সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

উপাসনা ও নিত্যকর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ


   

ঈশ্বর মানুষ, জীব, জগৎ, প্রকৃতি সব কিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্তা। তিনি সর্বত্র বিরাজমান, নিরাকার, এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন দ্বিতীয় সত্ত্বা নেই তবে তিনি বিভূতি প্রকাশের জন্য সাকার হন আবার লীলা প্রকাশের জন্য জীবদেহ
ধারণ করেন। তাই নিরাকার, সাকার কিংবা অবতার হিসেবেও  হিন্দুগণ ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। উপাসনা  নিত্যকর্মের অঙ্গ। সাধারণ অর্থে নিত্যকর্ম বলতে প্রতিদিনের কাজ বুঝায়। তবে নিত্যকর্ম ধর্মচর্চার একটি অঙ্গ। ঈশ্বর ধর্মের মূল। বেদাদি সমগ্র ধর্মগ্রন্থ তাঁরই মহিমা কীর্তন করে। বেদ হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ। এছাড়াও রয়েছে উপনিষদ পুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চণ্ডী প্রভৃতি গ্রন্থ।     ,

উপাসনা - মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। কারণ ঈশ্বরকে লাভ করতে পারলেই জীব মুক্তি বা মোক্ষ  লাভ করে। তাই মুক্তি লাভের জন্য ঈশ্বরের উপাসনা করতে হয়। উপাসনা অর্থ-ঈশ্বরকে স্মরণ করাএকাগ্রচিত্তে ঈশ্বরকে ডাকা। ঈশ্বরের আরাধনা করা। উপাসনা ধর্মপালনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। ধ্যান, জপ, কীর্তন, পূজা,
স্তব-স্ত্ততি, প্রার্থনা প্রভৃতি পদ্ধতিতে উপাসনা করা হয়।
উপাসনার দুটি উপায় রয়েছে-
1.      সাকার উপাসনা
2.     নিরাকার উপাসনা

সাকার উপাসনা-
সাকার অর্থ যার আকার বা রূপ আছে। আকার বা রূপের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করাই সাকার উপাসনা। ঈশ্বরের কোন বিশেষ শক্তি বা গুণ যদি কোন রূপ বা আকার ধারণ করে তখন তাকে বলা হয় দেবতা। যেমন-ঈশ্বরের সৃষ্টি ক্ষমতাকে বলা হয় ব্রহ্মা, পালন শক্তিকে বলা হয় বিষ্ণু, আর ধ্বংস করে ভারসাম্য রক্ষা করার শক্তিকে বলা হয় শিব। দুর্গা শক্তির দেবী। সরস্বতী বিদ্যার আর ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী । দেবদেবীরা পূজায় সন্তুষ্ট হন। আবার দেবদেবীরা সন্তুষ্ট হলে  ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন এবং ভক্তের বাঞ্ছা পূর্ণ করেন। দেবতারা ঈশ্বরের শক্তির বিশেষ বিশেষ সাকার রূপ। তাই দেবতা বহু হলেও ঈশ্বর বহু নন। আর দেবতাসহ বিশ্বজগতের সকল
 কিছুর ক্ষমতাও সৌন্দর্য ঈশ্বরের ক্ষমতা ও সৌন্দর্য্যের বহিঃপ্রকাশ। যাঁরা শ্রদ্ধা সহকারে অন্য দেবতার পূজা করেন, তাঁরাও ভিন্নভাবে ঈশ্বরেরই পূজা করেন। কেননা, ঈশ্বর হতে পৃথক কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই। এক কথায় বলা যায়, সকল দেবতাই ঈশ্বরের সাকার রূপ। তাই ভক্তবৃন্দ ঈশ্বরকে দেব-দেবীর প্রতিমারূপে ও অবতাররূপে উপাসনা করেন। এরূপ উপাসনায় ভক্ত ঈশ্বরকে সাকাররূপে কাছে পায়। তাঁকে পূজা করে। তাঁর নিকট প্রার্থনা করে।

নিরাকার উপাসনা-
নিরাকার উপাসনায় ভক্ত নিজের অন্তরে ঈশ্বরকে অনুভব করেন। ঈশ্বরের নাম জপ করেন। তাঁর নাম কীর্তন করেন। তাঁর স্তব-স্ত্ততি করে তাঁর নিকট প্রার্থনা জানান। নিজের ও জগতের কল্যাণ কামনা করেন ।একজন ভক্ত সাকার কিংবা নিরাকার দুটি উপায়েই উপাসনা করতে পারেন। উপাসনার পদ্ধতি সাকার বা নিরাকার যা-ই হোক না কেন, সবই ঈশ্বরের উপাসনা। ঈশ্বরের নিরাকার অবস্থাকে বলা হয় ব্রহ্ম। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, নিরাকার, ব্রহ্মই প্রয়োজনে সাকার রূপ ধারণ করেন। অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই আবার সাকার। নিরাকাররূপে ঈশ্বরের ধ্যান করা হয়। সাকাররূপে তাঁর পূজা করা হয়। উপাসনা একটি নিত্যকর্ম। মনের পবিত্রতার জন্য দেহের শুচিতার প্রয়োজন। সেজন্য সংযম পালনসহ কতকগুলো নিত্যকর্ম নিত্যই করতে হয়।
নিত্যকর্ম-
 নিত্যকর্ম প্রতিদিনের কাজ। নিত্যকর্ম ধর্মচর্চার একটি অঙ্গ। ধর্মচর্চা করতে গেলে শরীর ও মন সুস্থ থাকতে হয়। নিত্যকর্মের ফলে শরীর ও মন সুস্থ থাকে। এজন্য  প্রতিদিন নিয়ম মেনে কিছু কর্ম করতে হয়। এই কর্মগুলোই নিত্যকর্ম। শাস্ত্র অনুসারে নিত্যকর্মের ক্ষেত্রে কর্ম সময়ের বিভাগ করা হয়েছে। সেদিক থেকে নিত্যকর্ম ছয় ভাগে বিভক্ত। যথা- প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্ণকৃত্য, মধ্যাহ্নকৃত্য, অপরাহ্ণকৃত্য, সায়াহ্নকৃত্য ও রাত্রিকৃত্য।
প্রাতঃকৃত্য :  সূর্যোদয়ের কিছু আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর বিছানায় বসে পূর্ব বা উত্তরমুখী হয়ে ঈশ্বর বা দেব-দেবীর স্মরণ করে মন্ত্র পাঠ করতে হয়। অতঃপর শয্যা ত্যাগ করে পৃথিবীকে প্রণাম করে বাইরে এসে সূর্যকে প্রণাম করে তুলসীতলা এবং পিতামাতাকেও প্রণাম করতে হয়। হাতমুখ ধুয়ে পবিত্র হয়ে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরতে হয়। স্নান করতে পারলে তো আরও ভাল।
পূর্বাহ্ণকৃত্য :  প্রাতঃকৃত্যের পরে এবং মধ্যাহ্ন বা দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে সকল কাজ করা হয় তা-ই পূর্বাহ্ণকৃত্য। এ সময় প্রার্থনা ও পূজা করে দিনের অন্যান্য কাজ-কর্ম করতে হয়। শরীর সবল, সুঠাম ও কর্মদক্ষ করে তোলা ও মানসিক স্থিরতার জন্য প্রাতঃকালে ব্যায়াম ও কিছু যোগাসনও অভ্যাস করা যেতে পারে। তারপর অন্যান্য করণীয় কাজে মনোনিবেশ করতে হয়।
মধ্যাহ্নকৃত্য :  মধ্য অহ্ন অর্থাৎ দিনের মধ্য ভাগ বা দুপুর। দুপুরের কাজকে বলা হয় মধ্যাহ্নকৃত্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে উপাসনা করা, তারপর দুপুরের আহার গ্রহণ করা কর্তব্য। আহারের পরে বিশ্রাম নেয়ার সময় থাকলে কিছু   সময় বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হয়। দুপুরে অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করাও মধ্যাহ্নকৃত্যের মধ্যে পড়ে।
অপরাহ্ণকৃত্য :  দুপুরের পর সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত সময় হচ্ছে অপরাহ্ণ। এ সময়ে যে কাজ করা হয় তাকেই বলে অপরাহ্ণকৃত্য। এ সময় খেলাধুলা, ব্যায়াম বা ভ্রমণ করলে শরীর ভাল থাকে।
সায়াহ্নকৃত্য :  সায়াহ্ন মানে সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকালে হাত, পা ও মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হতে হয়। তারপর ঈশ্বরের উপাসনা করতে হয়।
রাত্রিকৃত্য :  সন্ধ্যার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজকে বলে রাত্রিকৃত্য। সন্ধ্যার পর পড়াশুনা ও অন্যান্য করণীয় কাজ করতে হয়। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে রাত্রিকালীন আহার গ্রহণ করতে হয়। তারপর দাঁত মেজে /৪ মিনিট  বজ্রাসনে বসা যেতে পারে। পরে পড়াশুনা বা কিছু কাজ থাকলে করা যেতে পারে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ভগবানের পদ্মনাভনামটি স্মরণ করে ঘুমাতে হয়।
নিত্যকর্মের ফলে নিয়মানুবর্তিতা শেখা যায়। সময়ের কাজ সময়ে করা যায়। কোন কাজই অসমাপ্ত থাকে না। শরীর- মন ভাল থাকে। যে-কোন কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া যায়। ফলে জীবনটাই সুন্দর হয়ে ওঠে।   
 
ধর্মগ্রন্থ
ধর্মগ্রন্থে থাকে ধর্মের কথা। ঈশ্বরের কথা। দেব-দেবীর উপাখ্যান। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে নানা উপদেশ। তাই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে কল্যাণ হয়। হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ বা বেদ সংহিতা। এছাড়া আছে উপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চণ্ডী প্রভৃতি।
বেদ
বেদ ঈশ্বরের বাণী, যা প্রাচীন ঋষিদের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল। ঋষিগণ শিষ্যদেরকে মুখে মুখে বেদ শিক্ষা দিতেন। কালক্রমে ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব বেদ সংগ্রহ করে লিখিত রূপ দেন। তিনি বেদের মন্ত্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেন। ফলে বেদ হয়ে যায় চারটি। চারটি বেদ হলো : ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব। এগুলোকে লিপিবদ্ধ করে সংহত করেছেন বলে এর নাম হয়েছে বেদ সংহিতা। বেদ গদ্য ও পদ্যে রচিত। কিছু বেদমন্ত্র আছে যেগুলো সুর সংযুক্ত অর্থাৎ গান।
ঋগ্বেদ সংহিতা  :
ঋকশব্দটি অর্থ স্ত্ততি। ঋগ্বেদ সংহিতায় স্ত্ততি ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র রয়েছে। ঋষিদের ধ্যানযোগে প্রাপ্ত বাণীগুলো তিন-চার পংক্তির এক একটি কবিতার আকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই কবিতা গুলোকেই বলা হয়েছে ঋক বা মন্ত্র। ঋগ্বেদে মোট ১০,৪৭২ টি ঋক বা মন্ত্র রয়েছে। 
যজুর্বেদ সংহিতা  :
যজ্ঞে প্রযুক্ত বৈদিক মন্ত্রগুলোকে একত্র সন্নিবেশিত করে ব্যাসদেব যজুর্বেদ সংহিতা প্রণয়ন করেছেন। যজ্ঞ বলতে একটি বিশেষ পদ্ধতির উপাসনা ও অনুষ্ঠান বোঝানো হয়েছে। যজ্ঞে ব্যবহৃত মন্ত্রের নাম যজুঃ। তাই যজুঃ এর সংগ্রহকেই বলা হয়। যজুর্বেদ। যজুর্বেদে গদ্য ও পদ্য উভয় রীতির মন্ত্রই আছে। যজুর্বেদের বিষয়বস্ত্তর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞের কথা আছে। শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া, বিভিন্ন প্রকার বৃত্তি ও পেশাজীবি প্রভৃতি পরিচয়সহ বৈদিক যুগের সমাজ-সভ্যতার পরিচায়ক হিসেবেও যজুর্বেদের একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে।
সামবেদ সংহিতা  :
গীতিষু সামাখ্যা। গীতিযুক্ত বা সুরারোপিত ঋককে সামবলা হয়। সামবেদ সংহিতার অধিকাংশ মন্ত্রই ঋগ্বেদে রয়েছে। সামবেদ বিধৃত ১৮১০টি মন্ত্র আছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৭৫টি ছাড়া বাকি সবগুলো ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত। মোট কথা ঋগ্বেদের ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলোতে সুর সংযোগ করে সামে বা গানে পরিণত করা হয়েছে। সামবেদই প্রাচীন ভারতীয় আর্য গানের উৎস। যজ্ঞ করার সময়ে সামগুলো গীত হয়। কণ্ঠ ও যন্ত্র দুপ্রকার সঙ্গীত মাধ্যমে সাম গান করা হয়।
অথর্ববেদ সংহিতা  :
যজুর্বেদের মত অথর্ববেদও গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিতে রচিত। এতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাস্ত্তবিদ্যা (গৃহ নির্মাণ) ইত্যাদিসহ জীবনের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। বেদ বলতে কেবল একটি মাত্র পুস্ত্তক বোঝায় না, বেদ একটি বিশাল অখণ্ড রচনা। বেদ কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, এটি ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের আকর ও প্রামাণ্য গ্রন্থ বলেও বিবেচিত।
উপনিষদ
বেদের  দুটো ভাগ- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড । কর্মকাণ্ডে কর্ম বিষয়ক এবং জ্ঞানকাণ্ডে জ্ঞান বিষয়ক উপদেশ বিদ্যমান । এই জ্ঞানকাণ্ডই হচ্ছে উপনিষদ। উপনিষদকে ব্রহ্মবিদ্যা এবং গূঢ় বিদ্যাও বলা হয়ে থাকে। এতে আছে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপদেশ। উপনিষদ মানে গুরুর নিকট বসে আত্মজ্ঞান উপদেশ শিক্ষা করাউপনিষদের উপশব্দের অর্থ সমীপেএবং নিষদ্শব্দের অর্থ বাস। যে তত্ত্ব জ্ঞানের দ্বারা পরমেশ্বরের নিকট বাস করা যায় তাকেই উপনিষদ বলা হয়। বেদের অন্তবলে একে বেদান্তও বলা হয়। উপনিষদের সংখ্যা শতাধিক। তাদের মধ্যে প্রধান বার খানার নাম- ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক ও কৌষীতকি উপনিষদ।
বেদ এবং উপনিষদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের তাৎপর্য সহজে বোঝার জন্য কয়েকটি স্মৃতি গ্রন্থ ছাড়া ছখানা দর্শন এবং আঠার খানা পুরাণের  প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
পুরাণ
পুরাণশব্দটির সাধারণ অর্থ প্রাচীন। কিন্তু এখানে শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। যে ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টি ও দেবতার উপাখ্যান, ঋষি ও রাজাদের বংশ পরিচয় প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে, তাকে বলে পুরাণ। এসবের মাধ্যমে বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে। মূল পুরাণ ১৮ খানা আবার উপপুরাণও ১৮ খানা। এগুলোর রচয়িতা ব্যাসদেব। মহাভারত, ভাগবতসহ কয়েকটি মূল পুরাণ হলো- ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিব পুরাণ, অগ্নিপুরাণ ইত্যাদি। আর কয়েকটি উপপুরাণ হলো- নরসিংহ পুরাণ, কালিকা পুরাণ, দেবী পুরাণ ইত্যাদি। পুরাণের মধ্যে তিনজন দেবতার মাহাত্ম্য প্রধানভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা হলেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। দুর্গা ও কালীর বর্ণনা আছে যথাক্রমে দেবী পুরাণ ও কালিকা পুরাণে।
                        
তন্ত্রশাস্ত্র
ঈশ্বরকে আদ্যাশক্তিরূপে চিন্তা করার উপদেশ তন্ত্রশাস্ত্রে রয়েছে। ঈশ্বরের নারীরূপ ভাবনা করে তাঁকে মাতৃরূপে যাঁরা উপাসনা করেন তাদের বলা হয় শাক্ত। শাক্তগণ বিশ্বাস করেন মহামায়া বিশ্বব্যাপিনী হলেও নারীমূর্তিতে তাঁর সমধিক প্রকাশ। নারী জগদম্বারই জীবন্ত বিগ্রহ। দেবীর অংশে নারীমাত্রেরই জন্ম। তাই প্রত্যেক নারীতে মাতৃবুদ্ধি করা এবং প্রত্যেক নারীকে দেবীমূর্তি জ্ঞানে শ্রদ্ধা করা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা। এই মহামায়া তত্ত্বই তন্ত্র শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় । শক্তিমঙ্গল তন্ত্রানুসারে ভারতবর্ষ তিনভাগে বিভক্ত। বিন্ধ্যাচল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রদেশ বিষ্ণুক্রান্তা, বিন্ধ্যাচল থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত অশ্বক্রান্তা বা গজক্রান্তা এবং বিন্ধ্যাচল থেকে নেপাল, মহাচীন প্রভৃতি দেশ রথক্রান্তা নামে বিখ্যাত। প্রত্যেক ক্রান্তায় ৬৪ খানি করে ১৯২ খানি তন্ত্র সমগ্র ভারতে প্রচলিত রয়েছে। পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধন অভূতপূর্ব ও সুদূর প্রসারী। ভৈববী ব্রাহ্মণীর উপদেশে তিনি বিষ্ণুক্রান্তায় প্রচলিত ৬৪ খানা তন্ত্রের সকল সাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রেই শাক্ত দর্শন বিশদভাবে  ব্যাখ্যাত এবং সপ্তসতী  চণ্ডীতে এর পূর্ণ পরিণতি দৃষ্টি হয়।

রামায়ণ
বেদ, উপনিষদ প্রভৃতির ন্যায় রামায়ণও একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মগ্রন্থ। মহর্ষি বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছেন। রামায়ণকে আদি কাব্যও বলা হয়।

স্বয়ং ভগবান ত্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্ররূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হন। তিনি জগতে পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, পত্নীপ্রেমের আদর্শ এবং সত্যরক্ষা, প্রজানুরঞ্জন প্রভৃতি সদ্গুণের আদর্শ স্থাপন করেন। লোক কল্যাণের  নিমিত্ত তাঁর জীবন চরিত্র মাহাত্ম্য প্রকাশই রামায়ণের মূল বিষয়বস্ত্ত। এছাড়াও আরও অনেক উপাখ্যান ও উপদেশ রামায়ণে রয়েছে যার মাধ্যমেও মানব সমাজের আদর্শ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ভারতবর্ষের সমাজ ও জীবনে রামায়ণের গুরুত্ব অসীম। এখনও হিন্দুদের ঘরে ঘরে রামায়ণ পঠিত হয়। আদর্শ রাজা, আদর্শ ভাই প্রভৃতির চিত্র ও চরিত্র আজও জীবনাদর্শরূপে অনুসরণ করা হয়। হিন্দি ও বাংলা সাহিত্যসহ ভারতবর্ষের আরও অনেক ভাষায় রামায়ণের অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় কবি কৃত্তিবাস ওঝা-র শ্রীরাম পাঁচালী বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং হিন্দি ভাষায় কবি তুলসীদাস গোস্বামীর রামচরিতমানস শীর্ষক রামায়ণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। আবার অনেক ভাষার সাহিত্য রামায়ণ থেকে উপাদান নিয়ে নতুন সাহিত্য রচনা করা হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস রঘুবংশ নামক কাব্য এবং বাংলা সাহিত্যের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মহাকাব্য মেঘনাদ বধরামায়ণ থেকে উপাদান নিয়ে রচনা করেছেন। এছাড়াও ইংরেজিসহ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বহুভাষায় রামায়ণ অনূদিত হয়েছে।
রামায়ণ পাঠ করলে অন্তর পবিত্র হয়। রামায়ণের উপাখ্যানসমূহের মধ্যে রয়েছে ধর্মের দর্শন ও সুমহান আদর্শের পরিচয়। সমগ্র রামায়ণ সাতটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগকে কাণ্ড বলে। এই সাতটি কাণ্ড হচ্ছে - ) আদি কাণ্ড,  ) অযোধ্যা কাণ্ড,  ) অরণ্য কাণ্ড  ) সুন্দর কাণ্ড, ) কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড ) লঙ্কা কাণ্ড এবং ৭) উত্তর কাণ্ড ।

মহাভারত
মহাভারত একখানা বিশাল গ্রন্থ। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেছেন ব্যাসদেব। তাঁর মূল নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। কাশীরাম দাস, কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং আরও অনেকে  বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদ করেছেন। তন্মধ্যে কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারত বেশ জনপ্রিয়।
মহাভারত-এর মূল উপজীব্য বিষয় হলো কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যান ভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। উদাহরণরূপ বলা যায়, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চার পুরুষার্থ সংক্রান্ত একটি আলোচনা এই গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। মহাভারত এর অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও উপাখ্যান হলো- ভগবদগীতা, দময়ন্তীর উপাখ্যান, রামায়ণ এর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠান্তর ইত্যাদি। এ গুলোকে মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।
মহাভারত-এ এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যের শব্দ সংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ। মহাভারত এর আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের সম্মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণের চারগুণ। এই বিশাল মহাভারত কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রত্যেক অংশকে বলা হয় পর্ব। মহাভারতে মোট আঠারোটি পর্ব আছে। পর্বগুলো হলো-
) আদি পর্ব, ) সভা পর্ব, ) বন পর্ব, ) বিরাট পর্ব, ) উদ্যোগ পর্ব, ) ভীষ্ম পর্ব, ) দ্রোণ পর্ব, ) কর্ণ পর্ব , ) শল্য পর্ব, ১০) সৌপ্তিক পর্ব, ১১) স্ত্রী পর্ব, ১২) শান্তি পর্ব, ১৩) অনুশাসন পর্ব, ১৪) আশ্বমেধিক পর্ব, ১৫) আশ্রমবাসিক পর্ব, ১৬) মৌসল পর্ব, ১৭) মহাপ্রস্থানিক পর্ব এবং ১৮) স্বর্গারোহণ পর্ব।

মূল কাহিনী
প্রাচীন ভারতে শান্তনু নামে এক রাজা ছিলেন । পিতৃসত্য পালনের জন্য রাজা  শান্তনুর পুত্র দেবব্রত বিবাহ করেন নি ও রাজ সিংহাসনে বসেন নি। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁকে ভীষ্ম বলা হয়। ভীষ্মের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য রাজত্ব চালান। তাঁর ছিল দুইপুত্র- ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু । জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় পাণ্ডু রাজা হন। কিন্তু পাণ্ডুর অকাল মৃত্যুর পর রাজত্ব ধৃতরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আসে। সেখান থেকেই শুরু হয় মহাভারতের মহাবিরোধ। কে রাজা হবেন-পাণ্ডুর পুত্র না ধৃতরাষ্ট্রের ? শুরু হয় হিংসা, ষড়যন্ত্র, কপট দ্যূতক্রীড়া, বনবাস ইত্যাদি। কাহিনীর পরিণতি অষ্টাদশ দিবসব্যাপী এক সংহারক যুদ্ধ- যাতে ভারতবর্ষের বহু রাজার প্রাণ যায়। নিহত হন জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনসহ ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র। শেষে রাজত্ব পান জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির। সমস্ত কাহিনীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মূখ্য চালকের ভূমিকায় থাকেন। এই কাহিনীর আধ্যাত্মিক সারাংশ হল- ধর্মের জয় ও অধর্মের বিনাশ।
         

রামায়ণের ন্যায় মহাভারতও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত গ্রন্থ। রামায়ণের ন্যায় মহাভারত থেকে উপাদান নিয়েও বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। মহাভারত একটি নিত্য পাঠ্য গ্রন্থ। মহাভারত এর কথা অমৃতের ন্যায়। তা শুনলেও পুণ্য হয়। তাই কাশীরাম দাস বলেছেন-
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

গীতা
গীতার পুরো নাম শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। এটি মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের একটি অংশ। এতে ১৮টি অধ্যায় আছে।

 কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইলেন না। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনেক উপদেশ দেন। সেটাই গীতা। গুরুত্বের কারণে এটি পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। বেদকল্পবৃক্ষের অমৃতময় ফল উপনিষদ। আর উপনিষদের সার ভাগ হচ্ছে গীতা। তাই গীতাকে এয়োদশ উপনিষদ বলা হয়। এটি সর্বশাস্ত্রের শিরোভূষণ এবং সমভাবে সর্ব সম্প্রদায়ের  নমস্যা হয়ে আছে। বেদের ন্যায় সর্ব সম্প্রদায়েরই মান্য। গীতাশাস্ত্রে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। গীতার উপদেশ হচ্ছে ফলাকাঙ্খা ত্যাগ করে নিষ্কাম কর্ম করা। একে কর্মযোগ বলে। কর্মযোগে সিদ্ধ হলে জ্ঞানের উদয় হয়। জ্ঞানীসাধক ঈশ্বরকে সকলের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন এবং ঈশ্বরকে সেবা করার জন্য লোকহিতকর কর্ম করেন। লোকহিতকর কর্ম মাত্রই ঈশ্বরের সেবা। একথা চিন্তা করতে করতে জ্ঞানীর হৃদয়ে ভক্তির উদয় হয়। ভক্ত কর্মময় জীবনের অন্তে মুক্তি লাভ করেন। গীতা হচ্ছে সকল শাস্ত্রের সার তাই এটি হিন্দুদের নিত্যপাঠ্য গ্রন্থ।

চণ্ডী
চণ্ডী মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩ অধ্যায় পর্যন্ত ১৩টি অধ্যায়ের নামই চণ্ডী। দেবীমাহাত্ম্য ও দুর্গাসপ্তসতী চণ্ডীর অপর দুটি নাম। এতে ৭০০ মন্ত্র অথবা ৫৭৮টি শ্লোক আছে। সমগ্র তন্ত্রশাস্ত্রের সার চণ্ডীর মধ্যে নিহিত। তাই শক্তি গ্রন্থসমূহের মধ্যে চণ্ডী এত সারবতী ও সমাদৃতা। চণ্ডীপাঠ দেবী পূজার প্রধান
অঙ্গ। চণ্ডীতে দেবী মহামায়ার মাহাত্ম্য ও অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে।

এই দেবী  মহামায়া নিত্যা। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্ত্রীরূপে স্বয়ং ভগবানই মহামায়া। তিনি মায়া দ্বারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড মুগ্ধ করে  রেখেছেন। মানুষের মধ্যে সুর ও অসুরের যুদ্ধ অর্থাৎ সৎ ও অসৎ  প্রবৃত্তির  যুদ্ধ সর্বদাই চলছে। মহাশক্তি ঈশ্বরের শরণ নিলে তিনিই ভক্তের রিপু বা অসৎ প্রবৃত্তিগুলো নষ্ট করে দেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে অসুরদের সঙ্গে বর্ণিত সমর প্রকৃতপক্ষে সাধন সমর। আমাদের মনের অসৎ প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করে নিয়ত সৎ প্রবৃত্তির অনুশীলন করা উচিত। আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে ষড় রিপুর প্রভাব হতে মুক্তির সাধনাই শ্রীশ্রীচণ্ডীর মূল শিক্ষণীয় বিষয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ হয়েও চণ্ডী পৃথক ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। শ্রীমদভগবদগীতার ন্যায় শ্রীশ্রীচণ্ডীও হিন্দুদের  নিত্যপাঠ্য গ্রন্থ।

পৃথিবীর মানুষের মধ্যে নানা দিক থেকে মিল যেমন আছে, তেমনি আবার অনেক অমিলও আছে। মিলের দিক থেকে যদি দেখি, তাহলে দেখব, সবাই মানুষ। সকলের মধ্যে রয়েছে একই মনুষ্যত্ব। উপাসনার পথ বিভিন্ন হলেও উপাস্য এক এবং অদ্বিতীয়। সকল ধর্মই নিজের মুক্তি এবং জীব ও জগতের মঙ্গল চায়। হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে যে, সকল জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বর অবস্থান করেন। আর এ বিশ্বাস ধর্মীয় সাম্যবোধ জাগ্রত করার প্রধান সহায়ক। এ কথা মেনে চললে পৃথিবী হবে শান্তিময়-আনন্দময়।
 




  

    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন