সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

প্রীতি : শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুপ্রীতি


প্রীতি একটি মহৎ গুণ। প্রীতি বলতে সন্তোষ, তৃপ্তি, অনুরাগ, বন্ধুত্ব প্রভৃতি বোঝায়। প্রীতি জীবনকে সুন্দর ও সহনীয় করে এবং সমাজকে শান্তিময় করে তোলে। স্নেহ, ভক্তি ও প্রীতি মূলত অনুরাগ বা প্রাণের টানকে বোঝায় । এই প্রীতি যখন ছোটদের প্রতি দেখানো হয়, তখন তাকে বলে স্নেহ। আবার যখন গুরুজন বা ঈশ্বরের প্রতি দেখানো হয়, তখন তাকে বলে ভক্তি। বন্ধু স্থানীয় এবং বন্ধুদের প্রতি প্রাণের
টানকে সাধারণত প্রীতি বলা হয়। প্রীতি জাগ্রত হলে মানুষ আর স্বার্থপর হতে পারে না। তখন অপরের দুঃখ দূর করাতেই তাঁর আনন্দ, তাঁর তৃপ্তি। প্রীতিপূর্ণ হৃদয় সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে। হাসিমুখে তিনি জীবনের সকল দুঃখ সহ্য করেন। প্রীতির কারণে বন্ধুর দুঃখ নিজের দুঃখ বলে মনে হয়। তা দূর করার জন্য প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়। জীবের মধ্যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। তাই জীবের প্রতি প্রীতিপূর্ণ আচরণ করলে, ঈশ্বরের প্রতিই প্রীতিপূর্ণ আচরণ করা হয়। ঈশ্বর তাতে সন্তুষ্ট হন। প্রীতি একটি সুকুমার প্রবৃত্তি এবং ধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ। সহপাঠী শ্রীদামের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অসাধারণ প্রীতি ছিল, শ্রীমদভাগবত থেকে সেই উপাখ্যানটি এখন আমরা জানব। শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুপ্রীতি যখনকার কথা বলছি, শ্রীকৃষ্ণ তখন কংসকে বধ করেছেন। মথুরাবাসী অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। ভক্তরা সানন্দচিত্তে হরিগুণ কীর্তন করছেন। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের অনুরোধে নন্দরাজ ব্রজধামে ফিরে গেলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম তখন নবরূপে নতুন লীলা করতে তৎপর হলেন। কংসের পিতা উগ্রসেনকে মথুরার সিংহাসনে বসালেন। তারপর বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাঁরা দু’জনে সান্দীপনি মুনির আশ্রমে গেলেন। সেখানে যে সকল সহপাঠী তাঁরা পেয়েছিলেন, শ্রীদাম ছিলেন তাঁদের একজন। শ্রীদামকে আদর করে অনেকে সুদামা বলেও ডাকে। বিদ্যাশিক্ষা শেষ হলো । সহপাঠীরা যে যাঁর গৃহে ফিরে গেলেন। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার রাজা আর শ্রীদাম দরিদ্র গৃহস্থ। শ্রীদাম ছিলেন ধার্মিক ব্রাহ্মণ । তিনি ধর্মকর্ম এবং বিদ্যাচর্চায় দিন কাটাতেন। কোনদিন আহার জুটতো, কোনদিন জুটতো না। তাঁর স্ত্রীও মলিন বসনে অনাহারে অর্ধাহারে দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতেন। একদিন শ্রীদামকে তাঁর স্ত্রী বললেন, - শুনছ? আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিনা । আমার শরীর কাঁপছে। অনাহারে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ তোমার বন্ধু। একসাথে একই গুরুর পাঠশালায় পাঠ গ্রহণ করেছ। - তা করেছি, কিন্তু সে কথা কেন? - শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির কথা, দয়ার কথা আমি শুনেছি। তিনি দাতারূপেও বিখ্যাত। তাঁর কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফিরে আসে না। - কিন্তু আমি যাব বন্ধুর কাছে ভিক্ষা করতে ? - শুধু বন্ধুর কাছে কেন, তুমি যাবে একজন দানবীর রাজার কাছে। অনেক ভাবলেন শ্রীদাম। যাবেন কি যাবেন না। শেষে ঠিক করলেন, আর কিছু হোক আর না হোক, শ্রীকৃষ্ণ দর্শন তো হবে। কিন্তু খালি হাতে তো বন্ধুর বাড়ি যাওয়া যায় না। এদিকে ঘরে যে কিছুই নেই । তখন ব্রাহ্মণী প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চার মুঠো চিড়ে চেয়ে আনলেন। তারপর পুরান কাপড়ের মধ্যে সেই চিড়ে বেঁধে দিলেন। শ্রীদাম পৌঁছলেন দ্বারকায়। অনেক মহল পার হয়ে পৌঁছলেন শ্রীকৃষ্ণের মহলের কাছে। প্রবেশ করলেন শ্রীকৃষ্ণের কক্ষে । শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামকে দেখলেন দূর থেকে। তাড়াতড়ি ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন শ্রীদামকে। একজন দ্বারকার রাজা, পরনে রাজার পোশাক , আরেকজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ, ছেঁড়া ময়লা তাঁর কাপড়-চোপড়। দু’জনে অনেকদিন পর দু’জনকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামকে নিজ পালঙ্কে বসিয়ে নিজের হাতে তাঁর পা ধুইয়ে দিলেন। আপ্যায়নে পরিতুষ্ট করলেন বন্ধুকে। তারপর দু’জনে কত কথা ! - শ্রীকৃষ্ণ বললেন, শ্রীদাম, মনে আছে, গুরুপত্নীর কথায় একদিন কাঠ আনতে বনে গিয়েছিলাম । দু’জনে বনের মধ্যে ঝড়বৃষ্টিতে কত কষ্ট পেয়েছিলাম। পরের দিন গুরু সান্দীপনি আমাদের খুঁজে বের করেছিলেন। - মনে আছে, সব মনে আছে । শ্রীদাম তো দারুণভাবে আপ্যায়িত হলেন। কিন্তু তিনিতো এনেছেন চার মুঠো চিড়ে। সেই চিড়ে বের করবেন কী করে? দারুণ লজ্জায় পড়লেন তিনি। শ্রীকৃষ্ণের কাছে কিছুই অজানা থাকে না । তিনি নিজে সেই চিড়ে কেড়ে নিয়ে মনের আনন্দে এক মুঠো খেয়ে নিলেন। শ্রীদামের রাত কাটলো আনন্দে । কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, তার কিছুই হলো না । কিছুই চাইতে পারলেন না তিনি। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিলেন। আর লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে খানিকটা হেসে নিলেন। একি! শ্রীদামের কুঁড়েঘর যেখানে ছিল, সেখানে উঠেছে প্রাসাদ । প্রাসাদের সামনে উদ্যান। সুন্দর সরোবর, সেখানে পদ্ম আর শাপলার মেলা । সুগন্ধে আমোদিত চারদিক। এগিয়ে এলেন শ্রীদামের স্ত্রী । আনন্দে তাঁর চোখে দেখা দিল অশ্রু। না চেয়েও শ্রীদাম ও তাঁর স্ত্রী পেলেন প্রচুর ধন সম্পদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এভাবে স্থাপন করলেন বন্ধু প্রীতির এক উজ্জ্বল আদর্শ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন