সপ্তশতী অনুধ্যান
(শ্রীমদভগবদ্গীতা ও শ্রীশ্রীচণ্ডীর ঐক্য ভাবনা)
ভারতীয়
আধ্যাত্মিক চিন্তারাজ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই দু’টি ধারা বিদ্যমান। একটি বৈদিক ,
অপরটি তান্ত্রিক। বেদ, বেদান্ত বৈদিক ধারার ভিত্তি। এ ধারা পূর্ণতা পেয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। তান্ত্রিক ধারার ভিত্তি হচ্ছে অগণিত
তন্ত্রগ্রন্থ।
এ ধারার চরম পরিণতি এসেছে দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রীচণ্ডীতে।
বৈদিক ধারায় সমস্ত বিশ্ব প্রপন্চের মূলতত্ত্বকে মহাশক্তিময়ী চৈতন্যসত্তা বা ব্রহ্ম
বা পরমাত্মা বলা হয়ে থাকে। তান্ত্রিক ধারায় এই তত্ত্বকেই চৈতন্যময়ী মহাশক্তি বা
মহাদেবী বলা হয়ে থাকে। একটিতে পুরুষবাদ, অপরটিতে শক্তিবাদ বিধৃত। “পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যচ্চ ভাব্যং” – এ হলো পুরুষবাদের মূলমন্ত্র। পুরুষ
থেকেই জগৎ সৃষ্ট, পুরুষাশ্রয়েই জগতের স্থিতি, পুরুষেই চরম লয় প্রাপ্তি। বৈদিক
শাস্ত্র মতে পুরুষই পরমব্রহ্ম। গীতাতেও পুরুষোত্তমতত্ত্বই মূল-তত্ত্ব। অপরপক্ষে “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ
সংস্থিতা” – এ হলো শক্তিবাদের মূলমন্ত্র। শক্তি
হতেই জগৎ জাত, শক্তিতেই জগৎ স্থিত, শক্তিতেই জগৎ বিলয়-প্রাপ্ত। তন্ত্র শাস্ত্রমতে
শক্তিই পরব্রহ্ম। পুরুষতত্ত্ব শিব আছেন, শবতুল্য। চণ্ডীতে চৈতন্যময়ী মহাশক্তির
মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।
গীতা
ও চণ্ডীতে আপাত পার্থক্য বোধ হলেও তত্ত্বগতভাবে দু’টি গ্রন্থে বিরোধিতা নেই। ঋক্
বেদের দেবীসূক্ত মধ্যেই চণ্ডীর বীজ নিহিত রয়েছে। দেবীসূক্তে যিনি মন্ত্ররূপা,
চণ্ডীতে তিনি বিগ্রহরূপা ড. শ্রীমন্ মহানামব্রত ব্রহ্মচারিজীর ভাষায়, “বেদাদি
শাস্ত্রের মহাসত্য, চণ্ডী আধ্যাত্মিক পরীক্ষা অর্থাৎ সাধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত
করিয়াছে। বেদ, গীতার মন্ত্র ও বেদান্তের সূত্র, চণ্ডীতে মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে।”
চণ্ডীর ভাব, ভাষা ও বহু শ্লোকের মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে। এ দু’টি গ্রন্থের সম্বন্ধ এ নিবন্ধের
আলোচ্য।
১
গীতা
ও চণ্ডী কোন গ্রন্থই একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয়। গীতা মহাভারতের অন্তর্গত আর
চণ্ডী মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত। দু’টি গ্রন্থই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস কর্তৃক
প্রকাশিত। গীতায় সাতশত শ্লোক আর চণ্ডীতে সাতশত মন্ত্র রয়েছে তাই
দু’টি গ্রন্থকেই সপ্তশতী বলা
হয়।
অনেক
শাস্ত্রগ্রন্থই সংবাদ বা বক্তা শ্রোতার কথোপকথনরূপে প্রকটিত আছেন। যেমন- মহাভারত,
বৈশম্পায়ন-জনমেজয়-সংবাদ । ভগবত, শুক-পরীক্ষিত-সংবাদ। গীতা, কৃষ্ণার্জুন-সংবাদ।
চণ্ডী, মেধা ও সুরথ সমাধি-সংবাদ। তবে, গীতা ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থেই ষট্-সংবাদ দেখা যায়। গীতা
অর্জুনকে লক্ষ্য করে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ। এই উপদেশই সঞ্জয় বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। উহাই
আবার বৈশম্পায়ন বলেছেন জনমেজয়কে। চণ্ডীতেও সেরূপ- মেধা মুনি দেবী-মাহাত্ম্য রাজা
সুরথ ও সমাধি বৈশ্যকে বলেছেন। সে কথাই মার্কণ্ডেয় মুনি ভাগুরি মুনিকে বলেছেন। উহাই
আবার পক্ষিরূপি দ্রোণমুনির চারপুত্র, জৈমিনি মুনির নিকট কীর্তন করেছেন। এ হচ্ছে
চণ্ডীর ষট্-সংবাদ। গ্রন্থসমূহে যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে ঐ ছয় ব্যক্তি তার প্রধান
দ্রষ্টা বা সাক্ষী।
গীতা
ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থই গুরু-শিষ্য
সংবাদ।
গীতার আচার্য, অর্জুনের রথের সারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বিষাদগ্রস্ত অর্জুন শরণাগত হয়ে
‘শিষ্যস্তেহহং’ ( গীতা-২/৭
) বলে উপদেশ প্রার্থী হলে, শ্রীকৃষ্ণ গুরুপদে আসীন ( কৃষ্ণং বন্দে জগদ্ গুরুম্ ) হয়ে উপদেশ দানে
প্রবৃত্ত হয়েছেন। গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ব্যাসদেব ‘শ্রীকৃষ্ণার্জুন সংবাদ’ বলে অধ্যায়টিকে উল্লেখ করেছেন। চণ্ডীতে
মোহগ্রস্ত রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, আচার্য মেধার শরণাগত হয়েছেন। শিষ্যদ্বয়ের
প্রশ্নের উত্তরে মুনিবর দেবী মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন।
উভয়
গ্রন্থের শ্রোতৃগণ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জিজ্ঞাসু হয়েছেন- তা কোন আধ্যাত্মিক বা
পারমার্থিক সমস্যা নয়। উভয় ক্ষেত্রেই পারিবারিক ও ব্যবহারিক জীবনের সমস্যায় তাঁরা
বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু এর সমাধান কল্পে আচার্যদ্বয় যে উপদেশ দিয়েছেন তা
সর্বতোভাবেই পারমার্থিক। সমস্যা সমাধানে চণ্ডীর আচার্য, দেবী মহামায়ার তত্ত্ব
উদ্ঘাটন করেছেন, আর গীতার আচার্য, আত্মতত্ত্ব ও পুরুষোত্তম তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন।
চণ্ডীর
মূখ্য বর্ণনীয় বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ। গীতার আবির্ভাবও যুদ্ধের প্রাক্কালে। চণ্ডীর
যুদ্ধ মূলত: সাধকের অন্তরের। গীতার যুদ্ধ বাস্তবের, বাহিরের।
চণ্ডীর যুদ্ধ সূক্ষ্মস্তরের- দেবতায় ও অসুরে। এই দেবাসুরের তাত্ত্বিকরূপ গীতায়
ভগবান অর্জুনকে বলেছেন-
“তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো
জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা” ।। ১০/১১
-অর্থাৎ
‘যারা আমার ভক্ত, আমাতে চিত্ত অর্পণ করে প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে, তাদের অন্তরে
অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান আলোক দ্বারা আমি তাদের অজ্ঞান-তমঃ
বিনাশ করি।’ সকলের অন্তরে অজ্ঞান-তমঃ আছে – উহাই অসুর। জীবনের স্বচ্ছন্দ
বিকাশের পক্ষে উহাই ছন্দোহীনতা বা সুরবিরোধী অসুরভাব, আর উজ্জ্বল জ্ঞানদীপই
মহাবিদ্যারূপিণী মহাদেবী। সকল আসুরিক শক্তির ইনি বিনাশকারী। অজ্ঞানতমোরূপ আসুরিকতা
বিধ্বংস করতে মহাশক্তি দুর্গা প্রকটিতা। চণ্ডীর মহাদেবী নিখিল ভাস্বর জ্ঞানদীপের
সমষ্টিভূতা মূর্তি। সুতরাং গীতার “নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো
জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা” মন্ত্রের মধ্যে চণ্ডীর অসুরধ্বংসকারী মহাযুদ্ধের
রহস্যটি সূত্রাকারে বিরাজিত।
চণ্ডীর
যুদ্ধ মনোময় ও বিজ্ঞানভূমিতে স্থিত। অসুরগুলো মনোময় ভূমির বস্তু, মহাদেবী
বিজ্ঞানময় ভূমির প্রজ্ঞাঘন শক্তি। এই দু’য়ে যুদ্ধ। গীতার যুদ্ধ কিন্তু মানুষের
মাটির উপর। একই অন্নময় প্রাণময় ভূমির নীতির দুর্নীতির যুদ্ধ। গীতার যুদ্ধ রাজনৈতিক
সমর, চণ্ডীর যুদ্ধ সাধন-সমর। গীতার কথা যুদ্ধের মুখে, চণ্ডীর কথা যুদ্ধের মধ্যে।
চণ্ডীর প্রথম চরিতের প্রথমাংশ ভূমিকা বা ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুতি। গীতার প্র্রথম
অধ্যায়ও তা-ই। চণ্ডীতে সুরথ রাজা হলেও এখন রাজ্যভ্রষ্ট। রাজ্যচ্যুত রাজা বনে এসেছেন
কিন্তু বাণপ্রস্থী হন নি। বনে আশ্রয় নিয়েও বিষন্নচিত্ত। আত্মীয়, স্বজন,
রাজপ্রাসাদ, অশ্ব, গজ, পাত্র, অমাত্য সকলের অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তান্বিত। আর বৈশ্য
সমাধি, ধনলোভী নিজ স্ত্রী-পুত্রগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনিও বনে এসেছেন। রাজা ও বৈশ্যের বনেই দেখা, তাদের একই অবস্থা।
আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েও তাদের প্রতি মমতাকৃষ্ট। তাদের প্রতি অতীব দুঃখার্ত
(দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ,
চণ্ডী- ১/৪৩ )।
গীতায়
অর্জুনের চিত্তও অনেকাংশে অনুরূপভাবে বিষাদযুক্ত। পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের
হাতে অকথ্য লাঞ্ছনা ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাঁদের সহিত যুদ্ধ হবে তা বহু পূর্বেই
স্থির হয়েছে। অর্জুন তপস্যা করে মহাশক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। অর্জুন বীরপুঙ্গব।
যুদ্ধ তাঁর কাছে খেলার মতো কিন্তু আজ রণাঙ্গণে সৈন্য দর্শন করতে করতে তাঁর এ কী
হলো! অপ্রত্যাশিত “অকীর্তিকর” হৃদয়দেৌর্বল্য ও মহামোহ তাঁর উপস্থিত
হলো। যাদের অশেষ হীনতার কথা তাঁর অন্তরে গাঁথা আছে সেই আত্মীয় পরিজনের প্রতি তিনি
মমতাকৃষ্ট হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েই তিনি এমন মোহগ্রস্ত হলেন যে, তাঁদের
বধ করা অপেক্ষা নিজ মৃত্যু শ্রেয়স্কর বলে তিনি বিবেচনা করলেন।
“যৎ প্রেমপ্রবণং চিত্তংবিগুণেষ্বপি
বন্ধুষু” (চণ্ডী ১/৩৩) –
গুণহীন স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয়গণের প্রতি আমার চিত্ত প্রেমপ্রবণ (মমতাযুক্ত) হয়েছে।
চণ্ডীতে মেধা মুনির পদপ্রান্তে উপনীত হয়ে রাজা সুরথ এই মোহের কারণ জিজ্ঞেস করলেন- “দৃষ্টদোষেহপি বিষয়ে মমতাকৃষ্টমানসেৌ” (১/৪৪) – বিষয়ের দোষ
স্পষ্টতঃ দেখা সত্ত্বেও আমরা তার প্রতি মমত্ব হেতু আকৃষ্ট হচ্ছি কেন? গীতার মধ্যেও
অর্জুনের অনুরূপ প্রশ্ন-
অথ কেন
প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতিপুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব
নিয়োজিতঃ।। (৩/৩৬)
-‘অনিচ্ছা
সত্ত্বেও কে আমাদের চিত্তকে বলপূর্বক পাপে নিয়োজিত করে? উভয় প্রশ্নের মর্মার্থ
একই। সব বুঝেও ভুল করি, পাপে লিপ্ত হই কেন’?
চণ্ডীর
জিজ্ঞাসু রাজা ও বৈশ্য নিজেদের জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন। তাঁরা প্রশ্ন করছেন-
“তৎ কেনৈতন্ মহাভাগ যন্মোহো জ্ঞানিনোরপি”। ( ১/৪৪ ) অর্থাৎ
জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এই মোহ কেন? উত্তরে
ঋষি বলেছেন- তোমাদের এই বিষয় ও ইন্দ্রিয় মিলন হেতু যে অবরোধ তাকে যদি জ্ঞান
বলো, তা হলে ঐরূপ জ্ঞান পশুপক্ষীদেরও আছে। “যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ”। (
১/৫০ ) বস্তুতঃ এই ইন্দ্রয় বিষয়- মিলনজ জ্ঞান অজ্ঞানেরই নামান্তর। চণ্ডীর এই উত্তরের
প্রতিধ্বনি গীতাতেও শ্রুত হয়। অর্জুনকে মৃদুমন্দ ভর্ৎসনার সুরে শ্রীভগবান যেন এই
কথাই বলেছেন- “অর্জুন তুমি জ্ঞানী ব্যক্তির মতো কথা বলছো ( প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ
ভাষসে ) ( গীতা, ২/১১ ), কিন্তু কাজ করছো অজ্ঞানের মতো। কারণ, যা
শোকের বস্তু নয় ( অশোচ্য ) তারই
জন্য শোক করছো। জ্ঞানী ব্যক্তিরা এরূপ করেন না”।
চণ্ডীতে
সুরথ-সমাধির মোহগ্রস্ত ও উদ্ভ্রান্ত মনকে ঋষি প্রশান্ত করেছেন; চণ্ডীর মাহাত্ম্য
কীর্তন করে এবং তাঁদের দ্বারা দেবী মহামায়ার পূজা করিয়ে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিষাদিত চিত্তকে স্বরূপস্থিত করিয়েছেন- উপদেশ প্রদানের
মাধ্যমে। সুরথ-সমাধির বাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে মাতৃদর্শনে, আর অর্জুনের মোহ কেটেছে
সত্য-দর্শনে, বিশ্বরূপ দর্শনে।
চণ্ডী
ও গীতার ভূমিকায় এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও পরিবেশের ভিন্নতা সুস্পষ্ট। চণ্ডীর উপদেশের
পরিবেশ ঋষির তপোবন। তপোবনের প্রাকৃতিক শোভা
ও সৌন্দর্য- প্রশান্ত শ্রীসম্পন্ন, রমণীয় শান্তরসপ্রধান। চণ্ডীর আলোচ্য
বিষয় দেবাসুর-সংগ্রাম- রজোময় ও তমোময়। পক্ষান্তরে গীতার পটভূমিকা এক মহাসমরের।
যুদ্ধক্ষেত্র স্বভাবতঃই রজস্তমোগুণময়। কিন্তু গীতার আলোচ্য বিষয় আত্মতত্ত্ব- গভীর
শান্তরসাত্মক। চণ্ডীর প্রশান্ত ভূমিতে যুদ্ধের অশান্ত বার্তা। গীতার অশান্ত
সমরাঙ্গনে প্রশান্তর বার্তা।
চণ্ডীর
মধ্যম চরিতে দেবী মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব ও গীতার বিশ্বরূপ দর্শন, তত্ত্বতঃ একই। উভয়
ক্ষেত্রেই অনুভূতি বিজ্ঞানময় ভূমির- সামগ্রিক দৃষ্টি। বহুত্বে একত্ব, একত্বে
বহুত্ব। সমগ্র সত্ত্বাকে একেবারে একত্র একত্বে দর্শন। “ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নম্” একস্থ সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বচরাচরের
সকলই একদেহে স্থিত, ইহাই অপরোক্ষ দর্শন। ইহাই বিশ্বরূপ দর্শনের মর্মকথা।
চণ্ডীতেও
মায়ের মহীয়সী স্ত্রীমূর্তির মধ্যে নিখিল দেবগণের শক্তিসমূহ প্রকটিত। ভিন্ন ভিন্ন
দেব শক্তি একই বিশ্বজননীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তাঁর বাহুই বিষ্ণু, চরণই ব্রহ্মা,
শ্রীবদনই শিব। কেশে যম, নাসিকায় পবন, নয়নে অগ্নি। বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন আয়ুধগুলো
মায়ের শ্রীহস্তে শোভমান। তাই মায়ের দর্শনেই নিখিল দেবতা ও দৈবশক্তির দর্শন পাওয়া
যায়। এক স্বরূপে বিশ্বদেবতার দর্শন, এক নিরূপম দর্শন।
গীতায়
বিশ্বরূপ দর্শনে অর্জুনের ভীতিযুক্ত বিস্ময়। চণ্ডীতে মাতৃরূপ দর্শনে দেবগণের
প্রীতিযুক্ত বিস্ময়। অর্জুন ‘হৃষ্টরোমা’ ভয়ে,
দেবগণ ‘পুলকোদ্গমচারুদেহাঃ’ আনন্দে। দেবগণ
জানেন, মা আমাদের সকল অমঙ্গল নাশ করবেন- তাই উল্লসিত। অর্জুন জানেন না ইনি কে, তাই
জিজ্ঞেস করেছেন-
“আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপঃ”
উগ্রমূর্তি
আপনি কে আমাকে বলুন। উত্তরে জানলেন- তিনি কাল, লোকসংহারে প্রবৃত্ত- “কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ”।
চণ্ডী
ও গীতায় শ্রীভগবৎস্বরূপের আবির্ভাবের কথা ঠিক একই রূপ। চণ্ডীতে দেবগণের স্তুতিতে
প্রসন্না দেবীর সান্ত্বনা বাক্য-
“ইত্থং যদা যদা
বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্য্যাহং
করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্”।। ( ১১/৫৫ )
‘যখনই
যখনই দানবের অভ্যূদয়ে জীবগণ এপ্রকারে উৎপীড়িত হবে তখনই তখনই আবির্ভূতা হয়ে শত্রু
নাশ করে শান্তি আনয়ন করবো।’ গীতাতেও ভগবান অনুরূপ বাণী বলেছেন- যখন যখন ধর্মের
গ্লানি ও অধর্মের অভ্যূত্থন হয়, তখন সাধুগণের রক্ষণ, দুষ্কৃতির দমন ও
ধর্ম-সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। “সম্ভবামি যুগে যুগে ।” উভয় বাণীতেই
বুঝা যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবতী দুর্গা উভয়েরই দুঃখদুর্দশাগ্রস্ত উৎপীড়িত
জীবের জন্য দয়া আছে। আমাদের দুঃখ তাঁদের প্রাণে লাগে। ডাকলে শোনেন। প্রয়োজন বোধ
করলে মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করেন। অনুগ্রহ করে দুঃখ দূর করেন।
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ এসেছেন নন্দ-গোকুলে যশোদার ঘরে। সেই যশোদার ঘরেই যোগমায়ারূপে কন্যা হয়ে একই রজনীতে একই সময়ে
মা এসেছেন। গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া” -নিজ
মায়াশক্তির সঙ্গে সম্ভূত হই। আর সেই আত্মমায়া-স্বরূপিণী দেবীই চণ্ডীতে বলেছেন, “নন্দগোপগৃহে জাতা যশোদা-গর্ভ-সম্ভবা”
(১১/৪২) – আমি নন্দগোপ-গৃহে যশোদা গর্ভে আসবো – এই একবাক্যতা চমৎকার।
গীতায়
শ্রীভগবান নিজের স্বরূপ বলেছেন, “অহমাত্মা
গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ” (১২/২০)। চণ্ডীতে মেধা ঋষি মহাদেবীর
তত্ত্ব বলেছেন, “যা দেবী
সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে” (৫/১৭)
আত্মার
স্বরূপ হলো চেতনা বা চৈতন্যস্বরূপতা। শ্রীভগবান বললেন, আমি আছি সর্বভূতে
আত্মারূপে। ঋষি বললেন, মহাদেবী আছেন সর্বভূতে চেতনারূপে। ভিন্নতা কিছুই নেই।
গীতায়
শ্রীভগবান বলেছেন, “একাংশেন
স্থিতো জগৎ” (১০/৪২)। এই বিশ্বজগৎ আমার একাংশে অবস্থিত।
চণ্ডীতে
দেবতাগণ মায়ের স্তবে বলেছেন, “সর্বাশ্রয়াখিলমিদং
জগদংশভূতম্” (৪/৭)। তুমি সকলের আশ্রয়। এই সমস্ত জগৎ তোমার
অংশভূত। উভয় একই কথা।
গীতা
বলেছেন, প্রকৃতি ও পুরুষ দুই তত্ত্বর মিলনে সংসার সৃষ্টি। গীতা সমস্ত বিকার ও
গুণকে প্রকৃতিসম্ভব বলেছেন-
“বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্”
(১৩/২০)
দেহস্থ
পুরুষকে বলেছেন ‘ভর্তা ভোক্তা
মহেশ্বরঃ’ (১৩/২৩)। দেবীমাহাত্ম্যে মহাদেবী আদ্যা পরমাপ্রকৃতি ( পরমা প্রকৃতিরাদ্যা - ৪/৭ )। কিন্তু এই পরমা প্রকৃতির মধ্যে পুরুষ এবং প্রকৃতি
উভয় সম্মিলিতা, কারণ মহাদেবী
কেবল নিখিল বিকার ও গুণের মূল নন- তিনি চৈতন্যময়ী এবং মাহেশ্বরীও। মহাদেবী প্রকৃতি
বলে ত্রিগুণময়ী, আবার পুরুষ বলে ত্রিগুণের দোষের দ্বারা লিপ্ত নন। এরূপ আশ্চর্যজনক
তত্ত্ব বলে মহাদেবী হরিহরাদিরও অজ্ঞেয়া।
“হেতুঃ
সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।” ( ৪/৫
)
তুমি
সমস্ত জগতের কারণ। তুমি ত্রিগুণা হয়েও দোষে লিপ্ত নও। হরিহর প্রভৃতিরও তুমি
অজ্ঞেয়া।
গীতায়
শ্রীভগবান বলেছেন,
“যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ
সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্”।।
( ১০/৪১ )
-‘যেখানে
যা কিছু শ্রীমৎ, ঊর্জিত ও বিভূতিযুক্ত, সকলই আমার অংশ বলে জানবে।’
চণ্ডীতে
ভগবতী অসুরকে বললেন, “পশ্যৈতা
দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ”।। ( ১০/৫ ) – রে দুষ্ট! দেখ্ আমার বিভূতিসকল আমাতেই প্রবেশ
করছে। এ বলে আকর্ষণ করলেন। অসুর দেখলো অগণিত মাতৃকামূর্তি দেবীর দেহে প্রবেশ করছে,
আর প্রবেশ করে এক হয়ে যাচ্ছে। মা বললেন,
“অহং বিভূত্যা
বহুভিরিহ রুপৈর্যদাস্থিতা।
তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব
তিষ্ঠাম্যাজৌ স্থিরো ভব।।” (১০/৮)
-‘আমি
ঐশ্বর্য দ্বারা এ যুদ্ধে বহুরূপে যে অবস্থান করছিলাম, তা উপসংহার করলাম। আমি এখন
একাই আছি, একাই যুদ্ধ করবো, তুই স্থির হ।’ নিখিল বিভূতি যে এক বস্তুরই বহু প্রকাশ –
গীতায় তা সুব্যক্ত, চণ্ডীতে বাস্তবায়িত।
বৈশেষিক
দর্শনের ঋষি কণাদ ধর্মের লক্ষণ বলেছেন, “যতো বাহভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ”। যা
হতে অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স লাভ হয়
তা-ই ধর্ম। অভ্যুদয় মানে সাংসারিক উন্নতি, যেমন- ধন, মান, যশ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি।
নিঃশ্রেয়স মানে নিশ্চিত মঙ্গল। প্রবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল অভ্যুদয়।
নিবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল নিঃশ্রেয়স। পূর্ণাঙ্গ বৈদিক ধর্মের চণ্ডীর লক্ষ্য
নিবদ্ধ।
সুরথ
ও সমাধির অর্চনায় মা পরিতুষ্টা হয়ে বললেন, বর চাও। রাজা চাইলেন অবিভ্রংশ রাজ্য।
সমাধি চাইলেন তত্ত্বজ্ঞান। যে জ্ঞানের উদয় হলে, মিথ্যা আমি ও আমার নাশ প্রাপ্ত হয়,
তা-ই চাইলেন সমাধি। রাজা চাইলেন অভ্যুদয়, বৈশ্য চাইলেন নিঃশ্রেয়স। গীতায় শ্রীভগবান
বলেছেন, “যে যথা মাং
প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।” ( ৪/১১ ) – ‘যে ব্যক্তি আমাকে যে ভাবে ভজনা করে,
আমি তাকে সে ভাবেই ভজনা করি।’ শ্রীচণ্ডীতে তা প্রকট করে দেখানো হল। সুরথ রাজা ভজনা করেছেন রাজ্যসুখের জন্য,
সমাধি বৈশ্য ভজনা করেছেন মুক্তিসুখের জন্য। ভগবতী উভয়কেই বাঞ্ছানুরূপ ফলদান
করেছেন।
গীতা
ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থেই প্রবৃত্তি-ধর্ম বা ভোগের কথা এবং নিবৃত্তি-ধর্ম বা ত্যাগের
কথা -যোগের কথা দৃষ্ট হয়। যেমন গীতায় ভগবান বলছেন, “হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।” (২/৩৭) –‘যুদ্ধে
মৃত্যু হলে স্বর্গ, জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে’। এ কথা সম্পূর্ণ প্রবৃত্তি-মার্গের,
ভোগের কথাই। “উত্তিষ্ঠ
কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ” –‘যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উত্থিত
হও।’ –এই ধুয়া ভগবান গীতায় আগাগোড়াই বজায় রেখেছেন। বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েও বলেছেন-
“তস্মাৎ
ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভশ্ব
জিত্বা শত্রূন্ ভুঙ্ক্ষ্ব
রাজ্যং সমৃদ্ধম্ ।” ( ১১/৩৩)
অতএব
অর্জুন, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হও। শত্রু জয় করে নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ কর। ইহা
ভোগমার্গেরই নির্দেশ, “যুধ্যস্ব জেতাসি” (
গীতা, ১১/৩৪ ) যুদ্ধ কর জয় হবে, এ কথা ত্যাগ-মার্গের নয়। তবে চণ্ডী ও গীতাতে
পার্থক্য এই,- চন্ডীতে ভোগ যোগ দু’টি পৃথক বস্তু। ভোগের জন্য ভোগ, ত্যাগের জন্য
যোগ। ভোগ চাও ত এক পথ, ত্যাগ চাও ত আলাদা পথ। গীতায় ভোগ যোগ আলাদা নয়। গীতায় ভোগের
কথা বলেছেন বটে, কিন্তু ত্যাগের ভূমিকায়। সর্বতোভাবে ত্যাগের ভূমিতে দাঁড়িয়ে ভোগ
করো। গীতার দৃষ্টি নিবৃত্তির দিকে; মূল কথা তার ত্যাগ, কিন্তু নিবৃত্তির সঙ্গে
প্রবৃত্তির, ত্যাগের সঙ্গে ভোগের কোন বিরোধিতা দেখতে পাওয়া যায় না। গীতায় ভোগ
ত্যাগের কুক্ষিগত। ভোগ করো ভোগস্পৃহা-শূন্য হয়ে, কর্ম করো কর্মফল ত্যাগ করে, যুদ্ধ
করো আমাকে স্মরণ করে। “মামনুস্মর
যুধ্য চ” ( ৮/৭ )। কর্ম করো কর্তৃত্বাভিমান ছেড়ে –শত্রু জয় করো
নিমিত্তমাত্র হয়ে। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করো শত্রুতাভাব না রেখে, ‘নির্বৈর’ হয়ে। গীতায়
প্রেরণা আছে কর্ম করাতে- কিন্তু সেই করা-ক্রিয়ার কর্তা আছে, কর্তৃত্বাভিমান নেই-
কর্ম আছে কর্মফলাকাঙ্ক্ষা নেই। এই কর্তৃকর্মহীন স্তব্ধ ক্রিয়ার মধ্যে জ্ঞান -কর্মের
সমন্বয়, ভোগ যোগের সমন্বয়, প্রবৃত্তি নিবৃত্তির একাত্মতা। ভোগের প্রতীক ধনুর্ধর
পার্থ। ত্যাগের প্রতীক যোগেশ্বর কৃষ্ণ। গীতা ধনুর্ধারীর রথে যোগেশ্বরকে সারথি করে
এ কথা জানিয়েছেন যে- পূর্ণজ্ঞানী হয়ে, কর্মের অতীত হয়ে অপর্যাপ্ত কর্ম করো।
ভোগাতীত হয়ে ভোগের মধ্যে বাস করো। যোগেশ্বরকে জীবন-রথে সারথি করে কর্মের ধনু ধারণ
করো। সবশেষে সঞ্জয়ের মুখেও তা-ই শুনি-
“যত্র যোগেশ্বরঃ
কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা
নীতির্মতির্মম”।। (১৮/৭৮)
-‘যে
পক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং গাণ্ডীবধারী অর্জুন সেই পক্ষে রাজ্যশ্রী, বিজয়, অভ্যুদয় ও অব্যভিচারিণী নীতি
বিরাজ করে, ইহা আমার নিশ্চিত অভিমত।’
সুতরাং
গীতা ও চণ্ডীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, চণ্ডী দু’ হাত বাড়িয়ে এক হাতে ভোগ ও অপর হাতে
যোগ দিচ্ছেন, আর গীতা দু’ হাতে একত্রে দু’টিই বিতরণ করছেন।
চণ্ডী
পাঠের পূর্বে অর্গলা স্তোত্র পাঠ করা আবশ্যিক। এ স্তোত্রের “রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো
জহি” মন্ত্রের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি হেতু অনেকে মনে করেন- চণ্ডীতে কেবল দেহি দেহি
রব, কেবল ভোগ আর ভোগের জন্যই প্রার্থনা। এ প্রার্থনায় দ্বিবিধ তাৎপর্য নিহিত আছে।
যিনি ভোগাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে এক প্রকার অর্থ, যিনি মোক্ষাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে
অন্য প্রকার অর্থ। যিনি ভোগী তিনি দেহের রূপ কামনা করেন, যিনি ত্যাগী তিনি আত্মার
স্বরূপ জ্ঞান জাগিয়ে তুলবার প্রার্থনা করেন। ভোগী লৌকিক যুদ্ধে, মামলা মোকদ্দমায়
জয় কামনা করেন, ত্যাগী সাধন-সমরে জয় আকাঙ্ক্ষা করেন। ভোগী চান লৌকিক নাম যশ
খ্যাতি, তাই বলেন যশো দেহি। সাধক চান ভগবদ্ভক্ত বলে জগতে কীর্তিত হতে। ভোগার্থী
বাঞ্ছা করেন লৌকিক শত্রুর ধ্বংস; তাই বলেন, “দ্বিষো জহি”। ত্যাগী – যোগী চান, সাধন-পথে যে সকল বাধক রয়েছে;
সেই কামাদি শত্রুর অবলুপ্তি। ভোগী যেখানে পাঠ করেন-
“ভার্যাং মনোরমাং দেহি
মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্”। ‘( হে দেবি, ) আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী (
অনুকূল আচরণকারিণী ) মনোরমা ভার্যা ( ভরণীয়া বা স্ত্রী বা ভক্তি ) দাও।’ এক্ষেত্রে
ভোগী ভার্যা অর্থে ভরণীয়া বা স্ত্রী গ্রহণ করে প্রার্থনা করেন ,কিন্তু সাধকগণ
চিরদিন সেখানে ভার্যা অর্থে ভক্তি ধরেই পাঠ করে থাকেন।
এ
ছাড়া মায়ের কাছে কেউ অবনত হয়ে কিছু কামনা করলেই মা তা দেন না। যে বস্তু দিলে
একজনের উপকার কিন্তু অন্যের ক্ষতি তা দেন না। যাতে জগতের সকলের উপকার তা-ই মা দেন।
তাই তো দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে জগজ্জননী বললেন-
“বরদাহং সুরগণা
বরং যং মনসেচ্ছথ।
তং বৃণুধ্বং প্রযচ্ছামি
জগতামুপকারকম্”।। ( ১১/৩৭ )
‘হে
দেবগণ, আমি বরদাত্রী, তোমরা মনে মনে জগতের হিতকর যে ইচ্ছা করছো তা প্রার্থনা করো,
এখনই দিচ্ছি।’ নিষ্কাম ব্যক্তি নিষ্ক্রয় নয়, সে সর্বদা কর্ম করে “সর্বভূতহিতে রতাঃ” ( গীতা, ১২/৪ ) হয়ে। সুতরাং মা
যে জগতের মঙ্গলময় বর দিবেন, তা নিষ্কাম ভক্তেরও কাম্য। দেবতাগণও বলেছেন-
“ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা
ভব।” ( ১১/৩৫)
‘হে
স্তবনীয়ে দেবি। ত্রিভুবনবাসী জনগণের জন্য বরদাত্রী হও।’
কেউ
কেউ মনে করেন, গীতা ভক্তির কথায় পূর্ণ আর চণ্ডীতে ভক্তির গন্ধও নেই। এরূপ মনে করা
ঠিক নয়। গীতা শুধু ভক্তির কথায় পূর্ণ নয় –কর্ম, যোগ, জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়
গ্রন্থ গীতা। চণ্ডী গ্রন্থও ভক্তিশূন্য নয়। যে অর্গলা-স্তবে “রূপং দেহি জয়ং দেহি” প্রার্থনা পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হয়েছে সেই
স্তবেই আছে-
“দেবি
ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দোদয়েহম্বিকে” (২৪)
হে
দেবি অম্বিকে, তুমি ভক্তদেরকে অনর্গল আনন্দ দান করে থাকো। ভক্তদেরকে যে কত আনন্দ
দান করেন তার প্রমাণ চতুর্থ অধ্যায়ে দেবগণের স্তুতিকালে দৃষ্ট হয়। স্তবপরায়ণ দেবগণের
বর্ণনায় ঋষি বলেছেন- “প্রণতি-নম্রশিরোধরাংসাঃ”
“প্রহর্ষপুলকোদ্গম-চারুদেহাঃ” ( ৪/২ ) তাঁরা গ্রীবা ও
স্কন্ধ নত করে প্রণাম করে আনন্দে রোমাঞ্চ উদ্গত হওয়ায় সুন্দর দেহশালী হয়ে
মহাদেবীকে স্তব করে ছিলেন। আনন্দ গভীর না হলে পুলক হয় না।
চণ্ডীর
পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবের শেষে বলেছেন-
“যা চ স্মৃতা
তৎক্ষণমেব হন্তি নঃ
সর্বাপদো ভক্তিবিনম্রমূর্তিভিঃ”।। ( ৫/৮২ )
‘আমরা
ভক্তিনম্র হয়ে স্মরণ করলে জগন্মাতা তৎক্ষণাৎ আমাদের সকল বিপদ নষ্ট করে থাকেন।’
সবশেষে চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের স্তবে দেবগণ বলেছেন- হে দেবি, মা যেমন পুত্রদের রক্ষা
করেন, সেরূপ আমাদেরকে পাপ থেকে রক্ষা করো।
“পাপেভ্যো নঃ সুতানিব” ( ১১/২৭ )
এ
প্রার্থনার মধ্যে প্রীতিপূর্ণ আর্তি বিদ্যমান। পরেই বলেছেন, তোমার যারা আশ্রিত,
তাদের আর বিপদ নেই।
“ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নাণাং” ( ১১/২৯
)
হৃদয়ে
ভক্তি না থাকলে- আশ্রিত, শরণাগত, মুখের কথায় হয় না। তারপর একটি আশ্চর্য সংবাদ
বলেছেন-
“ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি” (
১১/২৯ )
তোমাকে
যারা আশ্রয় করে, তারা সকলের আশ্রয় হয়ে থাকে। সকলের বলতে নিখিল বিশ্বের সকলের। আর
এক মন্ত্রে তা স্পষ্টতর করেছেন-
“বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ” (
১১/৩৩)
যারা
তোমার কাছে ভক্তিভরে বিনম্র, তারা বিশ্বের আশ্রয় হয়ে থাকে। কতখানি ভক্তিপূর্ণ
চিত্তে মাতৃচরণ আশ্রয় করলে সে নিখিল বিশ্বের আশ্রয়স্থল হতে পারে তা বিশেষভাবে
অনুধাবনীয়। চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবটিতে পুনঃ পুনঃ “নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”।
শত শতবার নমস্কার। গীতায় ভগবান অর্জুনকে বলেছেন,
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং
নমস্কুরু।” ( ৯/৩৪)
মন্মনা,
মদ্ভক্ত হয়েই পুনঃ পুনঃ নমস্কার করতে বলেছেন।
ভাগবতীয়
শাস্ত্রে শ্রীভগবানের গুণাবলির মধ্যে ‘হতারিগতিদায়কত্ব’
একটি প্রধান গুণ। যে শত্রুকে তিনি নাশ করেন তারও সদ্গতি দান করেন। পূতনা-মোক্ষ
লীলায় শাস্ত্রকার বলেছেন,
“জিঘাংসয়াপি হরয়ে স্তনং দত্ত্বাপ
সদ্গতিম্।” ( ভাগবত,
১০/৬/৩৫ )
জিঘাংসাবৃত্তি
নিয়ে এসেও পূতনা সদ্গতি পেল। চণ্ডী গ্রন্থে মহিষাসুরের যুদ্ধের প্রসঙ্গে, স্তবে
দেবগণ বলেছেন, মহিষাসুর বধকালে তোমার বাইরে নিষ্ঠুরতা থাকলেও “চিত্তে-কৃপা” ছিল। তোমার ভয়ঙ্কর শস্ত্রপ্রভাসমূহের ঝকমকানিতে অসুরদের
দৃষ্টি যে নষ্ট হয় নি, তার কারণ তোমার অর্ধ-চন্দ্রযুক্ত বদনখানি তারা দেখতে
পেয়েছিল
(
৪/২০ )। তোমার শস্ত্রদ্বারা পবিত্র হয়ে তারা উৎকৃষ্ট লোকে গমন করুক, এরূপ মতি
নিয়েই তুমি তাদেরকে অস্ত্রাঘাত করেছো। না হলে তো শুধু দৃষ্টি দ্বারাই তাদেরকে
ভষ্মীভূত করতে পারতে।
“দৃষ্ট্বৈব কিং ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম
সর্বাসুরানরিষু যৎ প্রহিণোষি শস্ত্রম্।
লোকান্ প্রয়ান্তু
রিপবোহপি হি শস্ত্রপূতাঃ
ইত্থং
মতির্ভবতি তেষ্বপি তেহতিসাধ্বী”।। ( ৪/১৯ )
করুণাময়ী
মহাদেবীও যে হতারিগতিদায়িকা তা এই
মন্ত্রে সুব্যক্ত হয়েছে।
গ্রন্থ
শেষে উভয় গ্রন্থের ফলশ্রুতিও অনুরূপ। গীতার বক্তা বলেছেন-
“অধ্যেষ্যতে চ য ইমং ধর্মং সংবাদমাবয়োঃ।
জ্ঞানযজ্ঞেন
তেনাহমিষ্টঃ স্যামিতি মে মতিঃ”।। ( ১৮/৭০ )
যিনি
আমাদের এই ধর্মসংবাদ গীতাশাস্ত্র অধ্যয়ন
করবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞ দ্বারা আমার অর্চনা করবেন। আরও বলেছেন-
“শ্রদ্ধাবাননসূয়শ্চ শৃণুয়াদপি যো নরঃ।
সোহপি মুক্তঃ
শুভাল্লোঁকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পুণ্যকর্মণাম্”।। ( ১৮/৭১ )
যিনি
শ্রদ্ধাবান্ ও অসূয়াশূন্য হয়ে গীতা শ্রবণ করেন তিনি পাপ থেকে বিমুক্ত হয়ে
পুণ্যবানের প্রাপ্য শুভ লোক প্রাপ্ত হন। দেবী মাহাত্ম্যেও মহাদেবী বলেছেন-
“শ্রোষ্যন্তি
চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্। ( ৪/১২ )
ন তেষাং দুষ্কৃতৎ কিঞ্চিদ্ দুষ্কৃতোত্থা ন
চাপদঃ”। ( ৫/১২)
যে
আমার উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য ভক্তিসহকারে পাঠ করবে, তার কোন পাপ, বা পাপজনিত বিপদ হবে
না। আরও বলেছেন-
“তস্মান্মমৈতন্মাহাত্মং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।
শ্রোতব্যঞ্চ সদা
ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ”।। ( ১২/৭ )
সে
জন্য, আমার এই মাহাত্ম্য একাগ্রচিত্ত হয়ে ভক্তিসহকারে সকলের পাঠ ও শ্রবণ করা উচিত।
তা-ই উৎকৃষ্ট স্বস্ত্যয়ন। আরও অনেক ফলের কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা-
‘সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্’। ( ১২/২০ )
আমার
মাহাত্ম্য আমার সন্নিধিকারক। পুরাণে শ্রীভগবানও বলেছেন-
‘মদ্ভক্তো যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।’
গীতা
শ্রবণে অর্জুনের মোহ নষ্ট হল- স্মৃতি ফিরে এলো, চিত্ত স্থির হল, সকলের সংশয় কেটে
গেল। গীতা শ্রবণ করতে করতে “সুদুর্দর্শ
বিশ্বরূপ” দর্শন হল। দেবী মাহাত্ম্য চণ্ডীতে ঋষিবর চণ্ডীগ্রন্থ
শুনিয়ে শ্রোতা সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যকে দেবীর চরণে শরণাগতি গ্রহণ করতে বললেন।
“তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্।
আরাধিতা সৈব নৃণাং
ভোগস্বর্গাপবর্গদা” ।। ( ১৩/৫ )
‘সেই
পরমেশ্বরীর শরণাগত হও। তাঁকে আরাধনা করলে তিনি মানুষকে ভোগ, স্বর্গ ও অপবর্গ (
মোক্ষ বা মুক্তি ) প্রদান করে থাকেন।’ ঋষি তাঁদেরকে আরাধনায় নিযুক্ত করেছিলেন।
আরাধনার ফলে তাঁরা দেবীর সাক্ষাৎকার ও বাঞ্ছানুরূপ ফল লাভ করলেন।
এ
আলোচনায় দেখা গেল মূলত: একই মহাসত্য
সর্বত্র ঘোষিত এবং এ আলোচনা থেকে বলা যায় যে, তন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক
সত্যের দর্শনই চণ্ডী।
২
গীতার
কতিপয় বিশিষ্ট ভাব বা উপদেশ, যা চণ্ডীতে মূর্ত হয়ে সুবিকশিত হয়েছে, তা গীতার
অধ্যায়ক্রমে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।
গীতার
প্রথম অধ্যায়ে- অর্জুনের বিষাদযোগ। গীতার বিষাদযোগ, চণ্ডীতে তা
অতিবিষাদ যোগরূপে পরিস্ফুট। তাই রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্যকে ঋষি “অত্যন্ত-দুঃখিতৌ” (
১/৪৩ ) বলেছেন।
গীতার
দ্বিতীয় অধ্যায়ে- সাংখ্যযোগ। এখানে গুরুত্বে বরণ ও সাংখ্যযোগ শ্রবণ। ত্রিতাপ তাপিত
ভক্ত অর্জুন দুঃখিত ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে জগৎ গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন। তাঁর
ভাষায়, “শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্” (
গীতা, ২/৭ ) – ‘আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাগত, আমায় শিক্ষা দাও।’ তখন
ভগবান, শিষ্য অর্জুনকে প্রথমে আত্ম-জ্ঞানের উপদেশ প্রদান করেছিলেন। চণ্ডীতেও তীব্র
বৈরাগ্যযুক্ত অতি দুঃখিত ( ১/৪৩ ) রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, মেধস মুনির
আশ্রমে গিয়ে শরণাগত হলে জ্ঞান গুরু ঋষি প্রথমে ভক্ত শিষ্যের জ্ঞানের অভিমান চূর্ণ
করলেন। তারপর ক্রমান্বয়ে শক্তিময় এবং কর্মময় জগৎ রহস্য উদ্ঘাটিত করে মহামায়া
সম্বন্ধে বিশেষ তত্ত্ব জ্ঞানের উপদেশ প্রদান করেছিলেন। গীতায় সাংখ্যযোগ দ্বারা
আত্মস্বরূপ লাভের যেসব কৌশল ব্যক্ত করা হয়েছে, চণ্ডীতে তা ব্যাপকভাবে বিবিধ উদাহরণের
মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। দেহের অনিত্যতা এবং আত্মার নিত্যতা, চণ্ডীতে শুধু
উপদেশে নয়, এখানে ভগবান ও ভগবতী যুদ্ধচ্ছলে স্বয়ং অনিত্য দেহ আর অবিশুদ্ধ আসুরিক
ভাব নাশ করে সর্বত্র সত্যময় আত্মভাবের
বিকাশ দেখিয়েছেন এবং সাধককে আত্মরাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। গীতার -
“যা নিশা
সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা
পশ্যতো মুনেঃ”।। ( ২/৬৯ )
- অর্থাৎ ‘সর্বভূতের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ (
অজ্ঞাত ), সেই ব্রহ্মে স্থিতপ্রজ্ঞ জাগ্রত থাকেন ( সর্বদা ব্রহ্মদর্শন করেন )। আর,
যে অজ্ঞানরূপ রাত্রিতে ভূতগণ জাগ্রত থাকে ( সংসার দর্শন করে ) স্থিতপ্রজ্ঞের পক্ষে
তা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ তিনি সংসার অনুভব করেন না।’ এই শ্লোকটি চণ্ডীতে
“দিবান্ধাঃ
প্রাণিনঃ কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে।
কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ
প্রাণিনস্তুল্যদৃষ্টয়ঃ”।। (
১/৪৮-৪৯ )
অর্থাৎ
‘পেচকাদি কোন কোন প্রাণী দিনে দৃষ্টিশক্তিহীন; কাক প্রভৃতি অন্যান্য প্রাণী আবার
রাতে অন্ধ। কেঁচো প্রভৃতি কোন কোন প্রাণী দিন ও রাতে দৃষ্টিশক্তিহীন এবং বিড়াল ও
রাক্ষসাদি কোন কোন প্রাণী দিন ও রাতে সমান দৃষ্টিসম্পন্ন।’ এই শ্লোকে আরও ব্যাপকভাবে
অভিব্যক্ত হয়েছে। গীতার এই অধ্যায়ে-
“ধ্যায়তো
বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ
স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো
বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।” ( ২/৬২-৬৩ )
অর্থাৎ ‘ বিষয়সমূহ চিন্তা করতে করতে তাতে
মানুষের আসক্তি জন্মে, আসক্তি থেকে কামনা ( তৃষ্ণা ) হয়, কামনা প্রতিহত হয়ে ক্রোধে
পরিণত হয়, ক্রোধ হতে কর্তব্যাকর্তব্যরূপ বিবেকনাশ এবং বিবেকনাশ হতে শাস্ত্র ও
গুরুর উপদেশজনিত সংস্কারের স্মৃতিবিলোপ, স্মৃতিবিভ্রম থেকে পুরুষের ভাল-মন্দ
বিচারবুদ্ধি বিনষ্ট হয় আর বিচারবুদ্ধি বিনষ্ট হলে মানুষ পুরুষার্থের অযোগ্য হয়।’- প্রভৃতি উক্তিতে ভগবান ক্রোধ সম্বন্ধে ক্রমবিকাশ
দেখিয়ে শেষে “বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি” ( ২ /৬৩ ) বলে
যা নির্দেশ করেছেন, চণ্ডীতে এর রহস্য নিশুম্ভ বধ- লীলাতে সুন্দররূপে পরিস্ফুট
হয়েছে।
গীতার
তৃতীয় অধ্যায়ে- কর্মযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন-
“কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা
স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্
বিমুঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে”।। (
গীতা, ৩/৬ )
অর্থাৎ ‘যে মূঢ় ব্যক্তি হস্ত, পদ ও বাক্যাদি
পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় সংযত করে মনে মনে শব্দরসাদি ইন্দ্রিয়বিষয় স্মরণপূর্বক অবস্থান
করে, তাকে মিথ্যাচারী বলে।’ এই বাণীটি সুরথ ও সমাধি চরিত্রের প্রথমাংশের
অভিব্যক্তি। কেন না, তাঁরা তীব্র বৈরাগ্যযুক্ত হয়ে উভয়ে ঋষির প্রশান্তিময় আশ্রমে
বাস করা সত্ত্বেও তাঁদের চিত্তে বিষয়চিন্তা প্রবল হয়েছিল।
কর্মযজ্ঞ
সম্বন্ধে গীতার উক্তি,
“দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ” ।।( ৩/১১ )
– অর্থাৎ ‘এই যজ্ঞ দ্বারা তোমরা ইন্দ্রাদি
দেবতাগণকে সংবর্ধনা করো এবং দেবতাগণও তোমাদের বৃষ্ট্যাদি দ্বারা শস্যাদি
উৎপাদনপূর্বক অনুগৃহীত করুন। এরূপে পরস্পরের ভাবনা দ্বারা তোমরা পরম মঙ্গল লাভ
করবে।’ কিন্তু চণ্ডীতে দেবগণের অধিকার ভোগ
সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
গীতা
বলেন, “প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ। অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা
কর্তাহমিতি মন্যতে” ।। ( ৩/২৭ ) অর্থাৎ “প্রকৃতির গুণত্রয় শরীরেন্দ্রিয়াদিসংঘাতে পরিণত
হয়ে লৌকিক ও বৈদিক সমস্ত কর্ম সম্পাদন করে। অহংকার দ্বারা যাঁর চিত্ত বিমূঢ় হয়েছে,
তিনি ‘আমি কর্তা’ এরূপ মনে করেন।” – এই অহং এর কর্তৃত্ব বা অহমিকা বিনাশ
করে আত্ম স্বরূপে উদ্বুদ্ধ করাই চণ্ডীর অন্যতম সাধনা। বিশেষত গীতার উক্ত শ্লোকটি
রাজা সুরথের প্রাথমিক চিন্তা রাশিতে সুন্দররূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। আর ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি
যে সকল কাজ করেন, তা চণ্ডীতে সবিস্তারে উদাহরণসহ আলোচিত হয়েছে। এই অধ্যায়ের
শেষভাগে ( ৩/৩৯ ) ‘কামের দূষ্পূরণীয়তা’ আলোচনাপূর্বক সেই দুর্ধর্ষ শত্রুকে
বধ করার জন্য ভগবান, ভক্ত অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, চণ্ডীতে তা শুম্ভ-চরিত্রে
বিভিন্ন ও বিচিত্র অবস্থার মধ্য দিয়ে সুন্দররূপে মূর্ত বা পরিস্ফুট হয়েছে।
গীতার
চতুর্থ অধ্যায়ে- জ্ঞানযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা
ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং
স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া” ।। ( ৪/৬ )
-‘আমি জন্মরহিত, অলুপ্তজ্ঞানশক্তি-স্বভাব এবং
ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্যন্ত সর্বভূতের ঈশ্বর হয়েও সমস্ত জগৎ যার বশীভূত আমার সেই
ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকে আশ্রয় করে স্বীয় মায়া দ্বারা যেন দেহ ধারণ করি।’ এ উক্তির
সত্যময় উদাহরণ ‘চণ্ডী’। কেননা, ভগবান ও ভগবতীর বিচিত্র অবস্থাযুক্ত তিনটি আবির্ভাব
লীলা এ-তে সবিস্তারে বর্ণিত।
গীতার
অভয় বাণী-“যে যথামাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্” ( ৪/১১ )
‘যাঁরা আমাকে যে প্রকারে বা যে উদ্দেশ্যে উপাসনা করেন, আমি তাঁদের সেভাবেই বা সেই
ফলপ্রদানের দ্বারাই অনুগ্রহ করি’- চণ্ডীতে তা উদাহরণসহযোগে মূর্ত হয়েছে। যা শরণাগত
ভক্ত সাধকগণকে সর্ববিধ অনাত্মভাব থেকে রক্ষা করে এবং চতুর্বর্গ প্রদানে ধন্য করছে।
গীতার ব্রহ্মজ্ঞানময় উক্তি, “ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ
ব্রহ্মণা হুতম্।” ( ৪/২৪ ) –‘অর্পণ ( যজ্ঞপাত্র ) ব্রহ্ম, ঘৃত
ব্রহ্ম, হোমকর্তা ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম’ প্রভৃতি বাণী দ্বারা সর্বভূতে এবং
সর্বভাবে ভগবৎ বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। চণ্ডীতে- “নিত্যৈব
সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্” ( ১/৬৪ ) - ‘তিনি ( মহামায়া ) নিত্যা ( সনাতনী, জন্মমৃত্যুরহিতা
); এই জগৎ প্রপঞ্চই তাঁর বিরাট মূর্তি।’ প্রভৃতি উক্তি দ্বারা গীতার ঐসকল
ব্রহ্মজ্ঞানময় ভাবকে ভক্তিরসে অভিসিক্ত করে সরস, মধুময় ও আনন্দময় করা হয়েছে।
গীতাতে শ্রীভগবান বলছেন,
“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন
সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি
তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।। ( ৪/৩৪ )
অর্থাৎ
‘যে বিধি দ্বারা সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা বলছি, অবগত হও। প্রণিপাত ( দীর্ঘ প্রণাম
), সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা ও গুরুসেবা দ্বারা প্রসন্ন হয়ে তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী তোমাকে সেই
ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ করবেন।’ এই আদেশ ও উপদেশ, চণ্ডীর সুরথ-ঋষি সংবাদে অভিব্যক্ত হয়ে
পূর্ণরূপে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। গীতার উক্তি-
“শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপর: সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।” (
৪/৩৯ )
–‘শ্রদ্ধাবান্ ( গুরুবাক্যে ও বেদান্তোপদেশে
বিশ্বাসী ), জ্ঞাননিষ্ঠ ও মুমুক্ষু অবশ্যই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান
লাভ করে জন্মান্তরগ্রহণ বা লোকান্তরগমন না করেই শাশ্বতী শান্তি বা মোক্ষ প্রাপ্ত
হন।’ –এর সাক্ষাৎ উদাহরণ হচ্ছে চণ্ডীতে; সমাধি বৈশ্যের পবিত্র চরিত্র। তিনি মেধা
মুনির উপদেশে বাহ্যপূজারূপ ভক্তিমূলক কর্মানুষ্ঠান দ্বারা মহাশক্তির সন্তোষ বিধান
করে একমাত্র তাঁর কৃপারূপ বর দ্বারাই মুক্তিপ্রদ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।
গীতার
পঞ্চম অধ্যায়ে – সন্ন্যাসযোগ। এখানে শ্রীভগবান বললেন,
“সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ।
তয়োস্তু
কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগ বিশিষ্যতে”।। ( ৫/২)
–‘কর্মের ত্যাগ ও কর্মের অনুষ্ঠান উভয়ই
মুক্তিমার্গ; কিন্তু তাদের মধ্যে জ্ঞানহীন কর্ম সন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মের
অনুষ্ঠান উৎকৃষ্টতর।’ আরও বললেন, “যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তৎ
যোগৈরপি গম্যতে।” (৫/৫) – ‘জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসিগণ মোক্ষ নামক
যে ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হন, কর্মযোগিগণও সেই ব্রহ্মপদই লাভ করেন।’ চণ্ডীতে এর
সুদৃষ্টান্ত বিরাজিত- রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, তীব্র বৈরাগ্যযোগে কর্মত্যাগ করলেও
ঋষি পুনরায় তাঁদেরকে কর্মময় সাধনায় নিযুক্ত করে কর্মযোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন
করেছিলেন আর সমাধি বৈশ্য যে কর্মময় অনুষ্ঠান দ্বারা জ্ঞানময় সংসিদ্ধি লাভ
করেছিলেন, তা-তেও কর্মযোগের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গীতার
ষষ্ঠ অধ্যায়ে- অভ্যাস যোগ। এখানে ভগবৎ উক্তি,
“প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে
স্থিতঃ।
মনঃ
সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ।। ( ৬/১৪ )
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ।
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি।।” (
৬/১৫ )
– ‘প্রশান্তচিত্ত, ভয়রহিত, ব্রহ্মচর্য পালন ও
গুরু সেবাদি ব্রতে স্থিত, মদ্গতচিত্ত ও মৎপরায়ণ যোগী ( সাধক ) মন একাগ্র করে নিত্য ধ্যানাভ্যাস করবেন। এরূপে
সদা সংযতভাবে মন সমাহিত করে যোগী আমার স্বরূপভূত মোক্ষপ্রদ পরম শান্তি প্রাপ্ত
হন।’ এই উপদেশের অনুরূপ সাধনা চণ্ডীতে সুরথ-সমাধির চরিত্রে দেখা যায়। তাই চণ্ডীর
মন্ত্রে আছে- “নিরাহারৌ যথাহারৌ তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ”। ( ১৩/১১ ) গীতাতে অভ্যাস
যোগের সর্বশ্রেষ্ঠ উপদেশ-
“সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।। ( ৬/২৯
)
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।” ( ৬/৩০ )
–‘সমাধিমান পুরুষ সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শী হয়ে
স্বীয় আত্মাকে ব্রহ্মাদিস্থাবরান্ত সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে স্বীয় আত্মাতে দর্শন
করেন। যিনি সর্বভূতে সকলের আত্মা আমাকে
এবং সর্বাত্মা আমাতে ব্রহ্মাদি সর্বভূতকে দর্শন করেন, তাঁর ও আমার একাত্মতা হেতু
আমি তাঁর অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না।’ গীতার এই আত্মময় এবং
পরমাত্মময় উপদেশ চণ্ডীতে নানা প্রকার লীলানন্দের মধ্য দিয়ে সর্বত্র অনুস্যূত ও
সুবিকশিত।
গীতার
সপ্তম অধ্যায়ে - জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার
ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে
পরাম্।
জীবভূতাং
মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ ।।” ( ৭/৪-৫)
– ‘ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও
অহংকার –এই আট প্রকারে আমার ঐশ্বরী মায়াশক্তি ( অপরা প্রকৃতি ) বিভক্ত। হে
মহাবাহো, এটি আমার অনর্থকরী বন্ধনাত্মিকা নিকৃষ্টা প্রকৃতি। কিন্তু এ থেকে অত্যন্ত
স্বতন্ত্র আমার প্রকৃষ্টা প্রকৃতি অবগত হও। জগতের অন্তঃপ্রবিষ্ট সেই জীবভূতা
প্রকৃতি ( পরা প্রকৃতি ) এই জগৎ প্রপঞ্চ ধারণ করে আছেন।’ চণ্ডীতে এই পরা এবং অপরা
প্রকৃতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের মধ্যে বিভিন্ন শক্তিরূপে আবির্ভূতা হয়ে লীলানন্দ
প্রকাশ করেছেন। পরিশেষে সমস্ত
অপরাশক্তিসমূহ পরা প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে মহাশক্তির অদ্বিতীয় মহিমা ঘোষণা করেছেন।
গীতার “বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি” ( ৭/১০ ) ‘
আমি বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি’ এই উক্তি চণ্ডীতে আরও ব্যাপকত্ব প্রাপ্ত হয়ে মন্ত্রধ্বনি
উত্থিত হয়েছে-
“যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ
সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।” (
৫/২০-২২ )
গীতাতে ভগবৎ উক্তি – “দৈবী
হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া” ( ৭/১৪ ) ‘ আমার এই দৈবী
গুণময়ী মায়া নিশ্চয়ই দুরতিক্রম্যা’ – চণ্ডীতে গুণময়ী এবং গুণাতীতা মহামায়ার লীলা,
তত্ত্ব এবং রহস্য সমস্তই উদ্ঘাটিত হয়েছে। তাই দেবগণ মাকে স্তব করেছিলেন, “গুণাশ্রয়ে
গুণময়ে নারায়ণী নমোহস্তুতে”। ( ১১/১১ ) গীতার আর্ত,
জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী এবং জ্ঞানী এই চার প্রকার সাধকের ( ৭/১৬ ) বিবরণ চণ্ডীতে
দৃষ্টান্ত দ্বারা অভিব্যক্ত। গীতার এই অধ্যায়ের শেষ দিকে ভগবান বলেছেন, “নাহং
প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ”- ‘আমি যোগমায়া দ্বারা আবৃত বলে
সকলের নিকট প্রকাশিত হই না।’ চণ্ডীতে দৃষ্ট হয়- যোগমায়ার এই আবরণশক্তি বিষ্ণুরও ‘যোগনিদ্রা’
রূপে ক্রিয়াশীলা।
গীতার
অষ্টম অধ্যায়ে- অক্ষর ব্রহ্মযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ”।। ( ৮/১৪ )
–‘যিনি একাগ্র মনে আমাকে যাবজ্জীবন নিরন্তর
স্মরণ করেন, সেই সদা স্মরণশীল যোগীর আমি সহজলভ্য’। ভগবান আরও বলেন,
“পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা
লভ্যস্ত্বনন্যয়া।
যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং
ততম্”।। ( ৮/২২ )
– ‘হে পার্থ, সকল জীবজগৎ পরমেশ্বরের মধ্যেই
অবস্থিত। ঘটাদি যেমন আকাশ দ্বারা অন্তরে ও বাহিরে ব্যাপ্ত, সেইরূপ এই সমগ্র জগৎ
ঈশ্বর কর্তৃক পরিব্যাপ্ত। অনন্যা ভক্তি দ্বারা সেই পরম পুরুষকে লাভ করা যায়’।
মহাশক্তিময় ভগবানের এসব জ্ঞান-ভক্তিময় উক্তি চণ্ডীতে সুবিকশিত ও জীবন্তরূপ পরিগ্রহ
করে নানা প্রকারে জীব জগতের মঙ্গল সাধন করেছে, করছে এবং করবে। দেবগণ, ঋষিগণ ও সুরথ
– সমাধি প্রভৃতি সকলেই ভক্তি বলে দেব দর্শন করে কৃত কৃতার্থ। চণ্ডীতে ভগবান ও
ভগবতী যথাযথভাবে শরণাগত ভক্তগণের দুঃখ দূর করে অভীষ্ট পূরণ করেছিলেন। গীতার ক্ষর,
অক্ষর, অধ্যাত্ম, অধিদৈব প্রভৃতি তত্ত্ব চণ্ডীতে দৃষ্টান্তমধ্যে সুবিকশিত রয়েছে।
গীতার
নবম অধ্যায়ে- রাজযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা”। (
৯/৪ )
–‘আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর ও অব্যক্তমূর্তি; আমার
দ্বারা এই সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত’।
“সর্বভূতানি
কৌন্তেয় প্রকৃতি যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্”।। (
৯/৭ )
- ‘হে কৌন্তেয়, প্রলয়কালে সকল ভূত আমার ( ত্রিগুণাত্মিকা
মায়াতে ) প্রকৃতিতে লীন হয়। আবার সৃষ্টিকালে আমি তাদের সৃষ্টি করি’।
“ প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ।
ভূতগ্রামমিমং
কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ”।। ( ৯/৮ )
–
‘স্বীয় অবিদ্যারূপ ( মায়াকে ) প্রকৃতিকে বশীভূত করে প্রকৃতি পরতন্ত্র এবং
জন্মমৃত্যু-অধীন ভূতগণকে আমি পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি করি’। প্রকৃতিরূপিণী মহামায়ার এসব
তত্ত্ব চণ্ডীতে শ্রদ্ধাভক্তি দ্বারা রসময় হয়ে লীলারূপে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
গীতায় ভগবৎ উক্তি,
“অবজানন্তি
মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্” ।। ( ৯/১১ )
–‘আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব এবং সকলের
অন্তরাত্মা হলেও মনুষ্যদেহ আশ্রয়পূর্বক ব্যবহার করি বলে ( রাক্ষসী, আসুরী ও মোহিনী
প্রকৃতিতে আশ্রয়করী বিক্ষিপ্তচিত্ত ) মূঢ়গণ আমার ( আকাশকল্প ) পরমাত্মতত্ত্ব না
জেনে আমাকে অবজ্ঞা করে’।
“মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ।
রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং
শ্রিতাঃ”।। ( ৯/১২ )
–‘বৃথাশা বিফলকর্মা ও নিষ্ফলজ্ঞান অবিবেকিগণ
স্বাত্মভূত আমাকে অবজ্ঞা করার জন্য রাক্ষসী, আসুরী ও মোহিনী ( দেহাত্মবুদ্ধিকরী )
প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়ে থাকে’। এই ‘রাক্ষসী’, ‘আসুরী’ ও ‘মোহিনী’ প্রকৃতির
আশ্রিতগণের বিচিত্র ক্রিয়াশীলতাই চণ্ডীতে যুদ্ধরূপে সুচিত্রিত। গীতায় ভগবান আরও
বলেছেন,
“যৎ
করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোসি দদাসি যৎ।
যৎ
তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ম মদর্পণম্” ।। ( ৯/২৭ )
– ‘ হে কৌন্তেয়, যা অনুষ্ঠান করো, যা আহার করো,
যা হোম করো, যা দান করো এবং যে তপস্যা করো, সে সমস্তই আমাকে সমর্পণ করবে’। -এই
সমর্পণ রহস্য চণ্ডীতে অস্ত্র সমর্পণ রহস্যে বিশেষভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তাছাড়া সমর্পণ
বা শরণাগতি দ্বারাই চণ্ডী মহাগ্রন্থ নানা প্রকারে সুসজ্জিত ও অলঙ্কৃত রয়েছে।
গীতার
দশম অধ্যায়ে – বিভূতিযোগ। এখানে ভগবান জাগতিক প্রধান প্রধান চেতন
বস্তুকে ও বিশেষ অবস্থাকে ভগবৎ বিকাশরূপে ধারণা করার জন্য ভক্তকে উপদেশ দিয়ে
বলেছেন,
“যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং
শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ
ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্”।। ( ১০/৪১ )
–‘যা যা ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা উৎসাহশালী
সে সকলই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলে জেনো’। গীতার এইসব জ্ঞানময় উক্তি চণ্ডীতে আরও
ব্যাপকভাবে প্রকটিত ও ঐশ্বর্যময় ভগবতী-লীলারূপে বর্ণিত হওয়ায় তা আরও
মাধুর্য-মণ্ডিত হয়ে সুবিকশিত। এভাবে গীতার জ্ঞানময় বিভূতির সহিত ভক্তিময় শরণাগতি
এবং স্তব-স্তুতির মন্দাকিনী-ধারা সংযুক্ত হয়ে চণ্ডীতে প্রেমানন্দময়
অমৃত-প্রস্রবণের সৃষ্টি করেছে। বিশেষতঃ এ অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন, “অধ্যাত্মবিদ্যা
বিদ্যানাং” ( ১০/৩২ ) অর্থাৎ ‘বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি
অধ্যাত্ম বিদ্যা’ । এরূপে স্বয়ং ভগবান আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানময় ভাব স্বীকারপূর্বক
সকল বিদ্যার মধ্যে এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথিত গীতার
অধ্যাত্ম বিদ্যা দেবী মাহাত্ম্যের সর্বত্র নানা প্রকারে মূর্ত ও পরিস্ফুট হয়েছে।
গীতার
একাদশ অধ্যায়ে – বিশ্বরূপদর্শনযোগ। এখানে
ভগবান প্রথমেই দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রভৃতির
অভিব্যক্তি ভক্ত অর্জুনকে দেখালেন। আর, ঋগ্বেদের অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবীসূক্ত; যাতে
চণ্ডী-ত্ত্ত্ব বীজাকারে বিরাজমান, সেই দেবীসূক্তেও মহাশক্তির সহিত অভেদাত্মক
অনুভূতিতে মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু
প্রভৃতি ধারণ করার উল্লেখ করে অপূর্ব শক্তির পরিচয় প্রদান করেছেন। গীতাতে অর্জুনকে
বিভূতি দেখার জন্য ভগবান ‘দিব্যচক্ষু’ প্রদান করেছিলেন। অর্জুন তথাপি
বিভূতি দর্শনে ভীত হয়ে তা সংবরণের নিমিত্ত প্রার্থনাপূর্বক ভগবানকে পুনঃ পুনঃ
নমস্কার করেছিলেন। কিন্তু চণ্ডীতে সাধক ভক্তগণ আরও উন্নত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ায়
তাঁরা সাক্ষীভাবে বীর্যময় অপূর্ব শক্তিলীলা দর্শনে সমর্থ হয়েছিলেন। গীতাতে
অর্জুনের উক্তি,
“অমী চ ত্বাং
ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ
সর্বে
সহৈবাবনিপালসঙ্ঘৈঃ।
ভীষ্মো দ্রোণঃ
সূতপুত্রস্তথাহসৌ
সহাস্মদীয়ৈরপি
যোধমুখ্যৈঃ।। ( ১১/২৬)
বক্ত্রাণি তে
ত্বরমাণা বিশন্তি
দংষ্ট্রাকরালানি
ভয়ানকানি।
কেচিদ্বিলগ্না
দশনান্তরেষু
সংদৃশ্যন্তে
চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ।। ( ১১/২৭ )
অর্থাৎ
‘রাজন্যবর্গ সহ ঐ ধার্তরাষ্ট্রগণ এবং মৎপক্ষীয় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি প্রধান
যোদ্ধাগণ, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের সহিত আপনার দংষ্ট্রাকরাল ভীষণ মুখগহ্বরে
দ্রুতবেগে প্রবেশ করছেন। মুখপ্রবিষ্টদের মধ্যে কেউ কেউ চুর্ণিতমস্তক হয়ে ভক্ষিত
মাংসখণ্ডসমূহের ন্যায় আপনার দন্তসন্ধিস্থলে সংলগ্ন হচ্ছেন, দেখছি’। গীতার এই ভীষণ অভিব্যক্তি চণ্ডীতে
ভীষণতর হয়ে করালভাব প্রাপ্ত হয়েছে। তাই চণ্ডীতে চামুণ্ডার বিবরণে দেখা যায়-
“পার্ষ্ণিগ্রাহাঙ্কুশগ্রাহি-যোধ-ঘণ্টা-সমন্বিতান্।
সমাদায়ৈকহস্তেন মুখে চিক্ষেপ বারণান্।। ( ৭/১০ )
তথৈব যোধং তুরগৈঃ রথং সারথিনা সহ।
নিক্ষিপ্য বক্ত্রে
দশনৈশ্চর্বয়ত্যতিভৈরবম্।। ( ৭/১১ )
অর্থাৎ
‘পৃষ্ঠরক্ষক, মহামাত্র ( মাহুত ), ( গজারূঢ় ) বীর ও গলঘণ্টাদি-সংযুক্ত হস্তিসকলকে
একহস্তে গ্রহণ করে চামুণ্ডা মুখে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। এরূপে চামুণ্ডা অশ্বের সহিত
অশ্বারোহী যোদ্ধাকে এবং সারথির সহিত রথকে বদনমধ্যে নিক্ষেপ করে দন্তসমূহ দ্বারা
অতি ভীষণরূপে চর্বণ করতে লাগলেন’।
এরূপে
চন্ডীর দেবীযুদ্ধ ‘দারুণ’ ও ‘সর্বলোক ভয়ঙ্কর’ হলেও সাক্ষীরূপে
অবস্থিত দেবগণ, মহর্ষিগণ এবং ভক্তগণ, এখানে অভয়া মায়ের অপূর্ব শক্তিলীলা দর্শনে
বিস্মিত, পুলকিত এবং প্রেমভক্তিতে অবনত।
ভগবান গীতায় অর্জুনকে বিশ্বরূপ
দর্শনকালে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভাবী-চিত্র দেখিয়ে বলেছিলেন,
“ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্” –
‘আমার দ্বারা এরা ( ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধা ) পূর্বেই
নিহত হয়েছে। হে সব্যসাচী, তুমি নিমিত্তমাত্র হও’। এই ‘নিমিত্তমাত্র হও’
উক্তিটি গীতার একটি বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক স্তর নির্দেশ করে। সাধনার এই স্তরে নিজ
কর্তৃত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয় না, কিন্তু চণ্ডীতে দেবীযুদ্ধ বা আধ্যাত্মিক সাধনার
স্তর আরও উচ্চে অবস্থিত। সেখানে একদিকে গীতার ‘নিমিত্তমাত্র’ ভাবটিকেও
শক্তিরূপিণী প্রকৃতির কার্য বলে অনুভব করতে হবে এবং তৎসহ স্বকীয় নির্লিপ্ত
আত্মবোধময় সাক্ষীভাব জাগিয়ে তুলতে হবে। অপরদিকে সর্ববিধ কর্তৃত্বাভিমান ভগবচ্চরণে
সমর্পণ করে শরণাগত হতে হবে। তখন ভক্ত সাধক সাক্ষীভাবে দর্শন করবেন; মহাশক্তি
পরমাত্মময়ী মা স্বয়ং ভক্তের পক্ষে সর্বাবস্থায় যুক্ত রয়েছেন; যেখানে ‘নিমিত্তমাত্র’
হওয়ার ভাবটিও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এখানেই গীতার
সহিত চণ্ডীর আধ্যাত্মিক স্তরের পার্থক্য।
গীতার
দ্বাদশ অধ্যায়ে- ভক্তিযোগ। এখানে ভগবান অভ্যাসযোগ দ্বারা চিত্ত
স্থির ও ভক্তিলাভের উপায় নির্দেশ করার পর বলেছেন,
“অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্র করুণ এব চ।
নির্মমো
নিরহংকারঃ সমদুঃখসুখ ক্ষমী।।
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে
প্রিয়ঃ”।। ( ১২/১৩-১৪ )
–‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন,
মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে
দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা
তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয়
ভক্ত’। এই ভগবৎ উক্তির অন্তর্গত ‘নিরহংকার’ এবং ‘মমত্ব’হীনতাই
চণ্ডীতে ‘অহংমমেতি’ ভাব বিনাশদ্বারা আত্মভাব ও প্রেমভাব লাভে পর্যবসিত
হওয়ায়, সুবিকশিত ! এই ভাব দু’টি লাভ হলে ভগবৎ কথিত অন্যান্য অবস্থাসমূহ আপনা থেকেই
লব্ধ হয়।
গীতার
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে- ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ। এখানে
চতুর্বিংশতি তত্ত্বময় শরীরকে ক্ষেত্র বলা হয়েছে আর ক্ষেত্রজ্ঞ নির্ণয় করে ভগবান
বলেছেন,
“সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।। ( ১৩/১৪ )
– ‘তিনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে বিরাজিত
আছেন। সকল শরীরের হস্ত ও পদ, চক্ষু ও কর্ণ, মস্তক ও মুখ তাঁর হস্ত ও পদ, চক্ষু ও
কর্ণ এবং মস্তক ও মুখ’।
“সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং
সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
অসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ”
।। ( ১৩/১৫ )
- ‘তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়-বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ
ইন্দ্রিয়-বিবর্জিত, সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সমুদয় গুণের
আশ্রয়’। “ভূতভর্তৃ চ তজ্জ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ” ( ১৩/১৭ ) –‘তিনি
সর্বভূতের পালক, সংহারক ও স্রষ্টা’। - এ সম্বন্ধে এবং দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে চণ্ডীতে
নানা প্রকার রহস্য এবং সাধন-তত্ত্ব বিশেষরূপে ব্যাক্ত হয়েছে। ভগবান বলেছেন,
“প্রকৃত্যৈব
চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্বশঃ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্তারং স পশ্যতি”।। ( ১৩/৩০
)
–‘প্রকৃতিই সর্বভাবে সকল কর্ম করেন এবং আত্মা
অকর্তা, যিনি এরূপ দর্শন করেন, তিনিই যথার্থদর্শী’। - গীতার এই প্রকৃতি-তত্ত্ব এবং
প্রকৃতির প্রাধান্য চণ্ডীতে বিভিন্ন অবস্থায় ব্যাপকভাবে অভিব্যাক্ত হয়েছে।
গীতার
চতুর্দশ অধ্যায়ে- গুণত্রয়বিভাগযোগ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই গুণত্রয় চণ্ডীতে তিনটি চরিত্রে বিরাটরূপে
পরিস্ফুট হয়েছে। কেননা, ত্রিগুণের অভিব্যক্তিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং
দৃশ্যমান জীব জগৎ ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির রহস্যই চণ্ডীর চরিত্রাবলিতে সর্বত্র
উদ্ঘাটিত এবং উজ্জ্বলীকৃত।
গীতার
পঞ্চদশ অধ্যায়ে- পুরুষোত্তম যোগ। এখানে ভগবান বলেছেন, “মমৈবাংশো
জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ”। ( ১৫/৭ ) –‘সংসারে কর্তাভোক্তারূপে
প্রসিদ্ধ জীব আমারই সনাতন অংশ’। -এই ভাবটি চণ্ডীর প্রথম শ্লোক থেকেই ক্রমে বিকাশ
প্রাপ্ত হয়ে পরিশেষে চতুর্বর্গ ফলদায়ক বিরাট কল্পতরুরূপে পরিণত হয়েছে। এখানে
বর্ণিত ‘ক্ষর’, ‘অক্ষর’ এবং ‘পুরুষোত্তম’ ভাবসমূহ চণ্ডীতে মূর্ত হয়ে
সুবিকশিত হয়েছে।
গীতার
ষোড়শ অধ্যায়ে- দৈবাসুর-সম্পদবিভাগযোগ। এখানে বিবৃত সাতাশটি
দৈবী সম্পদ এবং তৎ বিপরীত সাতাশটি আসুরী সম্পদই চণ্ডীতে দেবাসুর
সংগ্রামের মৌলিক উপাদানস্বরূপ। এ অধ্যায়ে বর্ণিত দৈবী ও আসুরী প্রকৃতিসমূহ চণ্ডীর
সর্বত্র মূর্তি গ্রহণপূর্বক সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হয়ে দেবী যুদ্ধরূপে আত্মপ্রকাশ
করেছে। সুতরাং এই অধ্যায়ে প্রতিপাদ্য দৈবাসুর সম্পদই যে চণ্ডীতে ক্রমবিকাশ প্রাপ্ত
হয়ে অপূর্ব সাধন-রহস্য পরিব্যক্ত করেছে এ সম্বন্ধে কোন বিতর্ক বা সন্দেহের
অবকাশ নেই। ‘গীতার পরবর্তী বা পরিপূরক অবস্থা চণ্ডী’-এ বাক্যের সত্যতা ও
সার্থকতা গীতার এই অধ্যায়ে বিশেষরূপে ব্যক্ত ও প্রমাণিত।
গীতার
সপ্তদশ অধ্যায়ে- শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ। এখানেও
ত্রিগুণের বিশেষ বিশেষ অবস্থা আলোচিত। চণ্ডীতে সত্ত্ব, রজঃ, তমোগুণেরই বিরাট
অভিব্যক্তি। এ সম্বন্ধে ইতোপূর্বে গুণত্রয় বিভাগ অধ্যাযে উল্লেখ করা হয়েছে।
গীতার
অষ্টাদশ অধ্যায়ে –মোক্ষযোগ। এখানে ভগবান কামনামূলক কর্মত্যাগ ও
কর্মফল ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে উপদেশ দিয়েছেন। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি উপদেশে
বলেছেন,
“যস্য নাহঙ্কৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন
লিপ্যতে।
হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ন হন্তি ন নিবধ্যতে”।। (
১৮/১৭ )
–‘আমি
কর্তা এই অভিমান যাঁর নেই এবং যাঁর বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সমস্ত
প্রাণী হত্যা করলেও হত্যাকারী হন না, বা হত্যা ক্রিয়ার ফলে আবদ্ধ হন না’। এর
ভাবার্থ হচ্ছে –‘যাঁর অহংকার ভাব নেই, যিনি নির্লিপ্তভাবে কর্ম করেন, তিনি সর্ববিধ
কর্ম করেও কর্ম-বন্ধনে আবদ্ধ হন না’। এতৎব্যতীত এখানে ত্রিগুণভেদে জ্ঞানের ত্রিবিধ
ভাব বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর ভগবান বলেছেন,
“অহঙ্কারং
বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্।
বিমুচ্য
নির্মমঃ শান্তো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে”।। ( ১৮/৫৩ )
–‘অহংকার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ ত্যাগ
করে মমতাবর্জিত এবং প্রশান্ত চিত্ত মানুষ ব্রহ্মজ্ঞানলাভে সমর্থ হন’। -এসব ভগবৎ
উক্তিই চণ্ডীতে বৈচিত্র্যময় উদাহরণের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঋদ্ধ হতে হতে
পরিপূর্ণত্ব লাভ করেছে।
গীতার এই অধ্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - শরণাগত
হওয়ার জন্য ভগবানের পুনঃ পুনঃ আদেশ এবং উপদেশ। আবার চণ্ডী বা দেবী মাহাত্ম্যে,
শরণাগতিরই প্রেমানন্দময় সমুজ্জ্বল বিকাশ দ্বারা সর্বতোভাবে উদ্ভাসিত। এরূপে
গীতার অন্যান্য শ্লোকসমূহও বিচার করলে দেখা যায় যে, বহু শ্লোকের ভাব চণ্ডীতে
সুনিপুণ উদাহরণের মধ্যে মূর্ত হয়ে জ্ঞানী, কর্মী, যোগী এবং ভক্ত সকলেরই যথাযথ
সাধন-পন্থা সুগম করতঃ তাঁদের অভীষ্ট
সিদ্ধি বা মোক্ষ প্রাপ্তির সহজ উপায় নির্দেশ করে দিয়েছে। সুতরাং সপ্তশতী
অনুধ্যানে সর্বশ্রেণির সাধকগণ অমৃতত্ব লাভে ধন্য ও কৃতকৃতার্থ হবেন - এরূপ বলা
চলে।
৩
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
ও দেবী-মাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীর বিভিন্ন শ্লোকের মধ্যে ভাব ও ভাষাগত আশ্চর্য মিল
পরিলক্ষিত হয় । দৃষ্টান্তস্বরূপ কতিপয় শ্লোক উল্লেখ করা হলোঃ-
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষ্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি
প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।। গীতা, ২/৬০
-‘হে
কুন্তীপুত্র, বিক্ষেপকারী ইন্দ্রিয়গণ অতি যত্নশীল মেধাবী ( শাস্ত্রজ্ঞ ) পুরুষের
মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে’।
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাদাকৃষ্য মোহায়
মহামায়া প্রযচ্ছতি।। চণ্ডী, ১/৫৫-৫৬
-‘বিবেকিগণেরও
কি কথা? দেবী ভগবতী মহামায়া বিবেকিগণেরও চিত্তসমূহ বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত
করেন’।
অর্জুন উবাচ
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষেয়
বলাদিব নিয়োজিতঃ।। গীতা, ৩/৩৬
-‘অর্জুন
জিজ্ঞাসা করলেন, হে কৃষ্ণ, মানুষ কার
দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপানুচরণে প্রবৃত্ত
হয়?’
রাজোবাচ
তৎ কেনৈতন্মহাভাগ
যন্মোহ জ্ঞানিনোরপি।
মমাস্য চ ভবত্যেষা
বিবেকান্ধস্য মূঢ়তা।। চণ্ডী, ১/৩৯,৪৪-৪৫
-‘রাজা
সুরথ মেধা মুনিকে বললেন- হে মহামতি, রূপরসাদি বিষয় দোষযুক্ত- তা ইনি ও আমি জানি।
তথাপি আমাদের এই মোহ কি হেতু হচ্ছে? এরূপ মূঢ়তা বিবেকহীন ব্যক্তিরই হয়ে থাকে’।
যদা যদাহি
ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যূত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং
সৃজাম্যহম্।। গীতা, ৪/৭
-‘হে
ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যূদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও
অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়া বলে দেহবান্ হই, যেন জাত হই’।
ইত্থং যদা যদা
বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি ।।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্ ।।
চণ্ডী, ১১/৫৪-৫৫
-‘এ প্রকারে
যখনই দানবগণের প্রাদুর্ভাববশতঃ বিঘ্ন উপস্থিত হবে তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে
দেব-শত্রু অসুরগণকে বিনাশ করবো’।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।। গীতা, ৪/৮
-‘সাধুদের
রক্ষার জন্য, দুষ্টদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে
নরাদিরূপে অবতীর্ণ হই’।
দৈত্যানাং
দেহনাশায় ভক্তানামভয়ায় চ।।
ধারয়ন্ত্যায়ুধানীত্থং দেবানাঞ্চ হিতায় বৈ।
চণ্ডী, দেবীকবচ-১৬
-‘বহু
দিব্য অস্ত্র দৈত্যগণের দেহ নাশের জন্য, ভক্তগণকে অভয়দানের জন্য এবং দেবতাগণের
হিতের জন্য ধরণ করেন’।
মত্তঃ পরতরং
নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়।
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।
গীতা, ৭/৭
-‘হে
ধনঞ্জয়, আমা অপেক্ষা জগতের অন্য শ্রেষ্ঠ কারণ নেই। যেমন সূত্রে মণিসমূহ গ্রথিত হয়ে
থাকে, সেরূপ এই পরিদৃশ্যমান জগৎ আত্মভূত আমাতে অনুস্যূত ও বিধৃত রয়েছে’।
একৈবাহং
জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো
মদ্ বিভূতয়ঃ।। চণ্ডী, ১০/৫
-‘একা মাত্র আমিই এই জগতে বিরাজিতা।
মদ্ব্যতিরিক্ত আমার সহায়ভূতা অন্যা দ্বিতীয়া আর কে আছে? রে দুষ্ট, ব্রহ্মাণীপ্রমুখ
এসকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি ( শক্তি ) । এই দেখ এরা আমাতেই বিলীনা হচ্ছে’।
দৈবী হ্যেষা
গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে
মায়ামেতাং তরন্তি তে।। গীতা, ৭/১৪
-‘কারণ
আমার এই ত্রিগুণাত্মিকা অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া অতিক্রম করা অতিশয় কষ্টকর। কিন্তু
যাঁরা ধর্মাধর্ম পরিত্যাগপূর্বক আমাকে আশ্রয় করেন এবং অন্য প্রকার সাধনের উপর
নির্ভর করেন না, তাঁরাই কেবল আমার এই দুস্তর মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন, অর্থাৎ
সংসার-বন্ধন হতে মুক্ত হন’।
তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।
মহামায়াপ্রভাবেণ
সংসারস্থিতিকারিণা।। চণ্ডী, ১/৫৩
-‘তথাপি
সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে জীবগণ মোহরূপ গর্তে মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত
হয়’।
নান্তোহস্তি মম
দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ।
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো
বিভুতের্বিস্তরো ময়া।। গীতা, ১০/৪০
‘হে
অর্জুন, আমার দিব্য বিভূতির অন্ত নেই ; আমি সংক্ষেপে এই সকল বিভূতির বর্ণনা
করলাম’।
দেব্যুবাচ।
অহং বিভূত্যা
বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।
তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব তিষ্ঠাম্যাজৌ
স্থিরো ভব।। চণ্ডী, ১০/৭-৮
‘দেবী
বললেন- এই যুদ্ধে স্বীয় শক্তি প্রভাবে ( মায়া দ্বারা ) আমি যে সকল মূর্তিতে
অবস্থান করছিলাম সে-সকল এক্ষণে উপসংহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে একাকিনীই রইলাম। তুমি
যুদ্ধে স্থির হও’।
যদ্ যদ্
বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম
তেজোহংশসম্ভবম্।। গীতা, ১০/৪১
‘যা
যা ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা উৎসাহশালী সে সকলই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলে
জানবে’।
পশ্যৈতা দুষ্ট
ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্ বিভূতয়ঃ ।। চণ্ডী, ১০/৫
-‘রে
দুষ্ট, ব্রহ্মাণীপ্রমুখ এসকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি ( শক্তি ) । এই দেখ এরা
আমাতেই বিলীনা হচ্ছে’।
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং
কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ।। গীতা, ১০/৪২
অথবা
হে অর্জুন, আমার বিভূতির এত অধিক জানবার
তোমার প্রয়োজন কি? এইমাত্র জেনে রাখো যে, আমিই এক পাদমাত্র ( আমার একাংশ ) দ্বারা
সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত করে রয়েছি’।
হেতুঃ
সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।
সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূত-
মব্যাকৃতা হি পরমা
প্রকৃতিস্ত্বমাদ্যা ।। চণ্ডী, ৪/৭
-‘আপনি
সমগ্র জগতের মূল কারণ। আপনি সত্ত্বাদি গুণময়ী হলেও রাগদ্বেষাদি দোষযুক্ত ব্যক্তি
আপনাকে জানতে পারে না। আপনি শিবাদি দেবগণেরও অজ্ঞাত। ব্রহ্মা হতে কীট পর্যন্ত এই
অখিল বিশ্ব আপনার অংশভূত। কারণ, আপনিই সকলের আশ্রয় স্বরূপা। আপনি ষড়্ বিকার রহিতা
পরমা আদ্যা প্রকৃতি’।
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং
সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ।। গীতা, ১৮/৬৬
-‘সকল
ধর্মাধর্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্বক গর্ভ, জন্ম, জরা ও মৃত্যুবর্জিত পরমেশ্বররূপ
একমাত্র আমার শরণাগত হও। আমা হতে অতিরিক্ত কোন বস্তুই নেই, এরূপ দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে
আমাকে সদা স্মরণ করো। তুমি এরূপ নিশ্চিতবুদ্ধিযুক্ত ও স্মরণশীল হলে তোমার নিকট আমি
স্বাত্মভাব প্রকটিত করে সকল ধর্মাধর্ম বন্ধনরূপ পাপ হতে তোমাকে মুক্ত করবো। অতএব,
শোক করো না’।
তামুপৈহি মহারাজ
শরণং পরমেশ্বরীম্ ।।
আরাধিতা সৈব নৃণাং
ভোগস্বর্গাপবর্গদা ।। চণ্ডী, ১৩/৪-৫
-‘হে
মহারাজ, সেই পরমেশ্বরীরই শরণাগত হও। তাঁকে ভক্তিপূর্বক আরাধনা করলে তিনিই ইহলোকে
অভ্যূদয় এবং পরলোকে স্বর্গসুখ ও মুক্তিপ্রদান করবেন’।
য ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি।
ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা
মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ ।। গীতা, ১৮/৬৮
-‘এই
গীতা পাঠ ও ব্যাখ্যা দ্বারা আমি ভগবানের শুশ্রূষা করছি- এই জ্ঞানে যিনি এই পরম
গুহ্য গীতাশাস্ত্র আমার ভক্তের নিকট পাঠ ও ব্যাখ্যা করবেন, তিনি পরা ভক্তি লাভ করে
আমাকে প্রাপ্ত হবেনই, এতে সন্দেহ নেই’।
তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং
পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।
শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং
স্বস্ত্যয়নং হি তৎ ।। চণ্ডী, ১২/৭
-‘অতএব
আমার এই মাহাত্ম্য সমাহিতচিত্তে নিত্য ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করা কর্তব্য। কারণ
তা অতিশয় মঙ্গলজনক’।
গীতার প্রশস্তিতে বলা হয়েছে :
গীতা
সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মবিনিঃসৃতা ।।
-‘যে
গীতা সাক্ষাৎ ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্ম হতে নিঃসৃতা, তা উত্তমরূপে পাঠ করা
কর্তব্য ; অন্যান্য অধিক শাস্ত্রপাঠের
প্রয়োজন কি?’
শ্রীশ্রীচণ্ডীর
মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে :
যথাশ্বমেধঃ ক্রতুষু দেবানাং চ যথা হরিঃ।
স্তবানামপি সর্বেষাং তথা
সপ্তশতীস্তবঃ ।। -বারাহীতন্ত্র
-‘যেমন
অশ্বমেধ সকল যজ্ঞের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যেমন হরি দেবতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ
স্তবসমূহের মধ্যে সপ্তশতী স্তব ( চণ্ডী ) শ্রেষ্ঠ’ ।
ভারতীয়
সংস্কৃতির সমগ্ররূপ দর্শন ও অনুধাবন করতে হলে বৈদিক ও তান্ত্রিক দু’টি ধারা
সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ অবগত হতে হয়। কেননা, সুপ্রাচীন
কাল থেকেই বেদের দার্শনিক সিদ্ধান্তসমূহ তন্ত্রের পূজাদি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত
হয়ে একে অন্যের অভাব পূরণ করছে। কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে যজ্ঞ ও পূজা উভয়ই
অপরিহার্য। যজ্ঞ বেদের দান আর পূজা তন্ত্রের। বেদ ও তন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক। তাই
তো ভারতীয় সংস্কৃতির আধ্যাত্মিকরূপ উপলব্ধি করতে হলে দু’টি ধারার পূর্ণতা প্রাপ্ত
দু’টি গ্রন্থ ; গীতা ও চণ্ডী অধ্যয়ন অপরিহার্য। দু’টি গ্রন্থই একে অপরের পরিপূরক।
সহায়কগ্রন্থ
:-
১।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯৩
২।
শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯২
৩।
সপ্তশতী-সমন্বিত চণ্ডীচিন্তা, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, শ্রীমহানামব্রত কালচার্যাল
এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কলিকাতা, ১৪০১ বাংলা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন