সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

হিন্দু ধর্মের কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য


ঈশ্বরে বিশ্বাস - হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে- ঈশ্বর আছেন, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র তিনিই ছিলেন, আর কিছুই ছিল না। বিশ্বের সবই ঈশ্বর হতে উৎপন্ন হয়েছে, আবার তিনিই চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন। তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি সমগ্র বেদময়। বেদাদি শ্রাস্ত্র তাঁরই মহিমা কীর্তন করে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তা একমাত্র তিনিই। তিনি মহাশক্তি। শক্তি শব্দটি স্ত্রীবাচক তাই
ঈশ্বরের মাতৃরূপ ভাবনা করে শক্তির আরাধনা ও উপাসনা করা হয়। বেদের অপৌরুষেয়তা- হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান। অর্থাৎ যা দ্বারা জানা যায়। অপর কথায় বেদ অর্থ হলো সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডার। বেদের মন্ত্রগুলি বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মনীষীদের মণীষায় আবির্ভূত হয়। ঐ সব মনীষী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নামে খ্যাত। তাঁরা মানস নেত্রে মন্ত্র দর্শন করে সুর সংযোগে তা গান করতেন। সে সময়ে ঋষি-পরিবারের লোকেরা ঐ সমস্ত মন্ত্র শুনে শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলে বেদের এক নাম শ্রুতি। বেদ চিরদিনই গুরু পরম্পরায় শ্রুতি হয়ে এসেছে। ঋষিদের ধ্যানলব্ধ জ্ঞান বা দর্শনের বাণীবদ্ধ প্রকাশ বেদ। ঋষিরা বলেছেন, তাঁরা এর স্রষ্টা নন, দ্রষ্টা মাত্র। তাই বেদকে বলা হয় অপৌরুষেয় অর্থাৎ কোন পুরুষ বা ব্যক্তি তা রচনা করেন নি। জন্মান্তর ও কর্মফল- হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল আত্মার অবিনশ্বরতা, জন্মান্তর ও কর্মফলে বিশ্বাস। ব্রহ্ম যখন সবার উপরে প্রভূত্ব করেন তখন তাকে বলে ঈশ্বর। আবার এই ব্রহ্ম যখন জীবদেহে অবস্থান করেন, তখন তাকে বলে আত্মা। আত্মার জন্ম বা মৃত্যু নেই। আত্মা অবিনশ্বর। আত্মা দেহ ধারণ করে জন্ম গ্রহণ করে। তাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ ধারণ করে অন্য জন্ম লাভ করে। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মার অন্য জন্ম লাভ করার নাম ‘জন্মান্তর’। হিন্দুধর্ম এই জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। এই জন্মান্তরের সাথে কর্মফলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে কর্ম করতে হয় এবং সে তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করে। জীব জন্ম গ্রহণ করে তার কর্মফল ভোগের জন্য। জীব এ জন্মে যেমন কর্ম করবে, সেই অনুযায়ী তার পরবর্তী জন্ম হবে। ভাল কর্ম করলে ভাল জন্ম হবে। খারাপ কর্ম করলে খারাপ জন্ম হবে। আবার এ জন্মের ফল আগামী জন্মে তাকে ভোগও করতে হবে। ভাল কর্মের দ্বারাই জীব এক সময় মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেন। জন্মান্তর বা পুণর্জন্মের আবর্ত থেকে ব্রহ্মের সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই হলো মুক্তি বা মোক্ষ। এই চিরমুক্তির বা মোক্ষলাভই হিন্দু ধর্মের মূল লক্ষ্য। অবতারবাদ- কর্মফল ভোগের জন্য নয়, কোন বিশেষ কার্য সাধনের জন্য ঈশ্বরও জীবরূপে জন্ম গ্রহণ করেন। ঈশ্বরের এই বিশেষ কার্যসাধনের নাম লীলা । ঈশ্বর যখন এই লীলা প্রকাশের জন্য জীবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বা নেমে আসেন, তখন তাকে অবতার বলে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ঈশ্বর জীবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। ঈশ্বরের অবতীর্ণ হওয়ার এ তত্ত্বটিকেই বলা হয় অবতারবাদ। জীবসেবা- ঈশ্বরের এক নাম পরমাত্মা। তিনি জীবের মধ্যেও অবস্থান করেন। জীবের মধ্যে অবস্থানকারী ঈশ্বরকে আত্মা বা জীবাত্মা বলে। ঈশ্বর জীবদেহে আত্মারূপে অবস্থান করেন, তাই জীবও ঈশ্বর। সুতরাং জীবের সেবা করলে তা ঈশ্বরেরই সেবা করা হয়, জীবকে ভালবাসলে ঈশ্বরকে ভালবাসা হয়। তাই ভক্ত ঈশ্বর জ্ঞানে জীবের সেবা করে থাকেন। হিন্দুধর্মে কোন কাজটি করা সঙ্গত আবার কোন কাজটি করা ধর্ম বিরুদ্ধ তা নির্ণয়ের প্রশ্ন আসতে পারে। এর সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রথমে আশ্রয় করতে হয় বেদ, তারপর স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের বাণী। বেদ- বেদ আদি ধর্মগ্রন্থ তাই ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে বেদ হচ্ছে উৎকৃষ্ট বা প্রথম প্রমাণ। স্মৃতি- বেদ সকলের বোধগম্য নয়, আবার জীবন যাপনের সব রকম কাজের কথাও বেদে নেই। এজন্যে বেদের উদ্দেশ্য ঠিক রেখে মনু, পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিগণ স্মৃতিশাস্ত্র তথা হিন্দুধর্মের বিধি-বিধান প্রণয়ন করলেন। মনু সংহিতা, পরাশর সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ হচ্ছে ধর্মের দ্বিতীয় প্রমাণ। সদাচার- যেখানে বেদ ও স্মৃতির নির্দেশ পাওয়া যায় না, সেখানে সৎ ব্যক্তির আচার এবং উপদেশ ধর্ম বলে গ্রহণ করা হয়। বিবেকের বাণী- বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, এমনকি সদাচার ও যেখানে ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে নির্দেশ দিতে পারে না, সেখানে বিবেকের বাণীকে ধর্ম বলে গ্রহণ করতে হয়। উপাসনা, যজ্ঞ, পূজা, কীর্তন, তীর্থভ্রমণ প্রভৃতি হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠানগত দিক। এই দিকগুলো ছাড়াও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে করণীয়; গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন ও বিবাহ প্রভৃতি দশটি সংস্কার বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পর্কেও হিন্দুধর্ম শাস্ত্রে সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে। শাস্ত্রের বিধি-বিধান আশ্রয় করে হিন্দুদের সমগ্র জীবনে যেমন অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন মাঙ্গলিক ক্রিয়া, তেমনি মৃতজনের উদ্দেশ্যেও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, পারলৌকিক কৃত্য প্রভৃতি সম্পাদন করার বিধি-বিধানও হিন্দুধর্মে রয়েছে। শাস্ত্রের সকল বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক ধর্মীয় আচার-আচরণ ও মাঙ্গলিক কর্ম সম্পাদন করে মানবজীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করে গড়ে তোলাই হিন্দুধর্মের মূল লক্ষ্য ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন