শ্যামলী নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা-র সঙ্গে আমার
যোগাযোগ সম্ভবত ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে। কিভাবে এ যোগাযোগ ঘটেছিল তা আজ আর স্মরণে
নেই। তবে নিয়মিত টেলিফোন ও পত্র যোগাযোগ দীর্ঘদিন ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত
উদার ও মুক্তমনের মানুষ। তাঁর ভাষায় (পত্রের তারিখ : ১৮.০২.১৯৯৫ খ্রিঃ), "আমি ছোটবেলা থেকেই সংস্কারমুক্ত। আমার মা,
১৯৭৫ সালে প্রয়াত ৯০ বছর বয়সে, কোনদিন সংগঠিত ধর্মে (organized religion) বিশ্বাস করতেন না। বাবাও মানবিক দর্শনের
অনুসারী ছিলেন।’’ এহেন মাতা-পিতার সন্তান অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক হবেন এটাই
স্বাভাবিক। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষের জন্যই নয়, উদ্ভিদ-প্রাণি সকলের জন্যই তাঁর
প্রাণ কাঁদতো।
বন-বনানি, বৃক্ষরাজিতে বৈচিত্র্য না থাকলে
বৈচিত্র্যময় প্রাণিকুলেরও অস্তিত্ব থাকবে না বলে তিনি সকল সময় আশংকা প্রকাশ করতেন।
প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম সৌন্দর্য তার লতা-গুল্ম-বৃক্ষরাজি। সবুজ গাছপালা
তরু-লতা, শৈবাল, প্লাংটন প্রাণিকুল
বাঁচিয়ে রেখেছে অক্সিজেন সরবরাহ করে, খাদ্য জোগান দিয়ে এবং বাতাসের কার্বন ডাই
অক্সাইড শোষণ করে বাতাসের উপাদানের তারতম্য রোধ করে। বৃক্ষ ছায়া দেয় এবং
প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে জলীয় বাষ্প ছেড়ে আশপাশের এলাকার উষ্ণতা কমায়। তাই তো
লতা-গুল্ম-বৃক্ষরাজি আমাদের পরম আত্মীয়, পরম বন্ধু, এদের প্রতি মমত্ববোধ থাকতে হবে
এদের ভালবাসতে হবে। এদের প্রতি আমরা বিরূপ হলে প্রকৃতিও আমাদের প্রতি বিরূপ হবে। আমাদের
অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বৃক্ষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার জন্য তাঁকে কৃক্ষসখা বলা
হতো। বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা-র মতে, "প্রকৃতি আমাদের ধাত্রী, আমরা তার পোষ্য।
আমাদের মধ্যকার ভালবাসার সম্পর্ক শোষণমূলক হয়ে উঠলে ফল দাঁড়াবে সোনার ডিম-পাড়া
হাঁসের সেই মূর্খ মালিকের মতো, যে একসঙ্গে সবগুলো ডিম পাওয়ার লোভে হাঁসটিকে মেরে
ফেলেছিল। লোকটি হাঁসের শরীরতত্ত্ব জানলে এমন সর্বনাশ ঘটতো না। আমাদের তাই প্রকৃতির
নিয়মগুলো জানতে হবে, লোভের বদলে জ্ঞানের আলো নিয়ে সাবধানে এগোতে হবে, খুঁজে পেতে
হবে সেই ভারসাম্য, যেখানে জীবনের ক্রমাগত মানোন্নয়নসহ প্রকৃতির নির্বিরোধ বসবাস
করা সম্ভব (গহন কোন বনের ধারে, দ্বিজেন শর্মা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৪, পৃ. ১৫)।"
তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক,
অনুবাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা সম্পাদক। একবার তিনি আমাকে লিখেন (পত্রের তারিখ : ০৩.০৩.১৯৯৬খ্রিঃ), "আমি Ecofile নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক। সুনামগঞ্জ থেকে
এমন কাউকে কি পাওয়া সম্ভব যিনি ওখানকার পরিবেশ ও Ecology সম্পর্কে আমাদের রিপোর্ট পাঠাতে পারেন। যেমন ছাতকের
সিমেন্ট কারখানা, কাগজকল থেকে দূষণ, হাওরের অবস্থা। একটি পক্ষি সংরক্ষণ এলাকা আছে
সেখানকার কর্মকাণ্ড। ফটো সঙ্গে থাকলে খুবই ভাল। আমরা তাকে কিছুটা সম্মানী (অর্থ)
দেবো। ওখানে কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখো। সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজে নন্দলাল শর্মা আছেন।
পত্রমাধ্যমে আমার পরিচিতি। তাঁকেও বলতে পারো। তোমার উৎসাহ থাকলে আরও ভাল।" আমি
লিখতে রাজী হয়ে যাই। যথারীতি প্রতিবেদন পাঠাই। তিনি আমার লেখার প্রশংসা করে চিঠি
লিখেন। যদিও এর যোগ্য আমি নই। তিনি আমার লেখা থেকে চমৎকার রিপোর্ট প্রস্তুত করে
বাংলায় 'পরিবেশপত্রে’ এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করে 'Ecofile’-এ প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ
করে গাইডলাইন দিয়ে লিখতে উৎসাহিত করতেন। যেমন, (পত্রের তারিখ : ১৮.০৮.১৯৯৬ খ্রিঃ) "সম্ভব হলে আরেকটি report পাঠিও। হতে পারে ’প্রাথমিক শিক্ষকদের চোখে
পরিবেশ’- তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। এতে যেন তাদের নিজেদের কথা ও অভিমত থাকে। material তোমার হাতের কাছেই আছে, ছোটাছুটি
নিষ্প্রয়োজন।"
সুনামগঞ্জের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে তাঁর
বিশেষ টান ছিল। তিনি একখানা পত্রে (পত্রের তারিখ : ১৬.০৪.১৯৯৬ খ্রিঃ) আমাকে লিখেছিলেন, "সুনামগঞ্জের পরিবেশ
সম্পর্কে, বিশেষত হাওর এলাকা, আমাদের আগ্রহের বিষয়। প্রথম সংখ্যায়ই একটি লেখা
ছাপছি, ওরা ওখানে দু’বছর কাজ করেছে। আমি মোহনগঞ্জ থেকে হেঁটে ৮/১০ দিনে গোটা বিল
এলাকা থেকে গাছপালা সংগ্রহ করে সুনামগঞ্জ পৌঁছাই। সে ১৯৬৫ সালের ঘটনা। আমার জীবনে
এটাই একমাত্র অ্যাডভেঞ্চার। শীতের দিনে জায়গাটা এমন সুন্দর হয়ে ওঠে যার তুলনা
দুনিয়ায় কমই আছে। এর বর্ণনা আছে আমার লেখা 'শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ের ভূমিকায়। এ নিয়ে
একটি বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীও লিখেছিলাম। প্রথম বইটি ছাপা নেই। দ্বিতীয়টি তোমাকে
পাঠাব।’’ হ্যাঁ, তিনি আমাকে বই পাঠিয়েছিলেন। এমন কি তাঁর প্রকাশিতব্য বই সম্পর্কেও
আমাকে জানাতেন। তাঁর এ বিনয়, সারল্য ও উদারতা আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। এ ঋণ
শোধ হবার নয়। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের সাথে তাঁর যোগাযোগ না রাখলে কিছুই যেত আসতো
না, তিনি যে কত বড় মনের মানুষ ছিলেন; তাঁর মহানুভবতা, তা তাঁর এই লেখায় প্রকাশ পায় (পত্রের তারিখ : ১৬.০৪.১৯৯৬খ্রিঃ), "তোমার সঙ্গে
আমার কখনও দেখা হয় নি, কিন্তু পত্রমাধ্যমে, বলতে পারি, ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। .............. আমি
চাই, এই ঘনিষ্ঠতা যেন বজায় থাকে। তুমি অবশ্যই Ecofile (বাংলা নাম পরিবেশপত্র) কাগজের জন্য লিখবে এবং আমার
সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। আমি মস্কো গিয়েও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।’’ আমার দুর্ভাগ্য
যে, এই উদার প্রাণ মহানুভব মানুষটির সঙ্গে আমার কখনও সাক্ষাৎ হয় নি। একবার ফোনে
যোগাযোগ করে তাঁর ঢাকার বাসায় গিয়েও সাক্ষাৎ হয় নি । আমার সাথে আলাপের পর পরই
তাঁকে জরুরী প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিল।
২০০৬ সালে পিটিআই, সুনামগঞ্জের বার্ষিক ম্যাগাজিন
পেয়ে তিনি আপ্লুত হন। অনুভূতি ব্যক্ত করে পিটিআই এর তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট জনাব
মোঃ গোলাম মোস্তফা-র নিকট দীর্ঘ একখানা পত্র লিখেন (পত্রের তারিখ : ২৫.০৭.২০০৬), পত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনির্মাণের জন্য চমৎকার সুপারিশ পেশ করেন। "আমি প্রাথমিক
স্কুলের পরিবেশ, অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে একটা জরিপে জড়িত ছিলাম। গ্রামাঞ্চলে
অনেক স্কুলেরই বেশ কিছুটা খালি জায়গা থাকে সেগুলি ব্যবহৃত হয় না। খেলার জায়গা বাদ
দিয়ে সেখানে শিশুভক্ষ্য ফলমূল (আমলকি, কালোজাম, জলপাই, লটকন (ভুবি), পিচন্ডি,
লুকলুকি, বিলিম্বি, হরবরই, কুল, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি) এবং স্কুল বেড়া দেওয়ার
উপযোগী দুই ঝাড় বাঁশ লাগিয়ে একটা বন বানান যায় আর সেইসঙ্গে কিছু ফুলের লতা-গুল্ম
মেশালে এটা হয়ে উঠবে একটা সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন। আজকাল প্রায় নিখরচায় গাছের
চারা পাওয়া যায় বনবিভাগের নার্সারিতে, লাগানোর কাজটা করতে পারেন শিক্ষকরা
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা এসব কাজ ভালই জানে। এইসঙ্গে স্কুলের
অঙ্গনে থাকবে অন্তত একটা চাঁপা, নাগেশ্বর, কদম, বকুল ও শেফালি এবং দু’একটি ওষধি বৃক্ষ
(হরিতকি, অর্জুন, বহেড়া)। আপনারা প্রশিক্ষণে আসা শিক্ষকদের এ সম্পর্কে বলবেন এবং
একাধিক আদর্শ স্কুলে এই ধরনের পরিবেশ তৈরি করে সেগুলি তাদের দেখাবেন। আপনাদের
ইনস্টিটিউটে এমন উদ্যানের একটা ক্লেমডেলও রাখতে পারেন এবং সেইসঙ্গে কিছু হাতে-আঁকা
ছবি। আমার একটি বই (গাছের কথা ফুলের কথা) দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকার ৩কপি করে দিয়েছেন, সেগুলির দিকেও শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন।
আমাদের গ্রামাঞ্চল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য শিক্ষাদানের
জন্য আদর্শ। সেখানকার গাছপালা, জীবজন্তু সবই গ্রামের ছেলে-মেয়েরা জানে, জানেনা
শুধু এদের আন্তসম্পর্ক ও পরস্পরনির্ভরতা, তথা মানুষের কর্তব্য। শিক্ষকরা এগুলি
জানলে তাদের আরও জানার আগ্রহ জন্মাবে, ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ অভিজ্ঞতার ভাগ দেবেন,
তাতে আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় খুবই মূল্যবান অবদান রাখতে পারব। শিক্ষকদের নিজ নিজ
গ্রামের মানচিত্র এঁকে তাতে গাছপালা, খানাডোবা, জীবজন্তুর অবস্থান চিহ্নিত করে 'ইকোলজিক্যাল ম্যাপ’ বানাতে, ক্লেমডেল তৈরিতে উৎসাহিত করতে এবং এসম্পর্কে ’উম্মেষ’-এ
লিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।’’
দ্বিজেন শর্মা-ও সঙ্গে আমার রক্তের কোন
সম্পর্ক না থাকলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার একান্ত আপন জন। যোগাযোগের কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আমাকে
আপনার করে নেন, কাকু ডাকার অধিকার দিয়ে। তিনি চিঠি শেষ করতেন, ’’ইতি কাকু’’ লিখে। কাকু সম্বোধনেই তিনি আনন্দ পেতেন।
এ বছর (২০১৭ সাল) ০৯ জুন আমার বাবা মহাপ্রয়াণ করেন আর কাকু ১৫ সেপ্টেম্বর, মাত্র
তিন মাস পর। বছরটি আমার কাছে অত্যন্ত শোকের ও বেদনাময়।
অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় আগে প্রতিবেশ
বিপর্যয়ের ভয়াবহতা চিন্তা করে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তায়
নিজ হাতে বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে যে অভিযানের সূচনা করেছিলেন তা আজ জাতীয় পর্যায়ে
নানান উদ্যোগে প্রতি বছর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজকের দুনিয়ায় উষ্ণতা বৃদ্ধি ও
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে মাতম, তা যে উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের উপজাত হবে তা
দ্বিজেন শর্মা অর্ধ শতাব্দী আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তো বলি, দ্বিজেন শর্মা আজ
শুধু পরিবেশবাদী মানুষের নিকটই নয় সকল সচেতন নাগরিকের কাছেই একটি চেতনার নাম। যে
চেতনা মানুষকে পরিবেশ দূষণরোধে সহায়তা করে, যে চেতনা প্রকৃতি ও জীবনের নির্ভরশীলতার
জানান দেয়। যে চেতনা জানান দেয় বৈচিত্র্যময় বৃক্ষরাজি, তরু, পল্লব থাকলে
বৈচিত্র্যময় প্রাণিকুল বেঁচে থাকবে, বিকশিত হবে নতুন সভ্যতা।
দ্বিজেন শর্মা-র মহৎ চিন্তা-চেতনা, প্রকৃতি-দর্শন
পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করুক আমি এই কামনাই করছি।
লেখক : নির্মল চন্দ্র শর্মা, সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট,
পিটিআই, কিশোরগঞ্জ। nspti61@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন