১. শৈলপুত্রী
বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
বৃষারূঢ়াং
শূলধরাং শৈলপুত্রীং যশস্বিনীম্ ।।
মা দুর্গার নবরূপের প্রথম রূপটি ‘শৈলপুত্রী’
নামে প্রসিদ্ধ। পর্বতরাজ হিমালয়ের কাছে কন্যারূপে জন্ম গ্রহণ করায় তাঁর ‘শৈলপুত্রী’
নাম হয়। বৃষভ-বাহনা, মাতৃরূপের দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল আর বাম হস্তে কমল-পুষ্প শোভা বর্ধন
করেছে।
পূর্ব জন্মে ইনি প্রজাপতি দক্ষের কন্যা ছিলেন, তখন তাঁর নাম ছিল ‘সতী’।
ভগবান শঙ্করের সঙ্গে সতীর বিবাহ হয়েছিল। একবার প্রজাপতি দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞ করেন। এতে
তিনি সকল দেবতাকে নিজ নিজ যজ্ঞ-ভাগ গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু ভগবান শঙ্করকে
তিনি এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করেন নি। সতী যখন জানতে পারলেন, তাঁর পিতা এক বিশাল যজ্ঞের
আয়োজন করেছেন, তখন তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি আপন ইচ্ছাটি শঙ্করকে
জানালে শঙ্কর সব দিক বিবেচনা করে বললেন—“প্রজাপতি দক্ষ কোন
কারণে আমার ওপর রুষ্ট হয়েছেন। তিনি তাঁর যজ্ঞে সব দেবতাদের আমন্ত্রণ করেছেন, তাঁদের
যজ্ঞ-ভাগও সমর্পণ করেছেন। কিন্তু তিনি জেনেশুনেই আমাকে ডাকেন নি। কোন খবর পর্যন্ত দেন নি। এরূপ অবস্থায় ঐস্থানে তোমার
যাওয়া কখনওই ঠিক হবে না।” শ্রীশঙ্করের এই কথায় সতী কোন সমাধান পেলেন না। পিতার যজ্ঞ
দেখার জন্য, মা এবং বোনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল হলেন। তাঁর
প্রবল আগ্রহ দেখে ভগবান শঙ্কর যজ্ঞে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলেন।
সতী পিতৃগৃহে এসে দেখলেন কেউই তাঁর সঙ্গে সমাদর বা প্রীতিপূর্বক ব্যবহার
করছে না। সকলেই যেন এড়িয়ে যাচ্ছে। একমাত্র তাঁর মা-ই তাঁকে স্নেহভরে জড়িয়ে ধরলেন। বোনদের
ব্যবহারে ব্যঙ্গ আর উপহাস ফুটে উঠল। আত্মীয়-স্বজনদের এই ব্যবহারে তিনি মনে খুব দুঃখ
পেলেন। তিনি আরও লক্ষ্য করলেন যে, চতুর্দিকে যেন শঙ্করের প্রতি ভর্ৎসনা প্রকাশ পাচ্ছে।
দক্ষ তাঁকে কিছু অপমানজনক কথাও শোনালেন। এইসব দেখে সতীর হৃদয় ক্ষোভ, গ্লানি এবং ক্রোধে
উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন, শঙ্করের নিষেধ না শুনে এখানে এসে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছেন।
তিনি, পতি শঙ্করের এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না। তৎক্ষণাৎ যোগাগ্নির সাহায্যে
নিজেকে ভস্মীভূত করলেন। বজ্রপাতের ন্যায় এই দারুণ-দুঃখের ঘটনা শুনে শঙ্কর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ
হয়ে নিজের পার্শ্বচরদের পাঠিয়ে দক্ষের যজ্ঞ সম্পূর্ণ ধ্বংস করলেন।
সতী যোগাগ্নির সাহায্যে ভস্মীভূত হয়ে পরজন্মে শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যারূপে
জন্ম নিলেন এবং এই জন্মে ‘শৈলপুত্রী’ নামে পরিচিত হলেন। পার্বতী, হৈমবতীও তাঁরই নাম।
উপনিষদের কাহিনী অনুসারে ইনি হৈমবতী নামে দেবতাদের দর্প চূর্ণ করেছিলেন।
‘শৈলপুত্রী’রও শঙ্করের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল। পূর্বজন্মের ন্যায় এই জন্মেও
তিনি শিবের অর্ধাঙ্গিনী ছিলেন। নবদুর্গার মধ্যে প্রথম দুর্গা শৈলপুত্রীর মহত্ব ও শক্তি
অনন্ত। নবরাত্রি পূজার প্রথম দিনে এঁকেই পূজা ও আরাধনা করা হয়। প্রথম দিনের পূজায় যোগী
তাঁর মনকে ‘মূলাধার’ চক্রে স্থিত করেন। এখান থেকেই তাঁর যোগ সাধনা শুরু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন