সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

সৎসাহস : অভিমন্যুর সৎসাহস


‘সাহস’ শব্দটির মানে হচ্ছে ভয়শূন্যতা, নির্ভীকতা। বিপজ্জনক কাজে উদ্যমের নামও সাহস। এই সাহস ভালো বা সৎ কাজে অথবা মন্দ বা অসৎ কাজে উভয় ক্ষেত্রেই দেখানো যেতে পারে। তবে সৎ বা মঙ্গলজনক কাজে যে সাহস দেখানো হয়, তাকে বলা হয় সৎসাহস । যখন কেউ দুর্বলের উপর অত্যাচার করেন, তখন সৎসাহস নিয়ে দুর্বলের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত। শরণাগতকে তাড়নাকারীর হাত থেকে রক্ষা
করার ক্ষেত্রেও অনেক সময় সৎ সাহসের প্রয়োজন হয়। ধর্মযুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। যুদ্ধক্ষেত্রে সৎসাহস দেখানো বীরের কর্তব্য । মহাভারত থেকে এই রকম এক বীরের সৎসাহসের কাহিনী আমরা জানব। অভিমন্যুর সৎসাহস অনেক অনেককাল আগের কথা। সে এক ভীষণ যুদ্ধ। যেমন বড়, তেমনি দুঃখময়। যুদ্ধ তো সব সময়েই দুঃখময়। তবু এ যুদ্ধের দুঃখ আরও বেশি, এ যুদ্ধ ভাইয়ে ভাইয়ে। তাই দু’ পক্ষে ভাগ হয়ে যারা যুদ্ধ করছিল, তাদের মধ্যে ছিল দু’ পক্ষেরই আত্মীয়-স্বজন। হস্তিনাপুর নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে কুরুবংশের রাজারা রাজত্ব করতেন। বিচিত্রবীর্য নামে এই রাজবংশের এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল দুই ছেলে, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু । ধৃতরাষ্ট্র বড় এবং পাণ্ডু ছোট। কিন্তু বড় হলে কী হবে, তিনি জন্ম হতে অন্ধ। জন্মান্ধ বলেই রাজার বড় ছেলে পরবর্তী রাজা হবেন- এই প্রচলিত নিয়ম মানা গেল না, ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারলেন না। রাজা হলেন পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী , তাঁদের হলো একশত পুত্র । দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ ইত্যাদি। আর একটি মেয়ে, তার নাম দুঃশলা। পাণ্ডুর দুই স্ত্রী । কুন্তী ও মাদ্রী। কুন্তীর তিনটি ও মাদ্রীর দুটি ছেলে হয়। কুন্তীর ছেলেদের নাম যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং মাদ্রীর ছেলেদের নাম নকুল ও সহদেব। কুরুবংশের নামানুসারে ধৃতরাষ্রেপুর ছেলেদের বলা হতো কৌরব। পাণ্ডুর ছেলেরাও কৌরবই। কিন্তু পাণ্ডুর নামানুসারে তাঁদেরকে বলা হতো পাণ্ডব। পাঁচজন বলে একত্রে বলা হতো পঞ্চপাণ্ডব। এই কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে রাজ্যের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। দু’পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। আত্মীয়-স্বজনরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেল। কেউ গেল পাণ্ডবদের দলে, কেউ গেল কৌরবদের দলে। কুরুক্ষেত্র নামক বিশাল প্রান্তর শিবিরে শিবিরে ছেয়ে গেল। হিরন্বতী নদী বইছে কুরুক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে। সেখানেই সৈন্য সাজাতে লাগলেন যুধিষ্ঠির । দুর্যোধনের সৈন্যরাও তার সামনে শিবির প্রস্ত্তত করল। সকল আয়োজন শেষ হলো। দুর্যোধন পিতামহ ভীষ্মকে সেনাপতি করলেন। পিতামহ ভীষ্ম ও অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য কৌরবদের পক্ষেই যোগ দিলেন। তাছাড়া অঙ্গদেশের রাজা মহাবীর কর্ণও রইলেন কৌরবদের পক্ষে । দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এক অর্বুদ দশ কোটি সৈন্য দিলেন দুর্যোধনকে। নিজে অস্ত্র না ধরে তিনি অর্জুনের রথের সারথী হলেন। এই যুদ্ধের এক পর্যায়ে অর্জুন যুদ্ধ করছেন এক বিশাল সেনাদলের সঙ্গে। কৌরব পক্ষ তাঁদের সাথে পারছে না। তখন দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। ঠিক হলো , দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করে যুদ্ধ করবেন। ‘ব্যূহ’ হচ্ছে যুদ্ধের সময় সৈন্য সাজানোর কৌশল বিশেষ । চক্রব্যূহ মানে চক্রাকার বা গোলাকার ব্যূহ। এতে চক্রাকারে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়। এতে প্রবেশের একটি মাত্র পথ থাকে এবং আটটি কুণ্ডলাকৃতি সারি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়। চক্রবূহ্য ভেদ করা খুব কঠিন। ভীম, সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাণ্ডব পক্ষের বড় বড় বীর সেই ব্যূহ ভেদ করতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির শঙ্কিত হলেন। অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন এবং অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু ছাড়া আর কেউ চক্রব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম নন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করবেন না, তিনি শুধু সারথির কাজ করবেন। অর্জুন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত। এ সময়ে একমাত্র ভরসা অভিমন্যু। কিন্তু অভিমন্যু মাত্র চৌদ্দ বছরের বালক। তাছাড়া তিনি চক্রব্যূহ ভেদ করে প্রবেশের কৌশল জানেন, কিন্তু বেরিয়ে আসার কৌশল জানেন না। আবার একজন কেউ এগিয়ে না গেলে অসম্মানিত হতে হয়। মেনে নিতে হয় পরাজয়ের গ্লানি। তাই যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে বললেন, তুমি যাও। চক্রব্যূহ ভেদ করো। আমরা সৈন্য দল নিয়ে তোমার সহায়তায় থাকব এবং তোমাকে বের করে আনব। অভিমন্যু সানন্দে সম্মত হলেন। বললেন, ‘আর্য, মঙ্গলকর বিপজ্জনক কাজে সাহস দেখানোই সৎসাহস। আমি যাব। দ্রোণাচার্যের ভয়ঙ্কর সৈন্য সাগরে আমি অবগাহন করব।’ শত্রুব্যূহে প্রবেশ করে অভিমন্যু বৃষ্টির মতো শরবর্ষণে বিপক্ষীয় বিপুলসংখ্যক সৈন্যকে হত্যা করলেন। দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতি বড় বড় বীর তার কাছে পরাজিত হলেন। নিহত হলেন মহাবীর শল্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণসহ কৌরবদের অনেক মহাবীর । তখন নিরুপায় হয়ে দ্রোণ, কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, শকুনি, অশ্বথ্থামা ও দুর্যোধন- এই সাত জন রথী একসাথে চৌদ্দ বছরের বালক অভিমন্যুর সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। তাঁরাও সাতবার পরাজিত হলেন। অষ্টমবারে সপ্তরথী চারদিক থেকে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। মিলিত আক্রমণে অস্ত্রহীন, রথহীন হয়ে অভিমন্যু শুধু রথের চাকা দিয়েই যুদ্ধ করতে লাগলেন। অবশেষে চক্রব্যূহে যুদ্ধ করতে করতে অকুন্ঠচিত্তে প্রাণ বিসর্জন দিলেন বীর অভিমন্যু। প্রাণ রইল না, কিন্তু রইল তাঁর সৎসাহস আর বীরত্বের খ্যাতি-স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল মহাভারতের পাতায় তাঁর নাম ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন