সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সিলেট অঞ্চলের হিন্দু বিবাহের প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান



সিলেট অঞ্চলের হিন্দু বিবাহের প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান
নির্মল চন্দ্র শর্মা, ইন্সট্রাকটর, পিটিআই সুনামগঞ্জ। মোবাইল ফোন : ০১৭২০৮৪৯৭২৩
Email : nirmalsharma_61@yahoo.com, nspti61@gmail.com

হিন্দুধর্মে বিবাহ একটি আবশ্যক ধর্মীয় অনুষ্ঠান; ধর্মীয় আচরণ । মানুষকে বিশুদ্ধকরণ তথা পাপমুক্ত করার জন্য হিন্দুদের যে দশবিধ সংস্কার আছে, তার মধ্যে বিবাহ হচ্ছে দশম বা শেষ সংস্কার। বিবাহের দ্বারা স্ত্রীলোকের কুলসম্পর্কের চ্যুতি ঘটে। গোত্রদ্বারাই হিন্দুদের কুল সম্পর্ক সূচিত হয়। বিবাহ দ্বারা স্ত্রীলোক পিতৃকুলের গোত্র ছিন্ন করে স্বামীকুলের গোত্র গ্রহণ করে। তাই হিন্দু নারীর পক্ষে জীবনের চরম সন্ধিক্ষণ হচ্ছে বিবাহ। এই সন্ধিক্ষণে যাতে কোন বাধাবিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই বিবাহ ব্যাপারে হিন্দুদের নানা আচার-অনুষ্ঠানের অনুবর্তী হতে হয়। এই আচার-অনুষ্ঠানকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- স্ত্রী আচার ও পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত ধর্মীয় আচার। স্ত্রী আচার কেবলমাত্র সধবা মহিলাদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। মেয়েলী সমাজে পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত ধর্মীয় আচারের চেয়ে স্ত্রী আচারের উপর বেশি জোর দেয়া হয়। তাদের বিশ্বাস এগুলোয় কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে বর-কনে উভয়েরই অমঙ্গল ঘটবে। বিশেষ করে বিবাহকালে যত রকমের বাধাবিপত্তি ঘটতে পারে সেগুলোকে প্রতিহত করাই হচ্ছে স্ত্রী আচারসমূহের উদ্দেশ্য। পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত অনুষ্ঠানগুলোতে এধরনের উদ্দেশ্য থাকলেও বিবাহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে পবিত্রীকৃত করাই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়।

পাড়া-প্রতিবেশি আত্মীয়-স্বজনকে বিবাহ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে যেভাবে তাদের প্রীতি, প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ কামনা করা হয় ঠিক সেভাবে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মৃত পূর্বপুরুষদের  এবং দেবতাদের আশীর্বাদ, প্রীতি ও প্রসন্নতা প্রার্থনা করা হয়।
এই আচার-অনুষ্ঠানসমূহের একটি সামাজিক উদ্দেশ্যও আছে। বর-কনের মধ্যে যে বিবাহ হচ্ছে, এই বিবাহ যে অবৈধ নয় সাধারণের মধ্যে তার প্রচার ও প্রকাশ করাও এই সব আচার-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। তাই সকল সম্প্রদায় ও জাতির মানুষের মধ্যে বিবাহ উপলক্ষ্যে আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিয়ম আছে, যদিও এই আচার-অনুষ্ঠান স্থান, কাল, জাতি ও সম্প্রদায়ভেদে বিভিন্ন রকমের। একই দেশের মধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানগত রীতি বা প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। তবে সকল ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে নব-দম্পতির সুখ, শান্তি, আয়ু ও মঙ্গল কামনা করা। কালপ্রবাহে যেমন অনেক আচার-অনুষ্ঠান লুপ্ত হয়েছে তেমনই আবার কিছু আচার অনুষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। মাত্র দশ বছর আগেও এ অঞ্চলে গায়ে-হলুদ অনুষ্ঠান ছিল না। যা আজ বিবাহের একটি মূখ্য অনুষ্ঠানরূপে পরিগণিত হচ্ছে। এখানে সিলেট অঞ্চলের বিবাহের প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান বর্ণনা করা হল, কুলাচার অনুযায়ী গরমিল হতে পারে । এতে হৃদয়বান পাঠকের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করি।

বিবাহ তারিখের পূর্বের আচার-অনুষ্ঠান

কনে দেখা ও আশীর্বাদ : কনে দেখার পর বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে কনের বাড়িতে পুরোহিত সঙ্গে থাকলে প্রথমে পুরোহিত তারপর বরপক্ষের জ্যেষ্ঠতা অনুসারে অভিভাবকবৃন্দ আশীর্বাদ মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক কিংবা মন্ত্র উচ্চারণ ছাড়াই ধান, দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এরপর বরপক্ষ থেকে আশীর্বাদ হিসেবে স্বর্ণালঙ্কার কিংবা টাকা প্রদান করা হয় । মহিলাগণ মঙ্গল কামনায় তৎসঙ্গে উলুধ্বনি বা জোকাড় দিয়ে থাকেন।

বর দেখা, আশীর্বাদ ও বাক্যদান : বর পছন্দ হলে বরের বাড়িতে কনেপক্ষ কর্তৃক কনে আশীর্বাদের মতই বরকে আশীর্বাদ করা হয় । তবে এক্ষেত্রে এই বাড়িতে কনে বিয়ে দিবেন ও নতুন সম্পর্ক স্থাপন করবেন বলে কনের পিতা কিংবা নির্ভরযোগ্য অভিভাবক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন, যাকে বাক্যদান বলা হয়।

মঙ্গলাচরণ/ টিকামঙ্গল : বরপক্ষ কর্তৃক মঙ্গলাচরণের জন্য কেনা প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন, শাঁখা, সিঁদুরসহ যাবতীয় প্রসাদন সামগ্রী, অলঙ্কার, শাড়িসহ সকল কাপড়-চোপড় একটি ঝাঁপিতে (বর্তমানে ঝাঁপির স্থান জুড়েছে বড় ব্যাগ) সাজিয়ে রাখতে হবে। কনে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগে একটি পাটি বিছিয়ে তার উপর ঝাঁপি রেখে এর সাথে পাঁচটি পুঁটি মাছ, দই, সিঁদুর, পান, সুপারি, ধান, দূর্বা পাটিতে রাখবেন। শাঁখা, শাড়ি ও পুঁটি মাছের উপর সিঁদুর দিয়ে পাঁচটি করে ফোঁটা দিবেন এবং ঝাঁপি বন্ধ করে ঝাঁপিতেও পাঁচটি করে সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হবে । একটি মঙ্গল ঘট বসাবেন। পাঁচজন আয়ো (সদবা রমণী) সম্মিলিতভাবে ঝাঁপি আর্ঘিবেন। বরের বাড়িতে আমন্ত্রিতদের সংখ্যা হিসেব করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মিষ্টি সামগ্রীসহ ঝাঁপি নিয়ে কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। মঙ্গল কামনায় যাত্রাকালে আয়োগণ উলুধ্বনি দিবে।
বরপক্ষ কনে বাড়িতে পৌঁছার পর আত্মীয় স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ দিবে। মুরব্বীদের অনুমতি সাপেক্ষে সকলে দেখতে পারেন এমন জায়গায় একটি পাটির উপর ঝাঁপি উঠাবে। ঝাঁপির সাথে ধান, দূর্বা, শাঁখা, সিঁদুর, দই, মিষ্টি, পুঁটি মাছ প্রভৃতি রাখবে আর রাখবে কনেকে আশীর্বাদ করে খাওয়ানোর জন্য সন্দেশ। কনের মা পুঁটি মাছগুলো টেনে টেনে অন্দরে নিয়ে যাবে। পাঁচজন আয়ো জল ভরে নিয়ে এসে কনেকে বাড়িতে স্নান করাবে। পরে কনে সাজিয়ে এনে ঐ পাটিতে বসাবে। কনের সামনে থাকবে ঝাঁপিসহ সকল কিছু, কনে পক্ষের ঝাঁপি এনেও এখানে এক পাশে রাখা হবে। সধবাগণ উভয় ঝাঁপিই ধান দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে এবং পাঁচটি করে সিঁদুরের ফোঁটা দাবে। তারপর শুভলগ্নে (মহেন্দ্রযোগ/অমৃতযোগ) পুরোহিত দই ও খই ছিটিয়ে মন্ত্র পড়ে কনে আশীর্বাদ করবে, কনের জন্য আনা শাঁখায় প্রথমে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দিবে তারপর কনের কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুরের ফোঁটা দিবে। তবে মুখচন্দ্রিকার বিয়ের পর লাজহোম বা যজ্ঞের সময় এবং চতুর্থ মঙ্গলের দিনে বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরাবে। পুরোহিতের কাজ শেষ হলে পাঁচজন আয়ো মিলে কনেকে আশীর্বাদ করবে, শাঁখাসহ কনের কপাল ও সিঁথিতে সিঁদুর পরাবে। তারপর বর ও কনে পক্ষের পুরুষ মহিলা সকল অভিভাবক একে একে আশীর্বাদ করবে তাদেরও শাঁখাসহ কনের কপাল ও সিঁথিতে সিঁদুর পরাতে কোন বাধা নেই । সবশেষে পুরোহিত শান্তি মন্ত্র উচ্চারণ করে শান্তি জল ছিটাবে। তারপর কনের ডানহাতে লোহার চূড়িসহ উভয় হাতে পলা, শাঁখা ও অন্যান্য স্বর্ণালঙ্কার পরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য কেউ কেউ এসব কনেকে ছুঁইয়ে রেখে দেয় এবং বিবাহের দিনে কনেকে পরায়।
বিবাহ বা শুভ কাজে বন্ধা নারী এবং বিধবা নারী অবাঞ্ছিত, তাদের কোন কাজে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক সংস্কারের প্রভাব আছে, তারা উৎপাদনের সম্ভাবনা হারিয়েছে তাই এই বিধি নিষেধ।
বলা হয় শাঁখা, পলা ও লোহার চূড়ি যথাক্রমে সত্ত্ব, রজ ও তমগুণের প্রতীক, কনে যেন এই তিনগুণের  সমন্বয়ের মাধ্যমে এদের অধীনে থেকে সংসারধর্ম পালন করে। বস্তুগুলো সবসময় কনেকে এ ব্যাপারে স্মরণ আর সতর্ক করিয়ে দেয়। স্বামীকে বশ করে রাখার উদ্দেশ্যে শাঁখা পরার রীতি ‘শিবমঙ্গলে’ উল্লেখিত হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানেই বিয়ের দিন-ক্ষণ সর্বসমক্ষে ঘোষণা করা হয়। পুরোহিত বিয়ের দিন দেখে বিবাহ তারিখ মুদ্রিত পঞ্জিকার পৃষ্ঠাটি খোলে রেখে পঞ্জিকায় সিঁদুরের শুভসূচক পাঁচটি টিকা দেন। আশীর্বাদ হিসেবে পঞ্জিকার পাতার ভাঁজে ধান দূর্বা রাখে। বরপক্ষের আনা ঝাঁপির দ্রব্যাদি সকলকে দেখানো হয়। বরপক্ষ ও কনেপক্ষ বর-কনেকে কে কী দিবে তা উপস্থিত সকলকে ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়। পানখিলি বরপক্ষ কোন তারিখে কখন দিবে জানানো হয়। কারণ বরপক্ষের পানখিলির পর কনেপক্ষ পানখিলি দেয় এবং বিয়ের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান আরম্ভ করে। এ সময় উভয়পক্ষ একে অপরকে বিয়ের নিমন্ত্রণ প্রদান করে। মঙ্গলাচরণ করে বরপক্ষ বাড়ি ফিরে পাড়া প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে পান-মিষ্টি খাওয়ায়। এ সময় মহিলারা বিয়ের গীত গায়।
বিবাহে ধান, দূর্বা, পান, সুপারি, মাছ ব্যবহার করার কারণ- বস্তুগুলো হল বংশবৃদ্ধির প্রতীক। মাছের ডিম থেকে অসংখ্য পোনা জন্মে। ধান, পান ও সুপারির ফলন হয় প্রচুর। দূর্বা শুকিয়ে গেলেও মরে না পানি পেলে বেঁচে ওঠে এবং সহজে বংশ বিস্তার করে। দূর্বাকে দীর্ঘজীবনের, আবার ধানকে ঐশ্বর্য্যের প্রতীকরূপেও গণ্য করা হয়। সুতরাং বিবাহের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহারে ভাবী দাম্পত্য জীবনকে সফল ও ফলবানরূপে দেখতে চায়, তারই কামনা-বাসনার প্রতিফলন এতে রয়েছে।
এক্ষেত্রে সিঁদুর বা সিন্দুর প্রসঙ্গে দু’ একটি কথা বলা আবশ্যক। বিবাহের আচারে আনুষ্ঠানিকভাবে সিঁদুর পরানোই মূখ্য বলে ধরা হয়। বিবাহে বধূর সীমন্তে সিঁদুর দেওয়া একটি প্রাচীন প্রথা। সিঁথিতে সিঁদুরের রেখা নারীর সৌভাগ্যের বা সধবা অবস্থার পাকা প্রমাণ বলে ধরা হয়। বৈদিক শাস্ত্রে এর ব্যবস্থা নেই। সামবেদীয় পদ্ধতিকার ভট্টদেব [একাদশ শতক] এবং যজুবেদীয় পদ্ধতিকার পশুপতি পণ্ডিত [দ্বাদশ শতক] দুই বাঙালি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতই তাঁদের পদ্ধতি পুস্তকে পৌরাণিক কোন শাস্ত্রে এর ব্যবস্থা খুঁজে না পেয়ে ‘শিষ্টসমাচারাৎ’ বা ভদ্রসমাজে প্রচলিত প্রথা অনুসারে সীমন্তে সিঁদুরদানের উপদেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে কোন মহিলার সিঁথিতে সিঁদুর সধবা লক্ষণ। তবে হ্যাঁ, একজন সধবার রজঃস্বলাকালে যেমন সিঁদুর ব্যবহারের নিয়ম নেই তেমনই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়ও সিঁদুর ব্যবহারের নিয়ম নেই। তিনি যে যৌন সম্ভোগের উপযোগী নন; এই স্ত্রী আচারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
লাল রঙ নবোদিত সূর্যের প্রতীক। সূর্যোপাসক কোন আদিম জাতির মধ্যে বিবাহ আচারে সূর্যের প্রতীককে স্বামী নববধূর ললাটে সূর্যের তেজ ধারণ করিয়ে শুভকার্য সম্পন্ন করেছিলেন বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
ছোটনাগপুরের অধিবাসী ওরাওঁ বীরহোড় প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কনের সিঁথিতে সিঁদুরদানই বিয়ের মূখ্য আচার। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘ইসুং সিন্দ্রি’। অনার্য ভাষার এই ‘সিন্দ্রি’ শব্দটি থেকেই সিন্দুর শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। ওরাওঁ বিয়েতে বর কনেকে সিঁদুর দান করলে বিবাহ অর্ধেক হল বলে ধরা হয়। এরপর কনের বৌদি কনের তর্জনীটি ধরে তাতে সিঁদুর লাগিয়ে বরের কপালে দিতে বললে, কনে এটি করলেই বিবাহ সম্পন্ন হল। এদের রীতি দু’জন দু’জনকেই সিঁদুর দান করবে অর্থাৎ সূর্যের তেজ দু’জনেই গ্রহণ করবে।
অনেকে মনে করেন, অনার্য ভারতে অসভ্য জাতির কন্যাহরণ কালে যুদ্ধবিগ্রহে রক্তপাত ঘটত, যার জয় হত সেই হরণকারী যুবক নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত বের করে সেই অপহৃতা যুবতীর ললাটে রক্তের ফোঁটা দিয়ে তার উপর নিজের স্বত্ব বা অধিকার স্থাপন করার প্রমাণ দিত। সেই রক্ত ফোঁটাই পরবর্তীকালে সিঁদুর ফোঁটা হয়ে প্রাচীন বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আবার সিঁদুরকে ‘বশীকরণ’ এর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলেও অনেকে মনে করেন।

রূপসী ব্রত : পুরোহিত ডেকে বিধি অনুসারে বিয়ে উপলক্ষে কালী পূজা করা হয়। সমর্থ হলে কালীর প্রতিমা গড়ে পূজা করা হয়। তবে ঘটেই রূপসী পূজা করা হয়। রূপসীর ভেরুয়া মাথায় নিয়ে বর/কনের মা ব্রতধারী সধবাদের নিয়ে রূপসী (শেওড়া) গাছ তলায় সম্মিলিতভাবে গীত গেয়ে যান; রূপসীর উদ্দেশ্যে নৈবেদ্যাদি নিবেদন করেন। রূপসীর গাছের একটি পাতা জল দিয়ে ধুয়ে এতে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দেন তারপর এই সিঁদুর মাথার চুল দিয়ে মুছে আনেন। রূপসীর সাথে বইনালা করেন (বোন সম্পর্ক পাতেন)। রূপসী তলায় আসা সকল সধবা একে অপরের শাঁখা ও কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেন তারপর সবাই রূপসীর প্রসাদ খেয়ে বাড়ি ফিরেন। রূপসীর প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফেরা বারন। বর/কনের মা বাড়ি ফিরলে কোন এক সধবা কর্তৃক হাতপাখায় পানি ঢেলে ছিটিয়ে কনের মাকে ভিজিয়ে দেয়।

খোলা বসানো ও চিড়া কুটা : পানখিলির পরে মঙ্গলের খোলা বসানো ও চিড়া কুটার লক্ষ্যে দশ মুষ্টি ধান সিদ্ধ করা হয়। লেপা-মোছা উঠানে আরগ (আলপনা) দেয়া হয়। ছয়টি মাটির পিঁড়া ও দুইটি মাটির খোলা (মাটির পাতিল/পিতলের হাঁড়ি) সাদাগুড়ি (চালের গুড়ো পানিতে গুলে) দিয়ে সাজানো হয়। তিনটে করে পিঁড়ে একসাথে নিয়ে চুলার মত করে বসিয়ে তার উপরে খোলা চাপানো হয়। ডানপাশের খোলাটি বরের এবং বাঁ পাশেরটি কনের খোলা, বরের খোলাটিতে পাঁচটি চন্দনের ফোঁটা এবং কনের খোলায় পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে পাঁচজন সধবা মিলিত হয়ে ধান দূর্বা দিয়ে খোলা দুটিকে আর্ঘিবে। বর/কনের মা হাত কেওড়া কেউড়ি (ডানহাত বা দিকে আর বাঁ হাত ডান দিকে নিয়ে) করে দু’টি চুলায় আগুন ধরাবে, খোলায় ধান দিবে, দু’হাতে দু’টি কলার পাঁচল (কলা পাতার ডাটা বা বৃন্ত) ধরে খোলায় ধান ভেজে অবশেষে ঘাইল-ছিয়া দিয়ে চিড়া কুটবে।
অতঃপর উঠানে পাটি বিছিয়ে চাটা-বগুনা ও রূপসীর ঘট এনে পাটির পূর্বদিকে রাখবে। পাটির উপরে নকশি কাঁথা/বিছানার চাদর বিছিয়ে পাঁচজন সধবা একটি পুষ্পথালিতে ২০টি পান, ১০টি সুপারি, ১০টি কলা, বাঁশের খইড়কা ১০টি, দই এর ঘটি, চিড়া, ধানের খই, বাতাসা, চিনি, সিঁদুর, চন্দন প্রভৃতি নিয়ে পানে খিলি দেয়ার ‌উদ্দেশ্যে বসবে।
 শহরের জীবন ধারায় খোলা বসানো ও চিড়া কুটার আচারটি আর পালন করা হয় না।

পানখিলি : পাঁচজন আয়ো মিলিত হয়ে দুইটি করে পান নিয়ে খইড়কা (বাঁশের চিলকা) গেঁথে পানে খিলি দেয়। বাঁশের খইড়কার পরিবর্তে আগে সোনা বা রূপার কাঠি ব্যবহার করা হত। আজকাল এর ব্যবহার সীমিত হয়ে গিয়েছে। খিলিতে চন্দন ও সিঁদুরের পাঁচটি করে ফোঁটা দেয়া হয়। সুপারী কাটা হয়। খিলিগুলো পুষ্প থালিতে নিয়ে একটি টাওয়েল দিয়ে ঢেকে ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিয়ে নেয়া হয়। অতঃপর তুলসী তলা, দেবস্থলী ও মন্দিরসমেত কমপক্ষে পাঁচটি স্থানে এই খিলিপান অর্পণ করা হয়।
পরে সকল আয়ো মিলে মিষ্টিমুখ করে এবং একে অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেয়। প্রথম খিলিটি তুলসী গাছে দেওয়া হয়। অন্যগুলো বিয়ের আগের দিন গঙ্গায়, দেবস্থলীতে ও আভ্যদিকে দেওয়া হয়।
দেবস্থান থেকে ফিরে পাঁচজন সধবা রমণী মিলে ঘরে একটি প্রজ্জ্বলিত লণ্ঠন বেঁধে রাখবে। লণ্ঠনটি রাতভর জ্বলবে, কেউ স্থানচ্যুত করবে না। এবারে রমণীগণ একটি কুলায় কিছু ধান রেখে এর উপরে একটি পাটা (শিল) এবং পাটার উপর পুথাইল (নোড়া) রেখে পান, সুপারি ও ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। কাচা হলুদ, সরিষা প্রভৃতি  বাটার জন্য এর সাথে রাখা হবে। ঘাটস্নানের আগ পর্যন্ত এই পাটা-পুথাইল স্থান চ্যুত করা যাবে না।
বিবাহে পানেখিলি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলেই অনুমান করা যায়। বরের বাড়িতে পানেখিলির পরেই কনের বাড়িতে বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান আরম্ভ করা হয়। আর পান-সুপারির কথা কী আর বলা যায়, বিবাহ তো বটে; সকল মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠানে পান-সুপারির গুরুত্ব অপরিসীম। খুব প্রাচীনকাল থেকেই এর ব্যবহার চলে আসছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ ধনপতি সওদাগরের বিবাহ উপলক্ষে যে অধিবাস প্ররণ করেছিলেন সেখানে এই পান-সুপারির (পান গুয়া) উল্লেখ রয়েছে-
‘তৈল সিন্দুর পান গুয়া              বাটা করি গন্ধ চূয়া
আম্র দাড়িম্ব পাকা কাঁচা।
পাটে ভরি নিল খই              ঘড়া ভরি ঘৃত দই
সাজয়্যা সুরঙ্গ নিল বাছা’।
বশীকরণ ক্রিয়া সম্পাদনের উপকরণ হিসেবে পান সুপারির প্রয়োগ দেখা যায়। বলা হয়, পানের রস কামোত্তেজক এবং কাচা সুপারি নেশা ধরায়।

আদরী/আদ্রী স্নান : আদরী স্নানের নিয়ম বর, কনে উভয়ের ক্ষেত্রে সমান। আমসর (আম্র পল্লব) সমেত সাতটি ঘট, একটি লোটা ও একটি কলসী নিয়ে বর/কনের মা জল ভরে আনবে । তবে আরও আয়ো মহিলা কিংবা অবিবাহিতা মেয়েও সাথে যেতে পারবে। জল ভরতে যাওয়ার আগেই বর/কনের মা ঘটগুলোকে ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। গঙ্গায় তেল সিঁন্দুর দেওয়ার জন্য যাবতীয় উপকরণ যেমন- কলা পাতা, ধান, খই, দই, কলা, খিলিপান, আগর বাতি, মোম বাতি, কাস্তে বা কাচি একটি ডালায় সাজিয়ে সঙ্গে নিবে। বর/কনের মা উলুধ্বনিসহ গঙ্গায় তেল সিঁন্দুর, খই, দই, ডিম প্রভৃতি দিবেন। অতঃপর জল ভরে বাড়ি ফিরবেন। যেখানে বর/কনেকে স্নান করাবে, সেখানে নিয়ে জল ঢেকে রাখবে। বর/কনে সেখানে গিয়ে পূর্বমুখ হয়ে বসার পর পাঁচজন আয়ো রমনীসহ মা ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। তারপর মা কাচি বা কাস্তে দিয়ে বর/কনের ডানে-বামে শত্রু কাটবে। এরপর গায়ে মাটি দিয়ে হলুদ লাগিয়ে দিবে এবং উলুধ্বনিসহ শুভক্ষণে (মহেন্দ্র বা অমৃতযোগে) মা বর/কনেকে স্নান করাবে। স্নান সেরে বর/কনে উঠে যাওয়ার পর স্থানটি ভাল করে পরিস্কার করা হয়, যাতে স্নানের দ্রব্যাদি কারো পায়ে না লাগে। মা সন্তানকে আদরের সাথে এ স্নান করান বলে একে আদ্রী স্নান বলা হয়।

সুন্দা মাগাসুন্দা পিশা : অধিবাসের রাতে সুন্দা মাগা প্রভৃতি কাজ করা হয়। গীত-বাদ্য সহযোগে পাঁচটি ঘরে সুন্দা মেগে বাড়ি ফিরে উঠানে পাটি বিছাবে। পাটির উপর বর/কনের মা সুন্দা মাগায় প্রাপ্ত চাল একটি ঘটি দিয়ে পরিমাপ করবে, এরপর নৃত্য করবে। তুলসী তলায় সিঁদুর দিয়ে ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। তুলসী তলা থেকে তিনটি পিঁড়ার মাটি নিবে। সুন্দা ও মেথি এই মাটিসহ ভাজবে। বর/কনের মা-সহ পাঁচজন সধবা রমণী মিষ্টি মুখে দিয়ে এসব দ্রব্য একটি পাথুরে (পাথরের থালা) নিয়ে নিঃশব্দে মৌন থেকে কলার পাঁচল দিয়ে পিশে গুঁড়ো করবে। তারা একে অপরের হাতের উপর হাত রেখে নিঃশব্দে সুন্দাপিশা সম্পন্ন করেন। কোন কোন সম্প্রদায়ে এই সুন্দাপিশাকালে রমণীদের একটি বড় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখা যায়। এই গুঁড়োতে সুন্দা মাগায় প্রাপ্ত তেল মিশিয়ে দু’টি পান পাতায় উঠিয়ে রাখা হয়। একটির সুন্দা দিয়ে অধিবাসের ফোঁটা ও ঘাটনি দেয়া হয় অন্যটি পরবর্তী দিনের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়।

নরসুন্দর কর্তৃক বর/কনের নখ খুঁটা ও আশীর্বাদ প্রদান : অধিবাসের স্নানের আগে নরসুন্দর বর/কনের নখ নরুন দিয়ে নখ খুঁটে দেন অতঃপর তিনি ধান-দূর্বা বর/কনের মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করেন। তাকে বর/কনের পক্ষ থেকে সদক্ষিণা বস্ত্রদান করা হয়, সিধা (চাল, ডাল, তেল, লবণ, মশলা, সবজি প্রভৃতি ভোজ্যবস্তু) দেয়া হয়। বলা হয়, বিবাহ কাজে বর কনেকে নরসুন্দর এসে নখ কেটে না দিলে গায়ে অশৌচ এঁটে থাকে। তাই বিয়ের দিন এসে নখ খুঁটে দিয়ে যায়।

অধিবাসের স্নান (হলুদ মেখে) : পানখিলি অনুষ্ঠান শেষে রক্ষিত পাটা-পুথাইলে কাচা হলুদ ও সরিষা বেটে খানিকটা সরিষার তৈল মিশ্রিত করে রাখা হয়। যা অধিবাসের স্নানসহ প্রতিবার স্নানেই বর/কনের মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগিয়ে স্নান করানো হয়।

ধুৎরা/ধুতুরা কাটাইল তৈরি ও কনে/বরকে দেওয়া : আট্টিয়া কলার মাঞ্জ ৭টি, ডালিম পাতা, ধুতুরা পাতা, সরিষা, ধূপ, দূর্বা, ফুল ও একটি লোহার ফলা বা কাটারী একত্রে বেঁধে অধিবাসের স্নানের পর পর নরসুন্দর বর/কনের হাতে প্রদান করে। 

কনে/বর সাজানো : অধিবাসের টিকা (ফোঁটা/টিপ) শুভ অধিবাস অনুষ্ঠানের জন্য কনে/বরকে সাজানো হয়। বর ধূতি, পাঞ্জাবী পরিধান করে শাল/উত্তরীয় বামকাঁধে নিয়ে সাজে আর বধূকে লাল-খয়েরী শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়। বিবাহে কনের জন্য লাল রঙ বাঞ্ছনীয়।

কালীপূজা : পানখিলির পরে যে কোন শুভদিনে  দিবাগত রাতে বিবাহ উপলক্ষে প্রতিমায় কালীপূজা করা যেতে পারে। তবে আভ্যদিকের ব্যাপারের সময় কালীর ঘট বসিয়ে ঘটে পূজা করা হয়। যেখানে প্রতিষ্ঠিত কালী প্রতিমা রয়েছে সেখানে পূজা দিয়ে কেউ কেউ এ আচারটি সেরে ফেলে।

সোহাগ মাগা : বিয়ের দিন কন্যার সোহাগ ডালা সাজানো হয়। পুষ্পথালির মধ্যে চাল, কলা, ফুল, দূর্বা, তেলের বাটি, দইয়ের ঘটি, মিষ্টি প্রভৃতি একখানা টাওয়েল দিয়ে ঢেকে বর/কন্যার মা তার মাথায় তুলে নেয়। গীত বাদ্যসহ বাড়ি বাড়ি যায়। বাড়ির দরজার সামনে বারান্দায় আল্পনা এঁকে এতে কিঞ্চিত পান সুপারি দেয়। বাড়ির সধবা এর উপরে একটি পিঁড়ি এনে রাখে।  বর/কনের মা পুষ্পথালি মাথা থেকে নামিয়ে পিঁড়ির উপর রাখে। ওদিকে বাড়ির সধবা গৃহিনী একটি থালিতে চাল, ফুল ও দূর্বাসহ এর নিকটে তবে গৃহ অভ্যন্তরে রাখে। উভয়পক্ষ স্ব স্ব থালা দ্রব্যাদি জোকাড়সহ ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘে তারপর গৃহিনী নিজ থালির চাল ডানহাতে একবার ঠেলে বর/কনের মা এর থালিতে দেয়। অল্প কিছু সরিষার তেল পুষ্পথালিতে রাখা বাটিতে গৃহিণী ঢেলে দেয়। অতঃপর বর/কনের মাকে মিষ্টি, জল খাইয়ে পুষ্পথালি বর/কনের মা-র মাথায় তুলে দেয়। বর/কনের মা সোহাগ মেগে বাড়ি ফিরে উঠানে একটি পাটি বিছিয়ে সংগৃহীত চাল ঘটি দিয়ে মাপে তারপর নৃত্য করে।

গায়ে হলুদ : অতি সাম্প্রতিককালে গায়ে হলুদ আচারটি এ অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে চালু হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের জন্য একটি মঞ্চ করা হয়। মঞ্চে তিনজন বসতে পারে এমন একটি সোফা বসানো হয়। মঞ্চ ও সোফা সঙ্গত কারণেই আলোক সজ্জা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরিয়ে কনে সাজানো হয় এবং বরকেও পাজামা পাঞ্জাবী কিংবা মানানসই কোন বস্ত্র পরিয়ে সাজানো হয়। বর/কনে সোফায় এমনভাবে বসে যেন তার দু’পাশে দু’জন মানুষ বসতে পারে। সোফার সম্মুখে টিটেবিলে সাজিয়ে ফলমূল ও মিষ্টিসামগ্রী এবং বাটা কাচা হলুদ রাখা হয়। বন্ধু বান্ধবী আত্মীয় স্বজন বর/কনের পাশে বসে হাতে ফুল দিয়ে হলুদ লাগিয়ে দেয়। অতঃপর বর/বধূকে ফল ও মিষ্টি খাইয়ে দেয়। বর/কনেও সেই লোকটির মূখে ফল বা মিষ্টি তুলে দেয়। একই সাথে পাশেই এ উপলক্ষে মিউজিক বা সংগীতানুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। সাধারণত এ অনুষ্ঠানটি অধিবাস রাতের সন্ধ্যায় করা হয় তাই একে হলুদ সন্ধ্যাও বলা হয়। কেউ কেউ এর বদলে অনুরূপ একটি অনুষ্ঠান করে থাকেন একে বলা হয় পুষ্প চন্দন বা চন্দন সন্ধ্যা। এক্ষেত্রে হলুদের পরিবর্তে চন্দন ব্যবহার করা হয়। 

অধিবাসের টিকা দেওয়া : অধিবাসের টিকা (টিপ/ ফোঁটা) বর/কনেকে একই নিয়মে দেয়া হয়। টিকার জন্য আগেই সুন্দা, মেথি বাটতে হয়। সুন্দা মাগা, সুন্দা পিশা সম্পর্কে পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। অধিবাসের আনুষ্ঠানিকতা শেষরাতে শুরু করা হয়। তার আগে বর/কনের মা আয়োদের সাথে নিয়ে গীত-বাদ্যসহ পাঁচ ঘরে সুন্দা মাগে। শুভলগ্নে অধিবাসকালে অধিবাসের ঘট বসানো হয়। বর/কনে পূর্বমুখ করে বসানো হয়। তার সন্মুখে রাখা হয় ঘট এবং বিভিন্ন মিষ্টি সামগ্রীসহ দই, দুধ, চিড়া, খই, বাটা সুন্দা-মেথি, ধান, দূর্বা প্রভৃতি । পুরোহিত প্রথমে পান পাতায় রাখা সুন্দা-মেথি দিয়ে অধিবাসের ফোঁটা দেন, তারপর ধান, দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন, শেষে মিষ্টি সামগ্রীর খানিকটা খাইয়ে দেন। অনুরূপভাবে জেঠা-জেঠি, বাবা-মা, কাকা-কাকী, পিশা-পিশি, মেসো-মাসীসহ উপস্থিত সকল গুরুজনসহ কনিষ্ট ভাই বোনও বর/কনেকে অধিবাসের ফোঁটা দেয়। এক এক জনের ফোঁটাদান কার্য শেষ হলে বর/কনে বড়দের প্রণাম করে আর ছোটরা বর/কনেকে প্রণাম করে।
অধিবাসের সবটুকু রাত মহিলারা ব্যান্ড পার্টির বাদ্যের তালে তালে ধামাইল গান গেয়ে কাটায়। তবে ভোর রাতে বিচ্ছেদ ও মিলন গাওয়া হয়।
ব্যান্ডপার্টি বা বিবাহে বাদ্যানুষ্ঠান সম্পর্কে বলা যায়, ব্যান্ডপার্টি বা বিবাহে বাদ্যানুষ্ঠান একটি প্রাচীন প্রথা। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘ভূষণ, বস্ত্র্র, ভোজ্যদ্রব্য দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বাদ্যাদি উৎসবের মধ্যে কন্যা প্রদান করে পিতা নিত্য স্বর্গপ্রাপ্ত হন’।   মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে, ‘বিদ্বান ব্যক্তি অমঙ্গলের বিনাশ ও ঋদ্ধির জন্য বিবাহের সময় মাঙ্গল্য বাদ্যের ধ্বনি, বেদ পাঠ ও গান করাবে’। এই প্রাচীন প্রথা মেনে আজও বিবাহে বাদ্যানুষ্ঠান করানো হয়।

খাওয়া (দই-চিড়া) : অধিবাসের ফোঁটার কার্যক্রম শেষে অধিবাস স্থলেই একটি থালায় দই, চিড়া-মুড়ি বাবার সাথে কনে/মা-র সাথে বর খায়।

শোয়া/ঘুমানো:  দই, চিড়া খাওয়ার পর এই স্থানে শোয়েই তারা বাকি রাতটুকু কাটায়। বরকে তখন একাকী থাকতে দেয়া হয় না, মা-বাবা থাকতে না পারলে ভাই- বোন যে কেউ একজনকে বর/কনের সাথে থাকতে হয়। অতঃপর ঊষাকালে মা স্নান সেরে ঘাটনি দেয়।

ঘাটনি (প্রদীপ ভাসানো ও জল ভরে আনা) :  বর/কনের মা ঘাটনি দিতে জলাশয়ে যাবে। স্নান সেরে দু’টি ডুঙার  (কলা গাছের খোল দিয়ে তৈরি) একটিতে ১০টি ঘি মাখা সলতা, অন্যটিতে ৫টি ঘি মাখা সলতা রেখে সিঁন্দুর ও চন্দনের ফোঁটা দেয়। (কেউ কেউ বরের জন্য ৭টি সলতা চন্দন মেখে এবং কনের জন্য ৭টি সলতা সিঁদুর রাঙিয়ে রাখে এবং এতেও সকলে টিকা দেয়।) দু’টির সলতা জ্বেলে বর ও কনের নাম ধরে, বরের প্রদীপ ডানহাতে আর কনের প্রদীপ বামহাতে ধরে একসাথে একই সমান্তরালে রেখে জলে ভাসিয়ে প্রণাম করে। ধারণা করা হয় প্রদীপ দু’টি যদি একসাথে একই সমান্তরালে ভাসে তবে বর-কনের মধ্যে মিল হবে। আবার যদি আলাদা হয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করে ভাসে তবে বর-কনের মধ্যে মিল হবে না। সবশেষে জলভরে পিছন দিকে না তাকিয়ে মা জল নিয়ে আসে, যে জল দিয়ে দিনের বেলায় বর/কনেকে স্নান করানো হয়।

বিবাহ তারিখের আচার-অনুষ্ঠান

আভ্যদিক : বিয়ে একটি শুভকর্ম, এর মাধ্যমে দু’টি প্রাণ, দু’টি জীবন একসাথে অতিবাহিত করে। বিয়ের মাধ্যমে যেন তাদের অভ্যুদয় বা সমৃদ্ধি আসে তাই সকল আত্মীয় স্বজন থেকে যেমন আশীর্বাদ কাম্য তেমনি মৃত পূর্বপুরুষেরও আশীর্বাদ আবশ্যক । তাই পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের উদ্দেশ্যে যে শ্রাদ্ধ করা হয় তাকে বলা হয় আভ্যুদয়িক শ্রাদ্ধ । সিলেট অঞ্চলে একে বলা হয় আভ্যদিক। আবার একে বৃদ্ধি শ্রাদ্ধ, নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ প্রভৃতিও বলা হয়। ব্রহ্মপুরাণে ‘নান্দী’ শব্দের অর্থ সমৃদ্ধি, কল্যাণ বা উন্নতি বলা হয়েছে। তাই সমৃদ্ধি, কল্যাণ বা উন্নতি যার মুখ বা উদ্দেশ্য তাকেই নান্দীমুখ বলা হয়েছে।
বর/কনে স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরিধান করে এই শ্রাদ্ধবাসরে গিয়ে প্রথমে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে তারপর ব্রাহ্মণ ও গুরুজনদের প্রণাম করে।

ষোড়শ মাতৃকার ঘট বসানো : আভ্যদিকের ব্যাপারকালে কালীর ঘট বসিয়ে পূজা করার ন্যায় ষোড়শ মাতৃকার ঘট বসিয়েও পূজা করা হয়।

বরযাত্রা : যাত্রাকালে বরকে সাজিয়ে পূর্বদিকে মুখ করে একটি পিঁড়িতে বসানো হয়। সম্মুখে আম্র পল্লবসমেত একটি ঘট বসানো হয়। পুরোহিত প্রথমে মন্ত্র পড়ে আশীর্বাদ করেন, শান্তিজল ছিটিয়ে দেন। মুরব্বীরা আশীর্বাদ দেওয়ার পর পুরোহিত উচ্চারিত যাত্রা মন্ত্রের সহিত পুরোহিতের নির্দেশনা অনুযায়ী বর যাত্রা শুরু করে। পুরোহিতের অনুপস্থিতিতে পরিবারের জ্যেষ্ঠ কোন পুরুষ মানুষ এই দায়িত্ব পালন করে থাকে।

কনে বাড়িতে আপ্যায়ন : বিয়ে বাড়িতে পৌঁছালেই বাড়িতে উঠা যাবে না যতক্ষণ না বিয়ে বাড়ির মুরব্বীদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বর ব্যতীত অন্যান্য সকলেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ওদের সঙ্গে বিবাহ বাসরে যাবে, নচেৎ নয়। বরকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলেই বর এগুবে। কনের ছোট ভাই-বোন, বৌদি সকলে গেইট ধরে, বাড়ির বাইরে আটকে বসিয়ে আপ্যায়ন করে, কূট আপ্যায়ন; দুধ, সরবতের সাথে চুনের জল, নুনের জল প্রভৃতি অপানীয়ও পরিবেশন করে আবার গেইটের জন্য টাকাও দাবী করে। বর তাদের বায়না মিটালেই বিবাহ বাসরে যাওয়ার অনুমতি পায়। বিবাহ বাসরে বরকে মিষ্টি, দুধ, সরবত প্রভৃতি দিয়ে বিশেষভাবে আপ্যায়ন করা হয়। অপরাপর বৈরাতিদেরও মিষ্টি খাওয়ানো হয়।   

জামাইবরণ :  নতুন বরকে বরণের আগে কনের জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতিকে ঐ স্থানে বসিয়ে পুরোহিতের পরিচালনায় মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে কনের পিতা বা যিনি কনে সম্প্রদান করবেন সেই অভিভাবক কর্তৃক কিছু কাপড়-চোপড় উপহার দিয়ে থাকেন একে জামাইবরণ বলা হয়।

বরণা/বরবরণ : কনের পিতা কিংবা কনের যে অভিভাবক কনে সম্প্রদান করবেন তিনি, এক কথায়- কন্যাকর্তা পূর্বমুখী বসে;  বরকে পশ্চিমদিকে মুখ করে বরাসনে বসিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে অর্ঘ্য, আচমনীয়, চন্দন, পুষ্প, বস্ত্র এবং অলঙ্কার দিয়ে র্চনা করেন। দূর্বা ও আতপ চালের সঙ্গে বরের দক্ষিণ জানু ধরে মাস, পক্ষ, তিথি প্রভৃতির উল্লেখ করে উভয় পক্ষের তিন পুরুষের নাম, গোত্র ও প্রবরের উল্লেখ করে ‘অমুকী কন্যাকে বিয়ে করার জন্য তোমাকে অর্চনা করে বরণ করছি’ এই কথা বলে বরকে বরণ করেন। এ সময় বরের হাতে বরের যাবতীয় পোশাক পরিচ্ছদ তুলে দেন। এই পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে বর বিয়ের সকল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। এই আচারকে বরণা বলা হয়। বর কন্যাকর্তা প্রদত্ত পোশাক-পরিচ্ছদ ও মুকুট (টোপর) পরে দধিমঙ্গলে গমন করে।

দধিমঙ্গল : দই, খই, সাতনাল সুতা, সাতকুটি (সাতটি ছোট টুকরো করা) পান, সাতকুটি সুপারি একটি বরণ ডালায় নিয়ে ধান-দূর্বা দিবে। বিয়ের কুঞ্জে উঠার আগে বর ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়াবে। শাশুড়ি জল ও বরণডালা নিয়ে আসবে, বর ও শাশুড়ির মধ্যে একটি চওড়া কাপড় দিয়ে একে অপরকে আড়াল করে রাখবে। কোন একজন সুতা নিয়ে বরের আপাদ মস্তক দৈর্ঘ্য বরাবর সমান করে সাতবার সুতা প্যাঁচিয়ে সাতনাল সুতা নিবে। তারপর এই সুতা দিয়ে মুকুটের মধ্য বরাবর প্যাঁচিয়ে বেঁধে দিবে।  এ অবস্থায় বরের বা হাত পিছন দিকে এগিয়ে দিবে। শাশুড়ি বরের হাতটি জল দিয়ে ধোয়ে দই, খই প্রভৃতি হাতে দিবেন। পরে আবার ধোয়ে হাত মুছে দিয়ে হাতের অনামিকায় অষ্টধাতুর তৈরি দধিমঙ্গলের আংটি পরিয়ে দিবেন।
শাশুড়ি যে প্রক্রিয়ায় বরকে বরণ করেন তার উদ্দেশ্য হল বশীকরণ অর্থাৎ জামাই বাবাজীবন যেন চিরকাল তার মেয়ের গোলাম হয়ে থাকে।

বিবাহের কুঞ্জ : প্রায় ছয় ফুট ব্যাস বিশিষ্ট একটি বৃত্তের পরিধির সমান দূরত্ব আটটি কলাগাছ পূঁতে বিবাহের কুঞ্জ নির্মাণ করা হয়। পূর্ব বা উত্তরদিকের দু’টি করে গাছের ফাঁকা স্থান প্রবেশ বা বাহির স্থান হিসেবে রেখে বাকিটুকু সুতা, মালা, ফুল, কাগজ, বাঁশের চটি প্রভৃতি দিয়ে অলঙ্করণ ও বেষ্টন করে কুঞ্জ তৈরি করা হয়। কুঞ্জের মেজে লেপা-মোছা করে আল্পনা দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়। দধিমঙ্গল শেষে বর কুঞ্জে আসবে তাই কুঞ্জের ভিতর মধ্যবর্তী স্থানে একটি পাটি ও বিছানার চাদর বিছিয়ে এর উপর বর বসার হাতলযুক্ত একটি চেয়ার রাখা হয়। চেয়ারটি উপর অনুরূপ আর একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। মুখচন্দ্রিকার বিয়ের পর কুঞ্জের মেজে পরিস্কার করে আবার লেপা-মোছা করে এখানেই বিবাহ-হোম বা কুশণ্ডিকা সম্পন্ন করা হয় এবং এই কুঞ্জেই পরবর্তী দিন বাসী বিয়ে হয়।     

জামাইয়ের কুঞ্জে বসা : বর/বধূ পূর্ব বা উত্তরদিকে কুঞ্জে প্রবেশ করে পূর্বমুখী হয়ে চেয়ারে বসবে। দধিমঙ্গল থেকে শুরু করে মুখচন্দ্রিকার বিবাহ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বরকে একটি খোলা ছাতার নিচে রাখা হয়। ভগ্নীপতি/ ভাগিনা এরাই ছাতা ধরে।

কনে যাত্রা ও কনের কুঞ্জে আগমন : কনের মা ধানের মচায় (খড় দিয়ে বানানো পুঁটুলি যার ভিতরে ধান রাখা হয়।) কিংবা পাথুর (পাথরের থালা) উপুড় করে বিয়ের সাজে সাজানো কনেকে কোলে নিয়ে তার উপর বসেন।  উল্লেখ করা আবশ্যক যে, কনে সাজানোর সময় কনের কপালে কপালিকা (চূড়া) বেঁধে দেওয়া হয়। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে কনের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন, কনেকে মিষ্টিমুখ করান ও শান্তি জল ছিটিয়ে দেন। কনে তার সম্মুখে রাখা পাত্র থেকে ডানহাত বাম দিকে এবং বামহাত ডান দিকে নিয়ে (ক্রস হাতে) দুই মুষ্টি ধান নিয়ে ডানহাতের ধান বাবার উঘারে (গোলায়) ছুড়ে ফেলে দেয়। আর বামহাতের মুষ্টির ধান শ্বশুড় বাড়ির জন্য তার কাপড়ের খুঁটে বেঁধে দেয়া হয়। এই অবস্থায় কনে মুখচন্দ্রিকার বিবাহ তথা সাতপাকের উদ্দেশ্যে কুঞ্জে গমন করে।

কুঞ্জে উঠা : কনে নিয়ে কুঞ্জে প্রবেশ করেন সাধারণত কনের ভ্রাতৃবধূ, তারা একাধিকও হতে পারেন। তাদের সহায়তা ও নির্দেশনাতেই মূলতঃ  মুখচন্দ্রিকার বিয়ের সকল কাজ সম্পন্ন হয়। ভ্রাতৃবধূ ছাড়া বর ও কনের দু’জন কনিষ্ট ভাই দু’পক্ষের দু’টি চাটা-পাতিল (ঘি এর প্রদীপ) ধারণ করে বিয়ের পূর্ণ সময় কুঞ্জে অবস্থান করে।

কনে/বর উভয় পক্ষের চাটা-পাতিল (ঘিয়ের প্রদীপ) : বিবাহ-হোম বা যজ্ঞসহ সকল মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এই প্রদীপদ্বয় জ্বালানো থাকে। এই প্রদীপদ্বয় কনের সাথে শ্বশুড় বাড়িতে পাঠানো হয়।

বর-কনে বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ : বরপক্ষ বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হলেই বিয়ের আসরে বর-কনে বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করা হত । একে ‘পত্রিকা’ বা ‘উপহার’ বলা হত। এতে বর বা কনের উদ্দেশ্যে পদ্য থাকত। লেখক হিসেবে উল্লেখ থাকত ঠাকু’মা-ঠাকুরদা’, দাদু-দিদি মা, মা-বাবা, ভাই-বোন, ভগ্নিপতি, বন্ধু-বান্ধব, ভাই পো- ভাই ঝি, ভাগিনা-ভাগিনী প্রভৃতি। ৩৫-৪০ বছর আগেও এর প্রচলন ছিল, বর্তমানে নেই।

মুখ চন্দ্রিকার বিয়ে : বরের ভাই এবং কনের ভাই দু’জনে চাটা (ঘি এর প্রদীপ) ধরবে। প্রতি পাক (প্রদক্ষিণ) শেষে কনে বরের মুখোমুখি হলে সুন্দর মুদ্রায় হাত দু’টি কাঁপিয়ে ফুল/ ফুলের পাপড়ি, আবির প্রভৃতি বরের চরণে ছড়িয়ে দিয়ে প্রণাম করবে। ছয় পাক শেষে ধুতুরা কাটাইল বদল এবং সাতপাক শেষে মালা বদল করবে। তারপর  একে অপরে নিরীক্ষণ (শুভদৃষ্টি) করলে মুখ চন্দ্রিকার বিয়ে শেষ হবে। এবারে এখানেই মামা শ্বশুড় কর্তৃক কনের হাতে কলা তুলে দিবেন। বরের মাতৃকুল থেকে এই একটি আচারই পালন করা হয়। ফল সাদৃশ্যে এক কাঁদি কলা বধূর হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এক ঝাঁক পুত্র সন্তান কামনা।

যজ্ঞ/বিবাহ-হোম বা কুশণ্ডিকা : মুখচন্দ্রিকার বিবাহের পরে কুঞ্জের ভিতরেই এই অনুষ্ঠানটি নিষ্পন্ন হয়। তবে তার আগে সম্পদানদাতা মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বরের নিকট কনে বিধিমত সম্প্রদান করেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে বরের হাতে কনেকে যে আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রদান করা হয় তাকে কন্যাদান বলে। তারপর যজ্ঞের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
বৈদিক যুগের সূচনায় বিবাহের বিশেষ কোন আচার-অনুষ্ঠান ছিল না। পরস্পর শপথ গ্রহণের মাধ্যমেই বিবাহকার্য সম্পন্ন হত (ঋগ্বেদ, ১০ম মণ্ডল, ৮৫ স্তোত্র)। বিবাহে আচার-অনুষ্ঠানের বাহুল্যের উদ্ভব হয় অথর্ববেদ ও গৃহ্যসূত্রসমূহের যুগে। অথর্ববেদে বলা হয়েছে যে কন্যাকে নীল ও লাল শাড়ি পরিয়ে ও ঘোমটা দিয়ে বিবাহের স্থানে নিয়ে আসা চাই। বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে বর যেন কন্যার মুখ না দেখে। অনুষ্ঠানের মধ্যে ঋগ্বেদের যুগের শপথ গ্রহণই বলবৎ ছিল; তবে মন্ত্র, যজ্ঞ/বিবাহ-হোম বা কুশণ্ডিকা ও কন্যাকে একখণ্ড পাথরের উপর দাঁড় করানো (শিলারোহণ) ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়।
আনুষ্ঠানিক বাহুল্য বিশেষভাবে বর্ধিত হয় গৃহ্যসূত্রসমূহের যুগে। এ যুগেই বিবাহের শুভকাল ও সুলক্ষণযুক্ত কন্যা নির্বাচন সম্বন্ধে বিধান দেওয়া  হয়।
গৃহ্যসূত্রসমূহ সকলেই বিবাহ সম্পাদনের জন্য যে সকল বিধান দিয়েছেন তা  হচ্ছে-
১. বিবাহ যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে সম্পাদিত হওয়া চাই।
২. লাজহোম। ‘লাজ’ শব্দের অর্থ খই। ধান থেকে খই করে হোম করা হয় বলে এই হোমকে লাজহোম বলে। এই অনুষ্ঠানে কনের কনিষ্ট ভাই লাজ বা খই ভাগ করে দেয় এবং এই হোম শুধুমাত্র বিবাহ অনুষ্ঠানে কনের দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়। এই কাজের জন্য শালাকে বর কর্তৃক  শালা বরণ (পোশাক) দিতে হয়।
লাজ হোমের অগ্নির উত্তরে একখানা শিল এবং তার উপরে একটি নোড়া রাখা হয়। হোমের পর বর তার ডান পা দিয়ে বধূর ডান পা ঠেলে দিলে বধূ শিলের উপর আরোহণ করবে এবং তখন বর মন্ত্র উচ্চারণ করবে এই আচারটিকে শিলারোহণ বলে।
লাজ হোমের পর বর পশ্চিমমুখ হয়ে পূর্বমুখী কনের ডানহাত নিজের ডানহাতের উপর গ্রহণ করে  মন্ত্র বলবেন এই আচারকে হস্তগ্রহণ বলে। ঋগ্বেদের এই মন্ত্রের (১০/৮৫/৩৬) অনুবাদগত অর্থ: (বর বলছেন) ‘হে নারী, আমাদের উভয়ের সৌভাগ্যের উদ্দেশ্যে আমি তোমার হস্তগ্রহণ করছি, তুমি আমার সঙ্গে অন্তিম বয়স পর্যন্ত সর্বসৌভাগ্য ভোগ করো। আর তুমি আমার গৃহের স্বামিনী হবে। ‌এ কারণে, ভগ, অর্যমা, সবিতা এবং পুষা দেব তোমাকে আমার হস্তে প্রদান করলেন’।
৩. সপ্তপদীগমন । হোমের অগ্নির উত্তরে পিঁটুলি দিয়ে একটি ছোট গোলাকৃতি মণ্ডল আঁকা হয়। তার পূর্বে আর একটি, তার পূর্বে আরও একটি; এইভাবে মোট সাতটি গোলাকৃতি মণ্ডল আঁকা থাকে। বধূ পশ্চিমের শেষ মণ্ডলে দাঁড়াবে, বর তার পিছনে দাঁড়াবে। বধূর ডান পা সব সময় আগে থাকবে, বাম পা পিছনে থাকবে। বর তার ডান পা দিয়ে বধূর ডান পা প্রথম মণ্ডলের উপর ঠেলে দিবে, এভাবে সপ্তপদ বা সাতবার পা এগিয়ে যাবে। প্রতি পদেই একটি করে মন্ত্র বলতে হবে। এই সপ্তমপদ গমনের পরই নারীর স্বগোত্র অর্থাৎ পিতৃগোত্র নিবৃত্তি হয়।
৪. পাণিগ্রহণ। এই অনুষ্ঠানে বর তার ডানহাত কনের বুকের ওপর রেখে বলবে, ‘তোমার হৃদয় যেন আমার হৃদয় হয়, তোমার মন যেন আমার মন হয়, তুমি একমন চিত্তে যেন আমার আদেশ অনুসরণ কর, তুমি যেন আমাকে ও আমার সহচরদের অনুসরণ কর’। এবং
৫. উপরতি বা পরিহার অনুষ্ঠান উদযাপন।  বিবাহ পরবর্তী পর পর তিন রাত্রি স্বামী-স্ত্রী উভয়েই  মেঝের ওপর শয়ন করবে ও যৌন সংসর্গ পরিহার করবে। তিনদিন উত্তীর্ণ হওয়ার পর, তারা যৌন মিলন নিষ্পন্ন করবে।
পরবর্তীকালে উল্লেখিত আচার-অনুষ্ঠান মনুসংহিতায় অন্তর্ভুক্ত হলে মনুর বিধান ভারতবর্ষের সকল প্রদেশ ও অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিবাহে শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য হয়। তাই উত্তরকালের নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের বিবাহে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। সিলেট অঞ্চলের বিবাহেও এর ব্যতিক্রম হয় না।

পাশা খেলা : মুখ চন্দ্রিকার বিয়ে ও যজ্ঞ শেষে ঘরের ভিতরে একটি পাটিতে বর-কনে বসানো হয়। কনের বৌদি, ছোট বোন, বান্ধবী সহযোগে শুরু হয় পাশা খেলা। পুরোহিতের পরিচালনায় খেলাটি সম্পন্ন হয়।
খেলায় উপকরণ : সরাসহ (ঢাকনা) একটি আইহাঁড়ি, ধান, ২১টি কড়ি, কাচা হলুদ, সোনার আংটি ও রূপার আংটি।
খেলায় করণীয় : (১) বর কড়িগুলো হাতের তালুতে নিয়েই করজোড়ে প্রণাম করে বধূর হাতে দিবে। বধূও অনুরূপভাবে প্রণাম করে পুনরায় বরের হাতে দিবে। এভাবে সাতবার কড়ি আদান প্রদান করবে।
(২) বর কড়ি বামহাতে কড়ি চালনা করবে। তারপর বামহাতেই কড়ি তোলে বধূর হাতে দিবে, বধূ ডানহাতে কড়ি গ্রহণ করে কড়ি চালনা করবে। তবে ডানহাতে কড়ি তোলে বরের হাতে দিবে এভাবে উভয় সাতবার করে কড়ি চালনা করবে। ৭টি, ৫টি কিংবা ১০টি কড়ি যদি চিৎ অবস্থায় থাকে তবে একদান বলা হয়। যার দান বেশি সে-ই জয়ী।
(৩) অনেক জায়গায় খেলা শেষে কড়িগুলো জড় করার এক সুযোগে কড়িসহ পরাজিত বরের হাত একটি নোড়া দিয়ে চেপে ধরা হয়। বধূর জন্য কোন যৌতুকের প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত বরকে মুক্তি দেওয়া হয় না।
(৪) বর এবার আইহাঁড়িটি ধান দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ভর্তি করে উপরে কড়িগুলো রাখে। এরপর বামহাতের তর্জনী, কনিষ্ঠা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি সহযোগে সরাটি ধরে সরা দিয়ে হাঁড়িটি ঢেকে রাখে। অনুরূপভাবে বধূর ডানহাতের তিনটি আঙ্গুল দিয়ে সরাটি ধরে যতটা সম্ভব ধান ও কড়ি ফেলে দেয়। বর আবার হাঁড়িতে ধান ভর্তি করে, গুণে গুণে কড়ি উঠায়, যথারীতি সরা দিয়ে ঢাকে আর বধূও যথারীতি সরাটি ধরে ধান ও কড়ি কেটে ফেলে। এই কাজটি এইভাবে সাতবার চলে।
(৫) বর পূর্বের ন্যায় হাঁড়িতে ধান ভরে তার উপরে কড়ি, কাচা হলুদ, সোনা ও রূপার আংটি রেখে সরা দিয়ে ঢেকে নিবে। এবার ঢাকনা খানিকটা আলগা করে বধূকে দেখিয়ে বলবে, ‘দেখ, এখানে সোনা, রূপা, অর্থ কড়ি, মণি, মুক্তা আছে। (বর) এইসব এনে তোমার নিকট দিলে তুমি তা যত্ন করে রাখবে।‘ বধূ রাখার সম্মতি দিবে।
বস্তুগুলো দেখানোর পর বরের হাত সরার উপরে উপুড় করে রাখবে, এবার বরের হাতের উপরে বধূর হাতটি চেপে রাখবে। পুরোহিত বরের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘একদিনে সাতবার অন্যায় করতে পারে, সাতবার দোষ করলে বলো সাতবার ক্ষমা করবে’। বরের নিকট থেকে বধূকে ক্ষমা করার এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বধূর হাত সরানো হবে।
(৬) পুরোহিত একটি একটি করে নানান বস্তু দেখিয়ে বরের নিকট এর নাম জানতে চায়, বর বস্তুটির নাম বললে ছন্দ মিলিয়ে কৌতূকপ্রদ বাক্য বলে সকলকে আনন্দ দেয়।
পরিশেষে বর বধূর মুখে, বধূ বরের মুখে মিষ্টি তুলে দেয়, পানের খিলিও একে অপরকে তুলে দেয়। সবশেষে পুরোহিত ও মুরব্বীদের দ্বারা আশীর্বাদ প্রদানের মাধ্যমে পাশা খেলার কার্য সমাপ্ত হয়।
বিবাহের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের স্ত্রী আচারের একটি আবশ্যক উপাদান হচ্ছে কড়ি। বরণ ডালার উপর অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে কড়িও সাজানো হয়। মধ্যযুগে মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। তাই ঐশ্বর্য্যদেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে কড়িকে এক করে দেখে সৌভাগ্যলক্ষ্মীরূপেও এক্ষেত্রে কড়ি রাখা হয়। আবার আকৃতি সাদৃশ্যে চিৎ করা অর্থাৎ ওল্টানো কড়িকে নারীর যৌন অঙ্গের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। খেলার সময় বধূর বেশি সংখ্যক কড়ি চিৎ হয়ে পড়লে এককথায় পাশা খেলায় বধূ জয়লাভ করলে মহিলারা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় সঙ্গমকাল সুখের হবে। আর পাশা খেলায় সকলের প্রচেষ্টা থাকে বধূ যেন খেলায় জয়লাভ করে। তাই না হলে ছলাকলা করেও তারা বধূর জয় ঘোষণা করে।
   
রাতের খাবার : পুষ্পথালায় বিশেষভাবে অন্ন-ব্যঞ্জন সাজিয়ে বরকে খাবার পরিবেশন করা হয়। বর খাওয়ার পরে এই থালার অবশিষ্ট খাবার বধূকে খেতে দেওয়া হয়। বধূ প্রসাদজ্ঞানে এই উচ্ছিষ্ট খাবার গ্রহণ করে।  

বাসর শয্যা : সধবা ভ্রাতৃবধূ কর্তৃক নববধূকে বরের বিছানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাত্রিযাপন শেষে বর বিছানার নিচে কিছু টাকা রেখে দেন। সকালে কিয়াসিরা (যাদের সাথে বরের রহস্য বা হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক রয়েছে) এসে শয্যা তুলে, হাসি ঠাট্টা করে পরে এই টাকা দিয়ে তারা মিষ্টি খায়। এই আচারকে শয্যাতুলুনি বলে।

বিবাহের পরবর্তী দিনের আচার-অনুষ্ঠান

বর-কনের স্নান : বর-বধূকে পাশাপাশি জল চৌকি বা পিঁড়িতে বসিয়ে স্নান করানো হয়। আগেই চৌকি বা পিঁড়ি পেতে রাখা হয় যেন তারা পূর্বমুখি হয়ে বসতে পারে। এর পূর্বপার্শ্বে আম্র পল্লব সমেত জল ভরে একটি কাঁসা বা পিতলের কলস, অনুরূপ একটি লোটা ও সাতটি মাটির ঘটি ঢেকে রাখা হয়। এছাড়া একটি পিতলের থালিতে আশীর্বাদের ধান-দূর্বা, পূর্বে বাটা হলুদও রাখা হয়। এতদ্সঙ্গে সেখানে প্রদীপ ও ধূপ বা ধূপকাঠিও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।  বর- বধূ স্নানের আগে পাঁচজন সধবা রমণী জোকাড় দিয়ে (উলুধ্বনিসহ) বর-বধূর মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। অতঃপর বর তার বামহাত দিয়ে বাটা হলুদ নিয়ে বধূর পিঠে মাখাবে এবং হলুদ মাখানো হাত তার পায়ের তলায় মুছবে। এবারে বধূ তার ডানহাত দিয়ে হলুদ নিয়ে অনুরূপভাবে বরের পিঠে মাখাবে এবং মাখানো হাতটি তার মাথায় মুছবে। এবার বর সাতটি ঘটির জল একে একে বামহাত দিয়ে উঠিয়ে নিজের মাথার উপরে ডানদিকে নিয়ে বা কান বরাবর বধূর মাথায় ঢেলে দিবে। অতঃপর বধূ অন্যত্র গিয়ে স্নান করলেও বর এখানেই স্নান সমাপন করবে।
তবে এক্ষেত্রে বরের সাথে কনের ভগ্নীপতিদের বসিয়েও অনুরূপভাবে ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিয়া নিয়ে স্নান করানো হয়। এখানেই তাদের নতুন বস্ত্র ধূতি দান করা হয় তারা নতুন ধূতি পরিধান করে পরিধেয় ভেজা বস্ত্র বদল করে। 

বাসী বিয়ে : কুঞ্জের কেন্দ্রস্থলে আয়তাকার একটি গর্ত (পুকুর) করে জল ভরে রাখা হয়। গর্তটি আনুমানিক দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১২ ইঞ্চি ও ৬ ইঞ্চি হবে। মাটি গর্তের পূর্ব পাড়ে লেপে সুন্দর করে রেখে তার উপরে একটি শিলা (নোড়া) ও এক টুকরা লাকড়ি রাখা হয়। গর্তের চার কোণায় পাতাসহ ৭টি বরুয়া বাঁশের কঞ্চি পূঁতে সুতা দিয়ে সাতটি প্যাঁচ দিয়ে বাঁধা হয়। সবকিছু ঘিরে আল্পনা আঁকা হয়। স্নান সেরে সেজেগুজে বর বধূ কুঞ্জে এসে কঞ্চি প্রভৃতির সামনে পূর্বমুখী হয়ে বধূকে ডানে রেখে দাঁড়াবে। আচমন ও বিষ্ণুস্মরণ করে সূর্যার্ঘ্য দিবে। বরের বামহাতের কনিষ্ঠায় বধূর ডানহাতের কনিষ্ঠা দিয়ে ধরবে। এ অবস্থায় দু’টি হাত রুমাল দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। এভাবে হাত ধরা অবস্থায় বর সামনে ও বধূ পিছনে থেকে সাতবার ‘পুকুর’ কঞ্চি প্রভৃতিকে প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর সূর্য প্রণাম করলেই বাসী বিয়ে সমাপ্ত হবে।
             এখানে গর্ত ও শিলা নারী পুরুষের যৌনাঙ্গের প্রতীক এবং সূর্যকে উর্বরাশক্তির উৎস হিসেবে ধরা হয় কেবল মানুষের বংশ বৃদ্ধির জন্য নয়, উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধির জন্যও যা অপরিহার্য।   

আশীর্বাদ দেওয়া : মঙ্গল ঘট বসিয়ে গুরু পুরোহিতসহ সকল বয়ঃজ্যেষ্ঠগণ ধান দূর্বা দিয়ে বর কনেকে আশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ শেষে মায়ের কোলে কনেকে বসিয়ে একটি কাঁসার থালায় ধান রেখে ডান ও বাম হাতে দু মুঠো ধান নিয়ে বাম হাতের ধান কনের বাবার উঘারে (ধানের গোলা/ভাঁড়ার) এবং ডান হাতের ধান শ্বশুড় বাড়ির উঘারে রাখার জন্য নিবে।  

কনেসহ বরযাত্রা :  

বরের বাড়িতে কনেসহ আগমন : শাশুড়ি ঘি এর প্রদীপ জ্বেলে উলুধ্বনিসহ ধান দূর্বা দিয়ে আর্ঘিয়ে বর ও কনেকে মিষ্টি মুখ করাবে এবং বধূকে কোন স্বর্ণালঙ্কার উপহার দিয়ে বধূ বরণ করবেন। বর-কনে দণ্ডবৎ প্রণাম করে মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন।    

রাত্রি যাপন : বর বধূ স্বাভাবিকভাবেই রাত কাটায়।

বিবাহের তৃতীয় দিনের আচার-অনুঠান

কালরাত / কালরাতের জামাই : ঊষাকালে শয্যা ত্যাগ করে বর অন্য কোন বাড়িতে গিয়ে সেইদিন ও রাত অতিবাহিত করে। এই সময়কালে বর বধূর সাক্ষাৎ অমঙ্গল বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এই বাড়িতেও বর যথাযোগ্য মর্যাদা পায়। বরের আগমন উপলক্ষে এখানেও মহিলারা গীত গায়, আনন্দ করে।

কালরাতের জামাই স্নান : সাতটি ঘটি, একটি করে কলসী ও লোটায় পূর্বের ন্যায় জল ভরে এনে সধবা মহিলাকর্তৃক আশীর্বাদ দিয়ে পূর্বের ন্যায় যথারীতি স্নান করানো হয়।

বিবাহের চতুর্থ দিনের আচার-অনুষ্ঠান

রাত্রি যাপন শেষে বিয়ে বাড়িতে আগমন : অন্য বাড়িতে কাল-রাত্রি যাপন করলে ভোর বেলা মহিলাগণ গীত গেয়ে ঐ বাড়িতে গিয়ে বরকে নিজ তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। একটি গানের কলি এরূপ-
আমি শ্যাম কোথা পাই গো,
বল গো সখি কোন বা দেশে যাই।
পাইলে শ্যামরে ধরব গলে,
ছাড়াছাড়ি নাই গো ।
বর বাড়িতে এসে উঠানে দাঁড়াবে। নববধূ এসে পা ধোয়ে রুমাল দিয়ে মুছে দিবে। পায়ে তেল মাখিয়ে দিবে। বরকে মুখ ধোয়ার জল দিবে। বর মুখ ধোয়ে ঘরে প্রবেশ করবে। ওদিকে নববধূ উঠান ঝাড়ু দিয়ে গোবর ছিটা দিবে, দেবতার ঘর লেপা-মোছা করবে, গরু ঘরে গিয়ে ধান দূর্বা দিয়ে গরু ও গরু বাঁধার দড়ি আর্ঘিবে, নেচে নেচে গরুর গোবর পরিস্কার করবে।
নববধূকে পরীক্ষা করার জন্য চালের মধ্যে পান সুপারি রেখে ঘাইলে চাল কাড়তে দেয়া হবে।
ওদিকে বর তার শালাকে নিয়ে ঘরের দরজার মুখা বাঁধবে। শালা নিয়ে কলাগাছ রোপন করবে এবং শালাকে কলা ও মিষ্টি খাওয়াবে।   

জামাই স্নান : বর-বধূকে পাশাপাশি জল চৌকি বা পিঁড়িতে বসিয়ে স্নান করানো হয়। আগেই চৌকি বা পিঁড়ি পেতে রাখা হয় যেন তারা পূর্বমুখি হয়ে বসতে পারে। এর পূর্বপার্শ্বে আম্র পল্লব সমেত জল ভরে একটি কাঁসা বা পিতলের কলস, অনুরূপ একটি লোটা ও সাতটি মাটির ঘটি ঢেকে রাখা হয়। এছাড়া একটি পিতলের থালিতে আশীর্বাদের ধান-দূর্বা, পূর্বে বাটা হলুদও রাখা হয়। এতদ্সঙ্গে সেখানে প্রদীপ ও ধূপ বা ধূপকাঠিও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।  বর- বধূ স্নানের আগে পাঁচজন সধবা রমণী জোকাড় দিয়ে (উলুধ্বনিসহ) বর-বধূর মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আর্ঘিবে। অতঃপর বর তার বামহাত দিয়ে বাটা হলুদ নিয়ে বধূর পিঠে মাখাবে এবং হলুদ মাখানো হাত তার পায়ের তলায় মুছবে। এবারে বধূ তার ডানহাত দিয়ে হলুদ নিয়ে অনুরূপভাবে বরের পিঠে মাখাবে এবং মাখানো হাতটি তার মাথায় মুছবে। এবার বর সাতটি ঘটির জল একে একে বামহাত দিয়ে উঠিয়ে নিজের মাথার উপরে ডানদিকে নিয়ে বা কান বরাবর বধূর মাথায় ঢেলে দিবে। অতঃপর বধূ অন্যত্র গিয়ে স্নান করলেও বর এখানেই স্নান সমাপন করবে।
তবে এক্ষেত্রে বরের সাথে বরের ভগ্নীপতিদের বসিয়েও অনুরূপভাবে ধান-দূর্বা দিয়ে আর্ঘিয়া নিয়ে স্নান করানো হয়। এখানেই তাদের নতুন বস্ত্র ধূতি দান করা হয় তারা নতুন ধূতি পরিধান করে পরিধেয় ভেজা বস্ত্র বদল করে।  

সাজানো : বর ধূতি-পাঞ্জাবি পরবে বাম কাঁধে উত্তরীয় বা শাল ভাঁজ করে রাখবে এবং কপালে তিলক কেটে বরকে সাজানো হবে। বধূকে মঙ্গলের সময় বর পক্ষ থেকে যে শাড়ি-ওড়না অলঙ্কারাদি দেয়া হয়েছিল তা এখন পরিধান করবে। মঙ্গলে দেয়া প্রসাধন সামগ্রী দিয়েই আজ বধূ সাজানো হবে।

চতুর্থ মঙ্গল বিয়ে : উঠানে দু’টি পুকুর (ছোট্ট আয়তাকার গর্ত) করা একটিতে জল, অন্যটিতে দুধ থাকবে। পূর্ব দিকে পাড় দিয়ে পাতাসহ চারটি বৌরা বাঁশের কঞ্চি চার কোনায় পুঁতে নিয়ে চারটির অগ্রভাগে বেঁধে একত্র রাখা। সাতনাল সুতা দিয়ে কঞ্চি চারটি পেঁছিয়ে রাখা। একটি শিলা (নোড়া) ও এক টুকরা কাঠ পুকুর পাড়ে রাখা। ক্ষেত্রটিতে চালের গুঁড়ি দিয়ে আলপনা আঁকা। এখানে আবার সাতপাক হবে। পুরোহিতের পরিচালনায় সূর্য অর্ঘ্য দিবেন ও সূর্য প্রণাম করবেন। পরে এর উপর একটি দরজা ফেলে রাখবে, এই দরজার উপর বসে বরের মা জল খাবে।  

পাশা খেলা : এক্ষেত্রেও পাশা খেলা পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়।

আশীর্বাদ দেওয়া : পাশা খেলার পর বর কনেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠরা বর কনের মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। সধবারা এতদ্সঙ্গে জোকাড় বা উলুধ্বনি করেন। তারপর শিউলি দেন। আশীর্বাদ হিসেবে যে টাকা প্রদান করা হয় তাকেই শিউলি বলা হয়। বর্তমানে রকমারি সামগ্রী ‘পহার’ নামে শিউলির স্থান দখল করেছে। শিউলি দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল বরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা।

বর-বধূর গৃহে প্রবেশ : আশীর্বাদ শেষে মা বর-বধূকে বরণ করে ঘরে নিবে। একটি বলা (রোল করা) পাটি নিয়ে মা পাটির বলা ছাড়িয়ে দিবেন আর বর-বধূ পাটি বলে বলে ঘরে প্রবেশ করবে। ছোট ভাই-বোন দরজা আটকাবে, এদের সন্তুষ্ট করে বর কন্যা যাবে। ঘরে পাটি বিছিয়ে পাটির নিচে বস্তা রেখে মা বসবে আর মায়ের কোলে ডান পাশে বর ও বাম পাশে বধূ বসবে। রমণীগণ এসে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি কর গো?’ মা বলবে, ‘বৌ ও পুৎ কোলে নিই।‘ –‘পুৎ কেমন?’ ‘হাটে বাজারে কায়ে-কারবারে চাতুর’। ‘বৌ কেমন?’ ‘রান্না বাড়ায়, নাচে গানে শিলা অনে ভারি’। এইভাবে সাতবার জিজ্ঞেস করবে আর মা সাতবার জবাব দিবে। অতঃপর মায়ের কোল থেকে নেমে মাকে প্রণাম করবে। বধূ নেচে কোচবন্নি ছাড়বে। কোচবন্নির মাঝে খই, চিড়া, মিষ্টি, কলা চতুর্দিক বন্ধনা করে ছাড়বে।     

জ্ঞাতি/পঞ্চায়েতের সেবা ও আমন্ত্রিত অতিথি আপ্যায়ন : পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন ও অতিথি অভ্যাগতদের পঙক্তি ভোজন করানো তথা জ্ঞাতির সেবা দেওয়া হয়। বর ভোজনস্থানে উপস্থিত হয়ে দণ্ডবৎ প্রণাম করে আয়োজন তেমন কিছু নেই বলে দীনতা প্রকাশ করে আর এই ক্ষুদ্র আয়োজন দ্বারা ক্ষুধা নিবারণের জন্য সকলকে বিনীত অনুরোধ জানায়। গ্রামীন সমাজে এর রেশ কিছুটা থাকলেও শহুরে সমাজ থেকে এই ‘জ্ঞাতি বা পঞ্চায়েতের সেবা’ তিরোহিত হয়েছে।  

ফুল শয্যা : সধবারা বিশেষ করে বরের ভ্রাতৃবধূগণ বর কনে দু’জনকে নিয়ে নানা রকম ফুল দিয়ে সাজানো কমল বিছানায় শয়ন করিয়ে চলে যান। ফুল শয্যার রাতকে শুভরাত্রি বলা হয়।

পঞ্চম দিনের আচার-অনুষ্ঠান

শয্যা ত্যাগ ও কর্ম :  বধূ প্রভাতে ঘুম থেকে উঠে ঘর-দোর ঝাট দিবে, বাড়ির আঙ্গিনায় গোবর ছিটা দিবে এবং প্রয়োজনীয় স্থানে লেপা-মোছা করবে।  

বধূ কর্তৃক মাছ কটা ও ধোয়া : বধূকে মাছ এনে কাটতে দেওয়া হয়। শাশুড়ি, ননাস, ননদসহ পরিবারের মহিলারা পর্যবেক্ষণ করে বধূ এই কাজে কতটা দক্ষ। এই মাছই বধূকে ঘাটে স্নানের সময় নিতে হয়।

বর-কনের ঘাটে স্না, গঙ্গা পূজাগঙ্গায় তেল-সিন্দুর দেওয়া : ঘাটে যেতে বর এক হাতে লোটা, অন্য হাতে ছাতা ও কাঁধে গামছা নিবে। বধূর হাতে মাছের খলই ও কাঙ্খে পিতলের কলসি থাকবে। বর-বধূ ঘাটে নামার আগে বরের মা গঙ্গায় তেল সিঁদুর দিবে। তারপর বর-বধূ ঘাটে নামবে। বধূ মাছ ধোবে। উভয় একসাথে স্নান করবে। বধূ গঙ্গায় তেল সিঁদুর দিবে। জলাশয়ের পাড়ে গঙ্গা পূজা করলে গঙ্গাকে উভয়ে প্রণাম করবে। মাছের খলই নিয়ে ও কলসি ভরে জল নিয়ে বধূ বরের সাথে বাড়ি ফিরবে। বর বাড়ি এসে বিষ্ণু স্নান করাবে।

বর কর্তৃক বাজার করা : বর হাটে যাবে। হাট থেকে পান-সুপারি, সিঁদুর, মিষ্টি ও মাছ কিনে এনে বধূকে দিবে। এখন থেকে গৃহকর্ম শুরু।  

কনে কর্তৃক রান্না খাবার পরিবেশন করা : সাধারণত রাতের খাবারই বধূকে দিয়ে রান্না করানো হয়। রান্না শেষে বধূ খাবার পরিবেশনও করে। পরিবারের লোকজন ছাড়াও আত্মীয় কিংবা সমাজের মুরব্বী এমন দু’ চারজনকেও এক্ষেত্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বধূ খাবারের থালা সকলের সম্মুখে রেখে সকলের উদ্দেশ্যে খাবার গ্রহণ করার জন্য দণ্ডবৎ প্রণাম করে। এর মাধ্যমে দু’টি দিক বিবেচনা করা হয়। এক, বধূ রান্না ও পরিবেশন করার কাজে কতটুকু পরিপাটি ও দক্ষতা সম্পন্ন। দুই, বধূর ছোঁয়া ও রান্না করা খাবার গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে বধূকে স্বীকৃতিদান। এর মাধ্যমেই বধূ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে একাত্ব হয়।

স্তকরণের খানি কাপড়/ভাত কাপড় : বিবাহের আজ পঞ্চম দিনের দিবাগত রাত; আজ পর্যন্ত বধূ স্বামী বা শ্বশুড়ের সম্পদ থেকে রান্না করা খাবার গ্রহণ করে নি। প্রতিবেশী থেকে পাঠানো খাবার কিংবা বাবার বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা চাল রান্না করে খেয়েছে। আজ রাতে সকলের খাওয়ার পর একটি থালায় সাজানো অন্ন ব্যঞ্জন ও একটি শাড়ি কাপড় নিয়ে বর বধূর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আজ থেকে আমি তোমার খানি/ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম, আজীবন তা পালন করব’। বর এগিয়ে দিবে, বধূ তা দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করবে ও বরকে ভূমিষ্ট প্রণাম করবে।
বর্তমানে হস্তকরণের ভাত কাপড় চতুর্থ মঙ্গল অনুষ্ঠানের পর জ্ঞাতির সেবা/পঞ্চায়েতের সেবার খাবার থেকে নিয়ে এই দিনেই দিতে দেখা যায়।

ফিরাযাত্রা/দ্বিরাগমন : চতুর্থ মঙ্গল বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর সাতদিনের মধ্যে যে কোন একদিন বর বধূসহ তার বন্ধু-বান্ধব দু’ চার জনকে নিয়ে ফিরাযাত্রায় শ্বশুড় বাড়ি আসবে। তবে আড়াইদিনের বেশি থাকার নিয়ম নেই। এ সময়ের মধ্যে শ্বশুড় বাড়ি থেকে যাত্রা করে বধূ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। তবে বিবাহের সাতদানের মধ্যে ফিরাযাত্রা না করলে পঞ্জিকা দেখে কোন শুভদিনে ফিরাযাত্রা করার নিয়ম। 

পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিবাহ বা গর্ভাধান বিবাহ : বিবাহের পর প্রথম রজোদর্শনের ষোলতম দিনে (বর্তমানে কেউ কেউ ১২তম দিনে বা ৭ম দিনে) এই অনুষ্ঠানটি নিষ্পন্ন করে। বধূকে রজোদর্শনের দিন থেকে নানা রকম নিয়মনিষ্ঠা ও সংযত হয়ে গৃহের নিভৃতস্থানে থাকতে হয়। যেমন- ১ম চারদিন কেবলমাত্র ফলমূল ও চিড়া মুড়ি খেয়ে থাকতে হয়, ৫ম দিনে নাপিত এসে কামানোর পর স্নান করবে, তারপর থেকে অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত নিরামিষ আহার করবে আবার এদিন কিয়াসি (যাদের সাথে বধূর রহস্যের সম্পর্ক আছে) সধবাগণ ফুল, ফল, দূর্বা বধূর কোলে ছোঁড়ে দিবে আবার বধূ ফুল, পান সুপারি তাদের কোলে ছোঁড়ে দিবে। বধূ ফলগুলো খেয়ে নিবে এবং ফুল, দূর্বা প্রভৃতি নদী বা পুকুরের কাদায় নিয়ে পূঁতে ফেলবে। পুত্রলাভের উদ্দেশ্যে গর্ভের মঙ্গল কামনা করে এই অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে স্বামী ষোড়শমাতৃকার পূজা ও আভ্যুদয়িক (বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ) করে এরং স্বামী-স্ত্রী সূর্যকে অর্ঘ্যদান করে (পূর্বে এই অনুষ্ঠানেও বর বধূ সাতপাক দিতেন)। বর্তমানে কোন কোন সম্প্রদায়ের লোকজন এই অনুষ্ঠানটি আর করে‌ না।  

উপসংহার
মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান বিবাহ যুগে যুগে তার আচার অনুষ্ঠান ও কাঠামোয় রূপান্তর করে চলেছে কিন্তু তার লোকাচারে ও শাস্ত্রাচারে কখনও বিরোধ বাধেনি। বিবাহের প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানের প্রধান অনুসঙ্গ মেয়েলী গীত। এই গীত মহিলাদের নিকট বিবাহের শাস্ত্রস্বরূপ। বিয়ে জুড়ুনী (বিয়ের সম্বন্ধ আসার জন্য এ ধরনের গীত গাওয়া হয়) থেকে শুরু করে সকল আচার অনুষ্ঠানের জন্য ধারাবাহিকভাবে নির্ধারিত গীত রয়েছে। মহিলারা এগুলো অতি নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে প্রতিটি আচার পালনকালে পরিবেশন করে থাকেন। বলা বাহুল্য যে নিবন্ধটির কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় গীতসমূহ এক্ষেত্রে সন্নিবেশ করা হয় নি। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্য বাজনারও রীতি রয়েছে। ফলে প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানে আমোদ-প্রমোদ লেগেই থাকে। যা পারিবারিক ও সামাজিক জীবন প্রবাহকে সচল ও প্রাণবন্ত করে রাখে। কেবলমাত্র বর বধূর মঙ্গল কামনা কিংবা সুখী দাম্পত্য জীবন কামনাই নয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যও বিবাহের প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান অপরিহার্য।  

 

1 টি মন্তব্য:

  1. শিক্ষনীয় পোস্ট। অনেক নতুন তথ্য জানলাম স্যার। অশেষ ধন্যবাদ স্যার।

    উত্তরমুছুন