লোক। খেটে- খাওয়া, জীর্ণ চেহারা সাথে আবার একটা পোষা
কুকুর। ‘ক’দিন ধরে কিছুই খেতে পাইনি, দয়া করে আমাকে কিছু খেতে দিন। আমার কুকুরটাও
না খেয়ে আছে।’ বলল লোকটা। ক্ষুধার্ত লোকটির করুণ অবস্থা দেখে রাজা রন্তিদেবের চোখে জল এলো। কুকুরটি ক্ষুধায় ধুঁকছিল। তিনি যে
অন্ন আর পায়েস ভিক্ষা পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই লোকটিকে আর তার কুকুরটিকে দিয়ে
দিলেন।
‘পেট ভরল না।’ -লোকটি জানাল।
হাত জোড় করে জানালেন রাজা রন্তিদেব, ‘আর তো কিছু নেই,
ভাই।’
এরই নাম মানবতাবোধ ।
গভীর মমতাবোধ থাকলে আটচল্লিশ দিন না খেয়ে থাকার পরেও
খাদ্য নিজে না খেয়ে অন্যকে বিলিয়ে দেওয়া যায়। হঠাৎ আরও অবাক করা একটি ঘটনা ঘটল ।
রাজা রন্তিদেব দেখেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ক্ষুধার্ত
লোকের রূপ ধরে এসে ভগবান পরীক্ষা করেছিলেন, রাজা রন্তিদেবের মানবতাবোধ কতটুকু। সে
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রাজা রন্তিদেব।
ঘ) মহানুভবতা
মানুষের মনে সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি, ভালো ও মন্দ দুইই আছে। তেমনি আছে সংকীর্ণতা ও
মহানুভবতা । মহানুভবতার অর্থ হলো অনুভবের মহত্ব বা বিরাটত্ব-উদারচিত্ততা ।
‘উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্ ।’ যিনি উদার চরিত্রের অধিকারী বা মহানুভব ,
সমস্ত বিশ্বই তাঁর আত্মীয়। যিনি সকল হীনতা, নীচতা, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা,
অহংকার, ক্রোধ, ঈর্ষা ও গ্লানির ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করতে পারেন, তিনিই মহানুভব।
তাঁর এই গুণই মহানুভবতা। মহানুভবতা ধার্মিকেরও লক্ষণ। মহানুভবতা জীবকে ভালোবাসতে
অনুপ্রাণিত করে। আত্মাকে উন্নত করে এবং সত্যিকারের ভগবদ্ভক্তে পরিণত করে।
মহানুভবতা সম্পর্কে একটি পৌরাণিক উপাখ্যান আমরা জানব।
বশিষ্ঠের মহানুভবতা
পুরাকালে বশিষ্ঠ নামে এক ঋষি ছিলেন । ব্রহ্মর্ষি ছিলেন
তিনি। ব্রহ্মর্ষি মানে ব্রাহ্মণ ঋষি। একই
সময়ে আরেক জন রাজা ক্ষত্রিয় হয়েও সাধনার
গুণে ঋষিত্ব লাভ করেন। সেই রাজর্ষির নাম বিশ্বামিত্র। বিশ্বামিত্র কিন্তু রাজর্ষি
হয়েও সন্তুষ্ট নন। তিনি ব্রহ্মর্ষি হতে চান । তার জন্যে স্বীকৃতি চাই। সূর্যবংশের
কুলগুরু বশিষ্ঠ যদি বিশ্বামিত্রকে স্বীকার করেন ব্রহ্মর্ষি বলে, তাহলে সকলেই অম্লান
বদনে তাঁকে ব্রহ্মর্ষি বলে মেনে নেবে। কিন্তু ব্রহ্মর্ষি হওয়ার মতো গুণাবলি তখনও
বিশ্বামিত্র অর্জন করেন নি বলে বশিষ্ঠ তাঁকে ব্রহ্মর্ষি বলে মেনে নিলেন না।
ক্রোধে ও অহংকারে ফেটে পড়লেন বিশ্বামিত্র । তিনি
মন্ত্রবলে এক রাজাকে রাক্ষস করে দিলেন। তাকে বললেন,
-
‘তুমি
যাও । গিয়ে বশিষ্ঠের একশ পুত্রকে ভক্ষণ করো।’
রাক্ষস
বিশ্বামিত্রের কথা শুনে তখনি দৌড়াল। একটি একটি করে ভক্ষণ করল বশিষ্ঠের একশ
পুত্রকে।
এতেও বশিষ্ঠকে টলানো গেল
না। তিনি বিশ্বামিত্রকে কিছুই বললেন না। পাল্টা অভিশাপ দিলেন না। কোন শাস্তির
ব্যবস্থাও করলেন না। এদিকে বিশ্বামিত্র ঠিক করলেন, বশিষ্ঠ যদি তাঁকে ব্রহ্মর্ষি
বলে স্বীকার না করেন, তাহলে তিনি তাঁকে হত্যা করবেন। তিনি একদিন গিয়ে লুকিয়ে রইলেন
বশিষ্ঠ যে ঘরে থাকেন, তার পেছনে ।
বশিষ্ঠের স্ত্রী
অরুন্ধতী।
অরুন্ধতী জানালেন, ঘরে
লবণ নেই।
বশিষ্ঠ তখন অরুন্ধতীকে
বললেন,
-যাও , বিশ্বামিত্রের
কাছ থেকে কিছু লবণ নিয়ে এসো।
-বিশ্বামিত্রের কাছ থেকে
। আশ্চর্য হলেন অরুন্ধতী।
-যে আমাদের শত পুত্রের
মৃত্যুর কারণ, তুমি আমাকে তার কাছে পাঠাতে চাইছো , তুচ্ছ লবণের জন্যে?
বশিষ্ঠ বললেন-
- আমি যে বিশ্বামিত্রকে
ভালোবাসি। ও পুরোপুরি ব্রহ্মর্ষির যোগ্য হয়নি । তবে হবে। তখন ওকে ব্রহ্মর্ষি বলে
স্বীকার করব। ও আরও সাধনা করুক। আমি তাই চাই ।
আড়াল থেকে এ কথা শুনলেন বিশ্বামিত্র।
তিনি তখন ছুটে গিয়ে
বশিষ্ঠের পায়ে পড়লেন।
বললেন,
-আপনি সত্যি মহানুভব।
আমি অতি ক্ষুদ্র। আমি ব্রহ্মর্ষি হতে চাই নে। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন
বিশ্বামিত্রকে হাত ধরে তুলে বশিষ্ঠ বললেন,
ওরে, আজ তুই অহংকার আর
ক্রোধ ত্যাগ করেছিস। আমি তোকে আর্শীবাদ করছি। আজ থেকে তুই ব্রহ্মর্ষি হলি। স্তম্ভিত
হলেন বিশ্বামিত্র।
হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে
পেলেন তিনি। আরেকবার বশিষ্ঠের পায়ে পড়লেন। বশিষ্ঠ পরম স্নেহে বিশ্বামিত্রকে বুকে
জড়িয়ে ধরলেন।
ঙ) সৎসাহস
‘সাহস’ শব্দটির মানে হচ্ছে ভয়শূন্যতা, নির্ভীকতা।
বিপজ্জনক কাজে উদ্যমের নামও সাহস। এই সাহস ভালো বা সৎ কাজে অথবা মন্দ বা অসৎ কাজে
উভয় ক্ষেত্রেই দেখানো যেতে পারে। তবে সৎ বা মঙ্গলজনক কাজে যে সাহস দেখানো হয়, তাকে
বলা হয় সৎসাহস ।
যখন কেউ দুর্বলের উপর অত্যাচার করেন, তখন সৎসাহস
নিয়ে দুর্বলের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত।
শরণাগতকে তাড়নাকারীর হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও অনেক সময় সৎ সাহসের প্রয়োজন
হয়।
ধর্মযুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। যুদ্ধক্ষেত্রে সৎসাহস
দেখানো বীরের কর্তব্য । মহাভারত থেকে এই রকম এক বীরের সৎসাহসের কাহিনী আমরা জানব।
অভিমন্যুর সৎসাহস
অনেক অনেককাল আগের কথা।
সে এক ভীষণ যুদ্ধ।
যেমন বড়, তেমনি দুঃখময়। যুদ্ধ তো সব সময়েই
দুঃখময়। তবু এ যুদ্ধের দুঃখ আরও বেশি, এ যুদ্ধ ভাইয়ে ভাইয়ে।
তাই দু’ পক্ষে ভাগ হয়ে যারা যুদ্ধ করছিল, তাদের
মধ্যে ছিল দু’ পক্ষেরই আত্মীয়-স্বজন।
হস্তিনাপুর নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে কুরুবংশের
রাজারা রাজত্ব করতেন। বিচিত্রবীর্য নামে এই রাজবংশের এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল দুই
ছেলে, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু । ধৃতরাষ্ট্র বড় এবং পাণ্ডু ছোট। কিন্তু বড় হলে কী
হবে, তিনি জন্ম হতে অন্ধ। জন্মান্ধ বলেই রাজার বড় ছেলে পরবর্তী রাজা হবেন- এই
প্রচলিত নিয়ম মানা গেল না, ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারলেন না। রাজা হলেন পাণ্ডু।
ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী , তাঁদের হলো একশত
পুত্র । দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ ইত্যাদি। আর একটি মেয়ে, তার নাম দুঃশলা।
পাণ্ডুর দুই স্ত্রী । কুন্তী ও মাদ্রী। কুন্তীর
তিনটি ও মাদ্রীর দুটি ছেলে হয়। কুন্তীর ছেলেদের নাম যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং
মাদ্রীর ছেলেদের নাম নকুল ও সহদেব। কুরুবংশের নামানুসারে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের বলা
হতো কৌরব। পাণ্ডুর ছেলেরাও কৌরবই। কিন্তু পাণ্ডুর নামানুসারে তাঁদেরকে বলা হতো পাণ্ডব।
পাঁচজন বলে একত্রে বলা হতো পঞ্চপাণ্ডব। এই
কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে রাজ্যের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দু’পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। আত্মীয়-স্বজনরা
দু’দলে ভাগ হয়ে গেল। কেউ গেল পাণ্ডবদের দলে, কেউ গেল কৌরবদের দলে। কুরুক্ষেত্র নামক
বিশাল প্রান্তর শিবিরে শিবিরে ছেয়ে গেল। হিরন্বতী নদী বইছে কুরুক্ষেত্রের ভিতর
দিয়ে। সেখানেই সৈন্য সাজাতে লাগলেন যুধিষ্ঠির । দুর্যোধনের সৈন্যরাও তার সামনে
শিবির প্রস্ত্তত করল। সকল আয়োজন শেষ হলো। দুর্যোধন পিতামহ ভীষ্মকে সেনাপতি করলেন।
পিতামহ ভীষ্ম ও অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য কৌরবদের
পক্ষেই যোগ দিলেন। তাছাড়া অঙ্গদেশের রাজা মহাবীর কর্ণও রইলেন কৌরবদের পক্ষে ।
দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এক অর্বুদ দশ কোটি সৈন্য দিলেন দুর্যোধনকে। নিজে
অস্ত্র না ধরে তিনি অর্জুনের রথের সারথী হলেন।
এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে অর্জুন যুদ্ধ করছেন এক
বিশাল সেনাদলের সঙ্গে। কৌরব পক্ষ তাঁদের সাথে পারছে না।
তখন দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের সাথে পরামর্শ করতে
বসলেন। ঠিক হলো , দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করে যুদ্ধ করবেন। ‘ব্যূহ’ হচ্ছে যুদ্ধের
সময় সৈন্য সাজানোর কৌশল বিশেষ । চক্রব্যূহ মানে চক্রাকার বা গোলাকার ব্যূহ। এতে
চক্রাকারে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়। এতে প্রবেশের একটি মাত্র পথ থাকে এবং আটটি কুণ্ডলাকৃতি
সারি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়। চক্রবূহ্য ভেদ করা খুব কঠিন। ভীম, সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন
প্রভৃতি পাণ্ডব পক্ষের বড় বড় বীর সেই ব্যূহ ভেদ করতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির শঙ্কিত
হলেন। অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন এবং
অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু ছাড়া আর কেউ চক্রব্যূহ
ভেদ করতে সক্ষম নন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করবেন না, তিনি শুধু সারথির কাজ করবেন। অর্জুন অন্যত্র
যুদ্ধে ব্যস্ত। এ সময়ে একমাত্র ভরসা অভিমন্যু।
কিন্তু অভিমন্যু মাত্র চৌদ্দ বছরের বালক। তাছাড়া
তিনি চক্রব্যূহ ভেদ করে প্রবেশের কৌশল জানেন,
কিন্তু বেরিয়ে আসার কৌশল জানেন না। আবার একজন কেউ এগিয়ে না গেলে অসম্মানিত
হতে হয়। মেনে নিতে হয় পরাজয়ের গ্লানি। তাই যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে বললেন, তুমি যাও।
চক্রব্যূহ ভেদ করো। আমরা সৈন্য দল নিয়ে তোমার সহায়তায় থাকব এবং তোমাকে বের করে
আনব।
অভিমন্যু
সানন্দে সম্মত হলেন। বললেন, ‘আর্য, মঙ্গলকর বিপজ্জনক কাজে সাহস দেখানোই সৎসাহস।
আমি যাব। দ্রোণাচার্যের ভয়ঙ্কর সৈন্য সাগরে আমি অবগাহন করব।’
শত্রুব্যূহে প্রবেশ করে অভিমন্যু বৃষ্টির মতো
শরবর্ষণে বিপক্ষীয় বিপুলসংখ্যক সৈন্যকে হত্যা করলেন। দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতি বড় বড় বীর তার কাছে
পরাজিত হলেন। নিহত হলেন মহাবীর শল্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণসহ কৌরবদের
অনেক মহাবীর । তখন নিরুপায় হয়ে দ্রোণ, কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, শকুনি, অশ্বথ্থামা
ও দুর্যোধন- এই সাত জন রথী একসাথে চৌদ্দ বছরের বালক অভিমন্যুর সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন।
তাঁরাও সাতবার পরাজিত হলেন। অষ্টমবারে সপ্তরথী চারদিক থেকে অভিমন্যুকে আক্রমণ
করলেন। মিলিত আক্রমণে অস্ত্রহীন, রথহীন হয়ে অভিমন্যু শুধু রথের চাকা দিয়েই যুদ্ধ
করতে লাগলেন। অবশেষে চক্রব্যূহে যুদ্ধ করতে করতে অকুন্ঠচিত্তে প্রাণ বিসর্জন দিলেন
বীর অভিমন্যু। প্রাণ রইল না, কিন্তু রইল
তাঁর সৎসাহস আর বীরত্বের খ্যাতি-স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল মহাভারতের পাতায়
তাঁর নাম ।
চ)
দেশপ্রেম
দেশের প্রতি ভালবাসাকে বলা হয় দেশপ্রেম । নিজের দেশের
প্রতি মানুষের প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকে, থাকে মমত্ববোধ। স্বদেশের প্রতি এই ভালোবাসা ও
মমত্ববোধই দেশপ্রেম। দেশপ্রেমও ধর্মের অঙ্গ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
‘জননী
জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’
অর্থাৎ মা ও মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও বড়। সুগভীর
দেশপ্রেমের আবেগে কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয়-
‘ও আমার দেশের
মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’
এই দেশপ্রেম
প্রকাশ পায় কীভাবে? প্রকাশ পায় আমাদের কাজে, আচরণে। দেশ যদি শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত
হয়, তখন গভীর দেশপ্রেমের আবেগে দেশপ্রেমিকেরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়েন। শান্তির সময়ে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করে যান। কর্মেই ধর্মের পরিচয়। দেশের
জন্যে কঠোর পরিশ্রমে ও আত্মত্যাগে দেশপ্রেম প্রকাশ পায়। দেশের জন্যে ধর্মযুদ্ধে
যদি কেউ প্রাণ ত্যাগ করেন, তাহলে সেই দেশপ্রেমিক অক্ষয় স্বর্গ লাভ করেন।
প্রাচীনকালেও অনেকে এমন দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত রেখে অমর হয়ে আছেন। রামায়ণ থেকে এমনি
একজন দেশপ্রেমিক রাজার কাহিনী আমরা জানব।
কার্তবীর্যার্জুনের দেশপ্রেম
চন্দ্রবংশীয়
পরাক্রমশালী এক রাজা ছিলেন। তাঁর নাম কার্তবীর্যার্জুন। সহস্রবাহু ছিল তাঁর। একবার
তিনি রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করার জন্য অবকাশ যাপন করছিলেন। এই সময়ে লঙ্কার রাজা
রাবণ এসে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলেন । এ সময়ে ঐ রাজ্যের এক সেনানায়কের সাথে দেখা হলে
রাবণ বললেন-
আমি
কার্তবীর্যার্জুনের রাজ্য অধিকার করে নেব।
কার্তবীর্যার্জুনের
ঐ সেনানায়ক এ কথা শুনে খুব রেগে গেলেন। তিনি বললেন-
মহারাজ
কার্তবীর্যার্জুন অবকাশ যাপন করছেন। আপনি এ সময়টাই বেছে নিলেন। কুড়িখানা হাত বলে
আপনার বুঝি খুব অহঙ্কার হয়েছে? মহারাজের হাতে পড়লে আপনার দশ মুণ্ড চূর্ণ হয়ে যাবে।
সেনানায়কের
কথা শুনে রাবণ তার সাথেই যুদ্ধ আরম্ভ করে দিলেন। সংবাদ পৌঁছানো হলো মহারাজ কার্তবীর্যার্জুনের কাছে। শুনে
মহারাজ ক্রোধে আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন।
-কি, আমার
রাজ্য আক্রান্ত। দেশমাতৃকা আমার শত্রুর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে বিপর্যস্ত। আমি এক্ষুনি
যুদ্ধ করতে যাব। এই বলে রাজা কার্তবীর্যার্জুন সোজা যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেলেন।
দারুণ যুদ্ধ
হলো দু’পক্ষে।
এক পক্ষ আক্রমণকারী
আরেক পক্ষ আক্রান্ত
। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ।
পরাজিত হলে
দেশ হবে পরাধীন। তাই তারা কার্তবীর্যার্জুনের নেতৃত্বে প্রাণপণ যুদ্ধ করল। অবশেষে
জয় হলো কার্তবীর্যার্জুনের। পরাজিত ও বন্দী হলেন রাবণ। স্বর্গেও এই বার্তা রটে
গেল। রাবণ বন্দী । রাবণ বন্দী ! কথাটা কানে গেল মহামুনি পুলস্ত্যের । তিনি তখন
স্বর্গলোকে থাকেন। সম্পর্কে রাবণ তাঁর নাতি। তাই তাঁর খুব দুঃখ হলো।
তিনি তখনই
রওনা হলেন, নেমে এলেন কার্তবীর্যার্জুনের রাজসভায়। মহামুনি পুলস্ত্য!
-
কি সৌভাগ্য আমার । মেঘ না চাইতেই
জলের মতো মহামুনির শুভ পর্দাপণ আমার ঘরে। মহামুনি পুলস্ত্যকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম
করলেন মহারাজ কার্তবীর্যার্জুন।
কার্তবীর্যার্জুনের
কথায় সন্তুষ্ট হয়ে পুলস্ত্য মুনি বললেন- তুমি দেবতাদের প্রিয়। ত্রিভুবন তোমার যশ
কীর্তনে মুখরিত হয়। জান তো, রাবণ সম্পর্কে আমার নাতি হয়। তাকে পরাস্ত করে তুমি
বন্দী করে কারাগারে রেখেছ। আমি তার মুক্তি চাই, বৎস।
-
রাবণ আমার রাজ্য আক্রমণ করেছিল।
আমার দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা তাকে প্রতিহত করেছে। বললেন কার্তবীর্যার্জুন।
শুনে
পুলস্ত্য বললেন-
-
তোমার গভীর দেশপ্রেম আর বীরত্বের কাছে
রাবণ পরাজিত হয়েছে।
কার্তবীর্যার্জুন
অবনত মস্তকে বললেন,
আপনি
পরম শ্রদ্ধেয় মুনি । আপনি যখন রাবণের মুক্তি চাইলেন, তখন তাকে মুক্তি দিয়ে আমি
ধন্য হতে চাই। রাবণ মুক্তি পেলেন এবং বললেন- বীরত্বের খ্যাতির মোহে পররাজ্য আক্রমণ
করি। কার্তবীর্যার্জুন, এ এক নেশা .... চুপ করে রইলেন কার্তবীর্যার্জুন। পুলস্ত্য
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে দিলেন। বললেন,
-
তোমাদের কল্যাণ হোক।
অগ্নি
সাক্ষী করে কার্তবীর্যার্জুন আর রাবণের
সাথে পুলস্তের মাধ্যমে স্থাপিত হলো মৈত্রী। দাদুরা, এবার তাহলে যাই।
-
বিদায় চাইলেন পুলস্যত্ম।
কার্তবীর্যার্জুন
আর রাবণ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে মহামুনি পুলস্ত্যকে বিদায় জানালেন।
পুলস্ত্য
চলে গেলেন স্বর্গে। রাবণ ফিরে গেলেন তাঁর
নিজের রাজ্যে। কার্তবীর্যার্জুন চেয়ে রইলেন তাদের গমন পথের দিকে।
দূরে
চোখে পড়ল শ্যামল শস্যের প্রান্তর । এই আমার রাজ্য , আমার স্বদেশ।
আনন্দে-আবেগে
ভরে উঠল মহারাজ কার্তবীর্যার্জুনের হৃদয়।
ছ) বিশ্বভ্রাতৃত্ব
ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।
তিনি সকল কিছুর নিয়ন্তা । তিনিই সৃষ্টি কর্তা । এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী, তিনিই
সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি বিস্তারের ইচ্ছায় তিনি ব্রহ্মারূপে প্রথম পুরুষ স্বায়ম্ভুব
মনু ও নারী শতরূপাকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তো মনুর সন্তান বলে আমরা মানব নামে পরিচিত। দেশ, ভাষা,
ধর্ম, বর্ণ, আচার-আচরণ ভিন্ন হলেও সবাই একই মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত। সকলেই সমান।
সকলের সমান অধিকার রয়েছে। মননশীল জীব বলে আমরা মানুষ। মনুর বংশধর বলেই আমাদের
মনুষ্য বলা হয়। সকলেই ‘অমৃতের পুত্র’ (শ্বেতাশ্ব.উপ.২/৫)। তাই বিশ্বের সবাই ভাই
ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করব। সকল দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব
বন্ধনে আবদ্ধ হব। কেউ কাউকে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, কেউ কারো অনিষ্ট করবে না, একে
অপরের উপকার করবে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম অবলম্বন করলেও সকলেরই গন্তব্য
এক।
শিবমহিম্নঃ
স্তোত্রে বলা হয়েছে-
রুচিনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং।
নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।
অর্থাৎ, হে প্রভো, বিভিন্ন পথে গিয়েও যেরূপ সকল নদী একই সমুদ্রে পতিত হয়, ভিন্ন
ভিন্ন রুচিহেতু সরল ও কুটিল প্রভৃতি নানা পথগামীদেরও তুমিই সেইরূপ- একমাত্র
গম্যস্থান।
শ্রীমদভগবদগীতাও
এই অদ্ভূত সত্যেরই পোষকতা করছে, বলছে-
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
অর্থাৎ, যে যেরূপ মত আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে
সেভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার নির্দিষ্ট পথেই
চলে থাকে।
বিভিন্ন বিশ্বাসের অনুসারীদের প্রতি গীতায় আরও বলা
হয়েছে- ‘‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু,
মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখেদুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট,
সদাসমাহিত চিত্ত, সদা সংযত স্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ় নিশ্চয় এবং মন ও বুদ্ধি
আমাতে অর্পিত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত’ (গীতা, ১২/১৩-১৪)।
তাই তো বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য বিরোধী
মতাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদের নির্দেশ-
‘‘সম্বিলিত হও, একত্রে বাক্যালাপে নিয়োজিত
হও।..........তোমাদের প্রার্থনা অভিন্ন হোক, এক হোক তোমাদের বাসনা ও উদ্দেশ্য এবং
অভিন্ন হোক তোমাদের সাফল্য। তোমাদের অভিন্ন প্রার্থনার কথা পুণরাবৃত্তি করছি এবং
অভিন্ন নৈবেদ্যের প্রস্তাব করছি। তোমাদের অভিপ্রায় অভিন্ন হোক, অভিন্ন হোক তোমাদের
হৃদয়, অভিন্ন হোক তোমাদের চিন্তা যার ফলে তোমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বাঙ্গীন
ঐক্য।’’(ঋগ্বেদ, ১০/১৮৭/২-৪)।
কোন ধর্মেই হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, নিন্দা প্রভৃতি থাকতে
পারে না। সকল ধর্মই বিশেষ বিশেষ নৈতিক মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। শুধুমাত্র
নৈতিক মূল্যই মানবজাতিকে ঐক্যের জন্য উৎসাহিত করতে পারে, মানুষের মধ্যে সংহতি
প্রকাশ করতে পারে। মানব জাতি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হতে পারে।
প্রতিষ্ঠা পেতে পারে ভ্রাতৃত্ববোধ।
এ প্রসঙ্গে
শ্রীমা সরদা দেবীর জীবনী থেকে একটি ঘটনা জানব।
আমজদ নামক এক ব্যক্তি শ্রীমা সারদা দেবীর বাড়ির দেওয়াল
প্রস্তুত করেছিল। একদিন মা তাকে বাড়ির ভেতরে নিজের ঘরের বারান্দায় খেতে দিয়েছেন;
আর তাঁর ভাইজী নলিনী দিদি উঠানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পরিবেশন করছেন।
মা তা দেখে বলে উঠলেন,
‘‘অমন করে দিলে
মানুষের কি খেয়ে সুখ হয়? তুই না পারিস, আমি দিচ্ছি।’’
নলিনীদিদি মা-কে ঐরূপ করতে দেখে, ‘‘ও পিসীমা, তোমার জাত
গেল,’’ ইত্যাদি বলে আপত্তি করতে লাগল।
মা তাকে ধমক দিলেন, ‘‘আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন
ছেলে, এই আমজদও তেমন ছেলে।’’
একজন ত্যাগী সন্ন্যাসী, অন্যজন কুখ্যাত ডাকাত।
এ ঘটনার পর থেকে
মাতা-পুত্রের নিবিড় সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। ভাল-মন্দ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মা
সকলকে আপন করে নিতেন।
তিনি বলতেন, “দোষ তো মানুষের লেগেই আছে। কি করে যে তাকে
ভাল করতে হবে, তা জানে ক’জনে।............................
যদি শান্তি চাও, কারো দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের।
জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।’’
সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জি
১. হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
(পঞ্চম শ্রেণি), প্রফেসর নিরঞ্জন অধিকারী, প্রফেসর ড. দুলাল কান্তি ভৌমিক, প্রফেসর
সুনীত কুমার ভদ্র, ড. অসীম সরকার,
এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত, ঢাকা-২০১২
২. হিন্দু ধর্ম শিক্ষা
(সি-ইন-এড প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য), নিরঞ্জন অধিকারী, ড. গোপিকারঞ্জম চক্রবর্তী,
জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা-২০০২
৩. হিন্দু ধর্ম শিক্ষা (পি
টি আই প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য), শ্রী লালমোহন চক্রবর্তী, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর,
ঢাকা-১৯৮৮
৪. চণ্ডী, অনুবাদ ও সম্পদনা স্বামী জগদীশ্বরানন্দ,
উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা-১৯৯২
৫. bn.wikipedia.org/wiki/মহাভারত
bn.wikipedia.org/wiki/রামায়ণ
৬. হিন্দুধর্শ শিক্ষা
(অষ্টম শ্রেণি), ড. পরেশ চন্দ্র মণ্ডল, ড. দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য্য, নিরঞ্জন
অধিকারী, এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত ঢাকা, পুর্ণমুদ্রণ, অক্টোবর ২০১১
৭. হিন্দুধর্ম শিক্ষা
(নবম-দশম শ্রেণি), ড. পরেশ চন্দ্র মণ্ডল, ড. দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য্য, নিরঞ্জন
অধিকারী, এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত, ঢাকা, পুণমুর্দ্রণ, জুলাই, ২০১১
৮. শ্রীমা সারদা দেবী,
স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯৬, পৃ ২৮৯-২৯০
৯. ধর্ম শিক্ষা (হিন্দু
ধর্ম), মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ (বি.এড) প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা, মডিউল ১ এবং ৩
টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা
অধিদপ্তর, ঢাকা, জুলাই-২০১০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন