শ্রীশ্রীচণ্ডী-কথা
শ্রীশ্রীচণ্ডী একজন দেবীর নাম। শ্রীশ্রীচণ্ডী একটি গ্রন্থেরও নাম, যে গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেন দেবী চণ্ডী বা চণ্ডিকা। অর্থাৎ ‘চণ্ডী’র কথা বা দেবী মাহাত্ম্য যে গ্রন্থে আছে সেই গ্রন্থকেও ‘চণ্ডী’ বলে। দেবী চণ্ডীর পূজার যেমন বিধি আছে, চণ্ডীগ্রন্থেরও সে’রূপ পূজাবিধি আছে। চণ্ডীগ্রন্থ যেন চণ্ডীদেবীর প্রতীক। মা চণ্ডী যেমন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়, চণ্ডীগ্রন্থ তেমনই আমাদের পরম শ্রদ্ধার বস্তু । চণ্ডীগ্রন্থ বিধিমত পূজা করে চণ্ডী পাঠ করতে হয়; তবেই চণ্ডী পাঠের ফল পাওয়া যায়। চণ্ডীগ্রন্থের বর্ণনীয় বিষয় দেবী মাহাত্ম্য। গ্রন্থের সঙ্গে গ্রন্থের বিষয় অভিন্নভাবে ‘চণ্ডী’ নামে গাঁথা আছে। ‘চণ্ডী’ নাম উচ্চারণ করলেই ‘চণ্ডী’গ্রন্থ ও ‘চণ্ডিকা’দেবী –দু’টি ভাবই হৃদয়ে ভেসে ওঠে।
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বেদকে
ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব- এই চার ভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি আঠারোটি মহাপুরাণ ও ব্রহ্মসূত্র ( উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন ) রচনা করে অমর হয়ে রয়েছেন। এ’সব গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি শুধু ভারতবর্ষ নয় সারা বিশ্বকে
জ্ঞানের আলোকে দীপ্ত করে অজ্ঞান অন্ধকার দূর করে দিয়েছেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যেমন মহাভারতের
ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত, শ্রীশ্রীচণ্ডীও তেমনই অষ্টাদশ মহাপুরাণের
অন্যতম মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ( ৮১ থেকে ৯৩তম অধ্যায় )। গীতায় সাতশত শ্লোক আছে এবং চণ্ডীতে পাঁচ শত আটাত্তর শ্লোক আছে, যা সাতশত মন্ত্রে বিভক্ত। এক একটি মন্ত্রে হোম করার
বিধি আছে। কাত্যায়নী তন্ত্রে এই মন্ত্রবিভাগরহস্য বর্ণিত আছে। মন্ত্র সংখ্যার হিসেবে চণ্ডীকেও গীতার ন্যায় সপ্তশতী বলা হয়। প্রশ্ন জাগে, চণ্ডীগ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় দেবী
চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবী , কে তিনি?
শ্রীশ্রীচণ্ডী বললে তাঁকেই বুঝায় যিনি বেদের
ব্রহ্ম ও পুরাণের মহামায়া। যিনি জ্ঞানীর নিকট ব্রহ্ম, যোগীর নিকট পরমাত্মা ও ভক্তের নিকট ভগবান। যিনি অব্যক্ত অবস্থায় তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্ম, আবার ব্যক্ত অবস্থায় ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি অর্থাৎ যিনি নিশ্চল অবস্থায় নির্বিকার, নির্বিশেষ ও নিরুপাধি ব্রহ্ম, আবার সচল অবস্থায় সবিকার, সবিশেষ, সৃষ্টি-স্থিতি-ভঙ্গকারিনী ব্রহ্মশক্তি। যিনি জীবদেহে সর্বভাবময়ী, সর্বপ্রবৃত্তিময়ী, সর্ব-ইন্দ্রিয়-স্বরূপিনী, আবার চিৎবস্তু আত্মারূপে অবস্থান করেন। যিনি জীবদেহে ব্যষ্টিভাবে আত্মা, আবার সমষ্টিভাবে বিশ্বাত্মা, হিরণ্যগর্ভ ও বিরাট। যিনি নিজের স্বরূপ অক্ষুন্ন রেখে সমকালে নির্গুণ, সগুণ, অবতার ও আত্মা। যিনি সচ্চিদানন্দবিগ্রহ। যিনি জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি- এই তিন অবস্থার সাক্ষী। যিনি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী। যিনি অনন্ত নাম ও রূপ ধারণ করে জড় ও চিৎ স্বরূপে প্রকাশিতা। যিনি ভক্তগণকে বর ও অভয়দান এবং অভক্তগণকে মরণ-ভীতি প্রদান করেন। যিনি ভক্তগণকে সমকালে ভোগ ও মোক্ষ প্রদান করেন। যিনি লীলাময়ী।যিনি জগতের কল্যাণের জন্য নিত্য
হতে লীলায় অবতরণ করেন। যিনি অবিদ্যা মূর্তিতে জীবকে সংসারে বদ্ধ করেন, ভোগে আসক্ত করেন। আবার বিদ্যামূর্তিতে বদ্ধজীবকে আসক্তির বন্ধন হতে মোচন
করেন এবং তাঁর স্বরূপে অবস্থিতি করান। যিনি তাঁর আশ্রিত ভক্তগণকে মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে
অমরত্ব প্রদান করেন। যিনি ভক্তগণের অভীষ্ট পূরণের জন্য অতি সৌম্যমূর্তি হয়েও
প্রয়োজন মত অতি ভীষণমূর্তি ধারণ করেন এবং ভক্তগণকে ভীষণ অসুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা
করেন। যিনি “শরণাগত, দীন ও আর্তগণের পরিত্রাণ-পরায়ণা”। যাঁর কৃপায় অযোগ্য, যোগ্য পাত্র হয়, সাধারণ ব্যক্তি, অসাধারণ বলে গণ্য হয় এবং পার্থিব ও অপার্থিব সকল অভাব
জীবের পূরণ হয় ও বিদ্যা, যশ, ধন, প্রতিষ্ঠা আবার ভক্তি, বৈরাগ্য, তপস্যার শক্তি ও মুক্তিলাভ- সকলই সুলভ হয়। এই আমাদের মা! এই শ্রীশ্রীচণ্ডী!
ঋষি কণ্ঠে দেবীর একটি ধ্যানে ব্যক্ত
হয়েছে-
যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা
মাহিষোন্মুলিনী
যা ধুম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং
পাতু বিশ্বেশ্বরী।।
অর্থাৎ ‘তিনিই সেই চণ্ডিকা দেবী, যিনি ব্রহ্মাকে রক্ষা করার
জন্য মধু ও কৈটভ নামে দু’টি অসুরকে দলন করেছিলেন; যিনি আর এক যুগে দেবগণের রক্ষার্থ মহিষাসুরকে বধ করেন; যিনি অপর এক যুগে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়ের অনুচরগণ ( ধুম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ প্রভৃতি ) বধ করে শেষে শুম্ভ ও নিশুম্ভকেও দমন
করেছিলেন; দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার জন্য
বহুবার যিনি এই প্রকারে অবতার গ্রহণ করেছেন; যিনি ভক্তগণের সর্বকার্যের সিদ্ধি-প্রদায়িনী, যিনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-স্বরূপিনী, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠা, যিনি অষ্টশক্তি-সমন্বিতা, যিনি বহুরূপী হয়েও নবদুর্গার রূপ ধারণ
করে জগতে খ্যাতা হয়েছেন, যিনি বিশ্বের ঈশ্বরী; তিনিই আমায় রক্ষা ও পালন করুন’।
‘চণ্ডী’ কথার অর্থ ‘ক্রুদ্ধা, উগ্রা’। চণ্ড শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ চণ্ডী। দুষ্ট দৈত্যদলন কার্যের জন্য ব্রহ্মস্বরূপা
ব্রহ্মশক্তিকে যখন শান্তভাব ত্যাগ করে ক্রোধের পূর্ণ মূর্তি বা চণ্ডভাব ধারণ করতে হয়; যখন অবতার প্রয়োজনে মা ব্রহ্মময়ীকে মধুকৈটভ-অসুরদলনী তামসী যোগনিদ্রারূপে আবির্ভূতা হতে হয়, তখনই তিনি ‘চণ্ডী’ নাম ধারণ করেন। অসুরদলন-কার্য রজোগুণের, সেইজন্য তিনি ‘চণ্ডী’ বা কোপনা সাজেন। ব্রহ্মময়ী অতি স্নিগ্ধ, অতি সৌম্য কিন্তু শরণাগত
দেবগণকে বা ভক্তগণকে অসুর-পীড়ন বা সংস্কারের প্রবল
অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য অর্থাৎ দেবগণের বা সাধকের হিতার্থে তিনি প্রয়োজনমত
অতি ভীষণ ভাব ধারণ করেন। পরমাত্মা যখন দেখেন তাঁর সন্তানেরা নানা আসুরিক ভাবের
নিকট পরাজিত, লাঞ্ছিত ও পীড়িত হয়ে দুঃখের প্রতিকারের জন্য তাঁর শ্রীচরণে প্রপন্ন
হয়েছে, তখনই তিনি আর্ত ও প্রপন্ন সন্তানগণের দুঃখ দূর করার জন্য স্বয়ং যুদ্ধবেশে
সজ্জিত হয়ে ‘চণ্ডী’ মূর্তি ধারণ করে তাঁর কুপুত্র অসুরদের নাশ করতে আসেন।
করুণায়-ভরা চিত্তে তিনি তাঁর আশ্রিত ভক্তগণকে নির্ভয় করার জন্য নিষ্ঠুর হয়ে তাঁর
কুপুত্র অসুরদের বধ করেন এবং অসুরদের জড় দেহের সাথে তাদের দুষ্ট সংস্কার-রাশি
ধ্বংস করে তাদের প্রতি কৃপা করে তাদের অমৃতময় জীবন দান করেন।
অসুরদের নিকটে তিনি চণ্ডী—মূর্তিতে ও আচরণে। দেবগণ চণ্ডী স্মরণ করেন, দেবীর বর
ও অভয় পাওয়ার জন্য। তিনি চন্ডী-লীলায় এক হস্তে ভক্তগণের জন্য বরাভয় দান করেন এবং
অপর হস্তে অভক্তগণের জন্য শাণিত খড়্গ ও রক্ত-প্লুত অসুর মুণ্ড ধারণ করেন। ভক্তগণ
মায়ের বরাভয় দেখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে বড় সুন্দর, বড় স্নিগ্ধ ও বড় সৌম্য
দেখেন। অভক্তগণ মায়ের হাতে ভীষণ অস্ত্র ও কাটা মুণ্ড দেখে মায়ের মুখ পানে তাকিয়ে
মাকে ভীষণা, ভয়ঙ্করা ও অতি উগ্রা দেখে। চণ্ডী উপাসকের ভরসা এই যে, মা আমাদের
“ভীষণং ভীষণানাম্” অর্থাৎ সমস্ত ভয়ের কারণ সকলও মা-র চণ্ডী-মূর্তির সন্মুখে ভীত
হয়। মা এমন ভয়ঙ্করা মূর্তি ধারণ করতে পারেন, যা অপেক্ষা ভীষণা মূর্তি কল্পনাও করা
যায় না। ভক্তগণের বিপদের জন্যই মা-র চণ্ডী-লীলা। ভক্তগণের যখন বিপদাপদ থাকে না,
তখন মাকে চণ্ডী হতে হয় না। তবে ভক্তগণের সে সুদিন ঘটে না। যতক্ষণ না মাকে দর্শন
করা হয় ততক্ষণ আমরা অশান্তির মধ্যে থাকি। ততদিন আমাদের সাধনা থাকে বলে আমরা বিপদের
মধ্যে থাকি, কাজেই মাকে আমাদের সকলের জন্য এখনও চণ্ডী সাজতে হয়। জীব সংস্কারের
অত্যাচারে সর্বদাই পীড়িত । কারণ, জীব-সংস্কার ভগবৎ বিরোধী—কাজেই জীব সংস্কার অধীন বলে সাধনার পথে স্বয়ং যেতে
পারে না। যখন জীব মুক্তিপথে যাবার চেষ্টা করে তখন তার দুষ্ট সংস্কার তাকে বাধা
দেয়। সৎসঙ্গ ও সৎশাস্ত্র তাকে ঠিক পথে চলতে প্রবুদ্ধ করলেও তার দুষ্ট সংস্কার তার
আত্ম-দর্শনের চেষ্টাকে বারবার ব্যর্থ করে দেয়। তাই জীবকে পুরুষার্থ লাভ করতে হলে
আত্মশক্তির উপর নির্ভর না করে পরমাত্মার শরণাগত হতে হবে। বিশ্ব-জননীর শান্তিময়
কোলে চির-বিশ্রান্তি লাভ করার জন্য আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় মনে করবে এবং
আত্মা-রূপিনী মহামায়ার নিকট বরাভয় প্রার্থনা করবে। মহামায়া তখনই ভাগ্যবান সাধকের
মনোরথ পূর্ণ করার জন্য স্বয়ং যুদ্ধবেশে চণ্ডীরূপে আবির্ভূতা হন এবং ভক্তের সমস্ত
আসুরিক সংস্কার নাশ করে তাঁকে নির্ভয় করেন। সাধকের নিকট সাধনার অন্তরায় যা কিছু
সমস্তই বিপদ। কাজেই যতদিন না সাধনায় সিদ্ধি লাভ হচ্ছে, ততদিন সাধক বিঘ্ন-নাশের
জন্য শ্রীশ্রীচণ্ডীর উপাসনা করবে। মা-ও আমাদের শরণাগতবৎসলা বলে চণ্ডীমূর্তিতে
আবির্ভূত হয়ে সাধকের কাম-ক্রোধাদি রিপুগণকে চূর্ণ করে তাকে মুক্তিদান করেন।
কালকে গ্রাস করেন বলে যেমন মায়ের
একটি নাম ‘কালী’, সেইরূপ ‘চণ্ড’কে বা ‘উগ্র’কে বা রজতমগুণকে বা চণ্ড-মূর্তি
মহিষাসুরকে বা শুম্ভনিশুম্ভকে গ্রাস করেন বলে তাঁর আর একটি নাম ‘চণ্ডী’। যত বড়ই
চণ্ডভাব হোক না কেন, চণ্ডী তাকে চূর্ণ করেন। উপাখ্যান ছেড়ে ব্যক্তিগত সাধনার
ক্ষেত্রে বলা যায়- সিদ্ধিলাভ করতে হলে রজতমগুণকে সরিয়ে একমাত্র সত্ত্বগুণ ধরে
থাকতে হয়। সাধকের কাছে সত্ত্বগুণই প্রার্থনার বস্তু; চণ্ডভাব বা চঞ্চলতা সাধনার
প্রধান অন্তরায়। সাধক মনের সেই চণ্ডভাব বা স্বভাব সুলভ চঞ্চলতা মায়ের সাহায্যে দূর
করার জন্যই মাকে চণ্ডী বলে আরাধনা করতে হয়। মা চণ্ডী সাধককে সমকালে ভোগ ও মোক্ষ
প্রদান করেন। দেবতাদের স্বর্গভোগের বাধাদানকারী অসুরদের বধ করে মা আশ্রিত দেবগণকে
স্বর্গভোগ প্রদান করেন। সুরথ রাজার মত রাজ্যভ্রষ্ট ভোগাকাঙ্ক্ষী সাধক চণ্ডীর কৃপায়
শত্রুনাশ করে নষ্টরাজ্য ফিরে পায় ও দীর্ঘকাল ভোগ করে। আবার মায়ের হস্তে নিহত হয়ে
অসুরগণ আসুরিক সংস্কার বর্জিত হয় এবং সর্বোচ্চগতি বা মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। সাধক
প্রবৃত্তিমার্গে থাকলে ভোগ অব্যাহত রাখার জন্য এই চণ্ডীর আশ্রয় লয়; আবার
নিবৃত্তিমার্গে থাকলেও সমাধিবৈশ্যের মত মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য ঐ চণ্ডিকাদেবীরই
আশ্রয় নিয়ে থাকে। যে দিক দিয়েই দেখা যাক না কেন, ভক্তের জীবভাব দূর করার জন্য,
সাধকের অভীষ্ট পূরণ ও কল্যাণের জন্য, প্রপন্ন উপাসকের সমম্ত বিঘ্ন দূর করে তাকে
নির্ভয় করার জন্য, মা ব্রহ্মশক্তিকে “চণ্ডী” সাজতেই হবে। দেবীকবচ (৮) এ আছে- “যে ত্বাং স্মরন্তি দেবেশি রক্ষসি তান্ন সংশয়ঃ ।” অর্থাৎ হে দেবেশি, যে তোমাকে স্মরণ করে তাকে যে তুমি রক্ষা কর তাতে কোনও
সংশয় নেই। চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করতে গেলেই দেবীকে স্মরণ করতে হবে। সুতরাং স্মরণেই লাভ।
দেবী মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণে কী ফল, শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ে তা বর্ণিত হয়েছে। সে সব কথা দেবীর নিজের শ্রীমুখের কথা। বিশ্বাস করলেই ফল পাওয়া যায়। শাস্ত্র বিশ্বাসীর
জন্য, অবিশ্বাসীর জন্য নয়। এই কথাটি মনে রাখতে হবে। দেবীর কথাগুলো আমাদের বেদবাক্য ও একমাত্র অবলম্বন। সত্যস্বরূপা তিনি, সুতরাং দেবীর কথাও মূর্তিমান সত্য। জ্ঞানস্বরূপা তিনি, সুতরাং দেবীর কথাও জ্ঞানময়। আনন্দস্বরূপা তিনি, সুতরাং দেবীর কথাও আনন্দের মূর্তি, আনন্দের খনি।
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী বলেছেন- তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।
শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্তা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ ।। (১২/৭)
অর্থাৎ ‘অতএব আমার এই মাহাত্ম্য সমাহিতচিত্তে নিত্য ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করা কর্তব্য। কারণ তাহা অতিশয় মঙ্গলজনক’। ‘অতিশয় মঙ্গলজনক’--এই চণ্ডীর কথা আলোচনা করলে আমাদের কী লাভ এখন তা দেখা
যাক।
প্রথম লাভ—কল্যাণ ( ঐহিক ও পারত্রিক )।
দ্বিতীয় লাভ—পাপনাশ ও পাপজনিত আপদ নাশ।
তৃতীয় লাভ—দারিদ্রনাশ।
চতুর্থ লাভ—প্রিয়বিয়োগ নাশ।
পঞ্চম লাভ—শত্রু, দস্যু, রাজা, শস্ত্র, অগ্নি ও জলপ্রবাহ থেকে সমস্ত ভয় নাশ।
ষষ্ঠ লাভ—মহামারীজনিত সর্বপ্রকার উপদ্রব ও ত্রিবিধ উৎপাত দমন।
সপ্তম লাভ—দেবীর প্রসন্নতা ও সন্নিধি।
অষ্টম লাভ—নির্ভীকতা।
নবম লাভ—শত্রুক্ষয়।
দশম লাভ—বংশের উন্নতি।
একাদশ লাভ—শান্তিকর্মে সিদ্ধি।
দ্বাদশ লাভ—গ্রহশান্তি।
ত্রয়োদশ লাভ—দুঃস্বপ্ন সুস্বপ্নে পরিণতি।
চতুর্দশ লাভ— ডাকিনী ও পূতনাদি বালগ্রহ দ্বারা আক্রান্ত শিশুগণের শান্তিলাভ ।
পঞ্চদশ লাভ—বৈরভাব দূরীকরণ ও মিত্রতা স্থাপন।
ষোড়শ লাভ—রাক্ষস, ভূত ও পিশাচগণের বিতাড়ন।
সপ্তদশ লাভ—আরোগ্য।
অষ্টাদশ লাভ—শুভ মতি লাভ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি হয় ।
ঊনবিংশ লাভ—সমস্ত সঙ্কট হতে মুক্তি।
এতগুলো লাভ আমাদের হবে। এ সকলই দেবীর শ্রীমুখের বাণী। যদি কোন ব্যক্তি ইহলোকের যাবতীয় উন্নতি চায়, তবে তার এই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করা কর্তব্য। রোগ, শোক, আপদ, বিপদ প্রভৃতির বিনাশ সাধন সকল জীবেরই
কাম্য । আবার ভক্ত ও জ্ঞানী যারা তারা চায় মুক্তি অর্থাৎ জন্মান্তর নিবারণ। গৃহী কিংবা সন্ন্যাসী সকলেরই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনায় লাভ আছে। যদি আমরা বিশ্বাস করে থাকি, অতীন্দ্রিয় বস্তুকে বা ব্রহ্মকে
আমাদের ঋষিরা লাভ করেছিলেন, তবে সেই ব্রহ্মকে অনুভূতিতে
আনতে হলে ঋষি প্রদর্শিত পথেই যেতে হবে। তবেই চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করে ফল পাওয়া যাবে।
চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করলে এই প্রতীতি
হয় যে, এই চণ্ডীই জগতের রাষ্ট্রী ও জননী। আমরা তাঁর হাতের পুতুল। তিনিই যন্ত্রী, আমরা যন্ত্র। তিনিই কর্মফলদাতা। তিনিই জীবের অদৃষ্ট। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একগাছি
তৃণও স্থানচ্যুত করার শক্তি আমাদের বা বিশ্বসংসারের কারো নেই। এই সংসার মহামায়ার বিরাট
মায়া। তিনিই আসল কর্তা, আমরা নিমিত্ত মাত্র। তিনিই জীবকে সংসারে বন্ধন করেন, আবার তিনিই বদ্ধ জীবকে মুক্তি
দেন। তিনি প্রসন্ন হলেই বরদায়িনী হন। কল্পতরু তিনি, সে’জন্য কামনা অনুসারে জীবকে ভোগ ও মোক্ষ প্রদান করেন। তিনি তাঁর নিজের চরিত্র-কথা বা এই দেবী মাহাত্ম্য শুনলে অত্যন্ত প্রসন্ন হন।
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থ বা দেবী মাহাত্ম্য
তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ—দেবী মাহাত্ম্যের উপক্রমণিকা। দ্বিতীয় ভাগ—মূলগ্রন্থ। তৃতীয় ভাগ—রহস্যত্রয় । এক্ষেত্রে ভাগসমূহের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
করা হলো।
প্রথম ভাগে আবার চারটি বিষয় আছে। যথা- (১) দেবীসূক্ত, (২) অর্গলা-স্তোত্র, (৩) কীলক এবং (৪) চণ্ডীকবচ। এই চারটি স্তোত্র না পড়ে
চণ্ডীপাঠ করা নিষেধ। চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ করতে হলে বা চণ্ডীপাঠ সফল ও সার্থক
করতে হলে, এই চারটি স্তোত্র আগে পাঠ করে এর মর্ম
অনুধাবন করা আবশ্যক।
প্রথম ভাগ—দেবী মাহাত্ম্যের
উপক্রমণিকা
দেবীসূক্ত—ঋগ্বেদের অন্তর্গত আটটি মন্ত্র। এর ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভৃণ
এর কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্। বাক্ ব্রহ্মশক্তিকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করে বলেছিলেন, “আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাদেবী ও বিশ্বেশ্বরী”। শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থের মূল
উপাদান ও ভিত্তি ঋগ্বেদের এই দেবীসূক্ত। দেবীসূক্তের পরমাত্মাই চণ্ডীগ্রন্থে
মহামায়ারূপে বর্ণিত হয়েছেন। সুতরাং বেদের ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এবং পুরাণের মহামায়া
এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। দেবীসূক্তে যা আত্মা, চণ্ডীগ্রন্থে তা-ই মহামায়া। দেবীসূক্তে পরমাত্মার মাতৃভাব
বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। পরমাত্মার পিতৃভাব ও মাতৃভাব উভয়ই জীবের উপাসনার বিষয়। দেবীসূক্ত আলোচনা করলে ব্রহ্মাদি দেবগণ ও স্বর্গাদি-লোক-সকল প্রসবিনী ব্রহ্মস্বরূপিনী মায়ের
স্বরূপ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হয়।
অর্গলা-স্তোত্র—চণ্ডীপাঠের বিঘ্ন নাশ, অভীষ্ট সিদ্ধির প্রতিবন্ধ দূর ও বহির্মুখ মনকে অন্তর্মুখী বা মাতৃমুখী করার জন্য
এই অর্গলা-স্তোত্র পাঠ করতে হয়। অর্গল শব্দের অর্থ খিল বা হুড়কো। যেমন, দ্বারে অর্গল বা খিল দ্বারা
বদ্ধ করলে বাইরের কেউ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, অনুরূপভাবে এই অর্গলা-স্তোত্র পাঠ করলে কোন বিঘ্ন
বা বিপদ আসতে পারে না এবং বাহ্য বিষয় চিত্ত-ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে না। এই স্তোত্রে মাতৃমহিমার কথা খুব বেশি আছে। সে’জন্য এ-তে সিদ্ধি-প্রতিবন্ধক-রূপ পাপ নাশ হয়।
কীলক—‘কীলক’ অর্থ শাপ। দেবী-মাহাত্ম্য গ্রন্থের উপর মহাদেব-কৃত শাপ আছে। এই কীলক স্তুতি সেই শাপের উদ্ধার মন্ত্র। কীলক পাঠ করে চণ্ডীপাঠ করলে মহাদেব-কৃত শাপের
যেমন উদ্ধার করা হয় তেমনই পাঠকের অভীষ্টসিদ্ধি হয়। কীলক পাঠ না করে যিনি চণ্ডীপাঠ
করবেন, তিনি চণ্ডীপাঠের ফল পাবেন না, পূর্ণকাম হবেন না। তাই চণ্ডীপাঠের অধিকারী হতে
হলে এই কীলক পাঠ করতে হবে।
‘কীলক’ এর আর একটি অর্থ ‘চাবি’। তালাবদ্ধ ঘরে চাবি দিয়ে তালা খুলে যেমন ঘরের ভেতর প্রবেশ করা যায়, সে’রূপ গহন চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ
করতে হলে কীলক পাঠ দ্বারা তালা খুলতে হয়। চণ্ডী-রহস্য সাধারণের নিকট যাতে সহজে প্রকাশিত না হয়, তাই মহাদেব তা তালা দিয়ে অতি সঙ্গোপনে রাখলেন। যে ভক্ত চণ্ডী-রহস্য জানতে চায়, তাকে মহাদেবের এই তালা খুলতে হবে। কীলক-স্তবই এর চাবি। কীলক পাঠ করলেই সেই তালা খুলে যায় আর পাঠকের নিকট চণ্ডী-রহস্য প্রকাশিত হয়।
‘কীলক’ এর আর একটি অর্থ খোঁটা। যেমন, যাঁতার মধ্যস্থানে খোঁটার গোড়ায় যে
সকল ছোলা বা মটর থাকে সেগুলো যাঁতার পেষণে চূর্ণ হয় না, সে’রূপ যে সকল ভক্ত ভগবানের পাদপদ্মরূপ ‘কীলক’ অবলম্বন করে থাকে, তারা সংসারের পেষণে, শোকে ও দুঃখে চূর্ণ হয়ে যায় না বরং মহামায়ার আশ্রয় লাভ হয়।
অর্গলায় যেমন বিঘ্ননাশ হয়, তেমনি কীলকে অভীষ্টসিদ্ধি হয়।
কবচ—কবচ অর্থ বর্ম বা অঙ্গত্রাণ; যা পরিধান করে থাকলে শত্রুনিক্ষিপ্ত অস্ত্র-শস্ত্রাদি অঙ্গে লাগে না। কবচ দ্বারা দেহ আবৃত রাখলে শত্রুর আঘাত থেকে দেহ-রক্ষা হয়। চণ্ডী-কবচ পাঠ করলে আত্মরক্ষা করা
যায়। এই কবচ পাঠে নিজের স্থূল দেহ দশদিক হতে আগত বিপদসমূহ থেকে রক্ষা পায়। দেবীকে নিজ স্থূলদেহের বিভিন্ন অংশে কী কী ভাবে ন্যাস করতে হয়; কী প্রকারে নিজের সূক্ষ্মদেহকে অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহঙ্কারকে রক্ষা ও চালনা করার ভার মা চণ্ডীকে দিতে হয়; কী প্রকারে নিজের যশ, কীর্তি, সন্তান-সন্ততি, গৃহপালিত পশুপক্ষী, সম্পদ, ধর্ম, কর্ম প্রভৃতি সকল বিষয়ের সম্পূর্ণ ভার দেবী চণ্ডিকাকে
দিতে হয়; কী প্রকারে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গ পুরুষার্থ কেবলমাত্র ব্রহ্মশক্তির
শরণাগত হলে লাভ করা যায়—এই চণ্ডীকবচে
তা-ই বিশেষভাবে বর্ণিত আছে। তাই চণ্ডীকবচ আশ্রয় করলে
জীব ইহলোকে বিবিধ ভোগ-সুখ পায় এবং জীবনান্তে মোক্ষ প্রাপ্ত
হয়।
দেবীসূক্তে চণ্ডিকাদেবীর স্বরূপের কথা
পাওয়া যায়। অর্গলা-স্তোত্র
পাঠে চণ্ডীপাঠের বিঘ্ননাশ হয়। কীলকে পাঠকের অভীষ্টসিদ্ধি হয়। কবচে দেবীর আশ্রিত হয়ে জীব নির্ভয় হয়।
দ্বিতীয় ভাগ—মূলগ্রন্থ
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে
বিভক্ত। মা চণ্ডীর তিনটি চরিত্রের কথা নিয়েই—চণ্ডীগ্রন্থ। এগুলো হচ্ছে--প্রথম চরিত্র, মধ্যম চরিত্র ও উত্তর চরিত্র।
মায়ের প্রথম চরিত্র
নিয়ে প্রথম অধ্যায়—মধুকৈটভবধ। মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের বিনাশার্থে
ব্রহ্মার স্তবে আবির্ভূতা এক তামসী ( তমঃপ্রধানা, যোগনিদ্রারূপা ) দেবীর আবির্ভাবের কথা এক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। এই চরিত্রের দেবতা তমোরূপা মহাকালী। মায়ের এই চরিত্রকে ব্রহ্মগ্রন্থি-ভেদ বলে। মধুকৈটভ বধের আধ্যাত্মিক
ভাব—লোভ নামক রিপু দমন।
গ্রন্থের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়
মায়ের মধ্যম চরিত্র। এক্ষেত্রে মায়ের দুর্গামূর্তির আবির্ভাব, সসৈন্য মহিষাসুর বধ ও দেবতাগণের মাতৃস্তুতি বর্ণিত হয়েছে। মায়ের এই চরিত্রকে বিষ্ণুগ্রন্থি-ভেদ বলে। মহিষাসুর বধ বা ক্রোধ নামক রিপু দমন এর কাজ। মধ্যম চরিত্রের দেবতা মহালক্ষ্মী।
উত্তর চরিত্র—গ্রন্থের পঞ্চম হতে ত্রয়োদশ অধ্যায়। শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয়ের অত্যাচারে পীড়িত
ও লাঞ্ছিত দেবতাদের দ্বারা দেবী চণ্ডিকার স্তব, অম্বিকা দেবীর কৌষিকী মূর্তিতে আবির্ভাব, দেবীদূত-সংবাদ, ধূম্রলোচন, চণ্ডমুণ্ড, রক্তবীজ, নিশুম্ভ ও শুম্ভ প্রভৃতির সঙ্গে দেবীর
যুদ্ধ ও তাদের বধ, দেবতাদের কৃতজ্ঞতা-প্রকাশক নারায়ণীস্তুতি, দেবীর প্রসন্নতা ও দেবতাদের বরদান, দেবীর ভবিষ্যৎ বিবিধ অবতার গ্রহণের বিবরণ এবং দেবীমাহাত্ম্য
পাঠ ও শ্রবণের ফল পঞ্চম হতে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত বিশেষ ভাবে বর্ণিত আছে। শেষ বা ত্রয়োদশ অধ্যায়ে মেধা মুনির উপদেশে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের দেবী-আরাধনা ও সিদ্ধিলাভ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। মায়ের এই চরিত্রকে রুদ্রগ্রন্থি-ভেদ বলে। শুম্ভবধ বা কাম রিপু জয় এর কাজ। মায়ের এই চরিত্রের দেবতা মহাসরস্বতী।
চণ্ডী-গ্রন্থে তিন প্রকারের বর্ণনা আছে। ঘটনার বর্ণনা, যুদ্ধের বর্ণনা ও স্তবস্তুতি। চণ্ডীগ্রন্থে মোট চারটি উৎকৃষ্ট স্তুতি আছে।
প্রথম স্তব, প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্মাকৃত দেবীস্তুতি। এই স্তুতিকে বিশ্বেশ্বরীস্তুতি বলে। প্রলয় সলিলের উপর শয়ান ভগবান বিষ্ণুর
নাভিকমলে অবস্থিত ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে যোগনিদ্রামগ্ন এবং
মধু ও কৈটভ নামক উগ্র অসুরদ্বয়ের ভয়ে ভীত হয়ে বিষ্ণুর জাগরণ নিমিত্ত যোগনিদ্রারূপিনী
মহামায়ার উদ্দেশে এই স্তব করেছিলেন।
দ্বিতীয় স্তব, চতুর্থ অধ্যায়ে আছে। মহিষাসুর বধের পর দেবগণ দুর্গাদেবীর
এই স্তুতি করেছিলেন। এ-কে মহিষহন্ত্রীস্তুতি বলা
হয়। এই স্তুতির বিশেষত্ব হচ্ছে--এই স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবতাদের
প্রার্থনায় দেবী এই বর দেন যে, যে মানব এই সকল স্তব দ্বারা
দেবীর স্তব করবে, দেবী তার প্রতি সতত প্রসন্না থেকে তার
জ্ঞান, ঋদ্ধি, বিভবাদি ধনসম্পদ ও স্ত্রীপুত্রাদি বৃদ্ধি করবেন (শ্লোক, ৩৬-৩৭ দ্রষ্টব্য)। চতুর্থ অধ্যায়ে দেবীর এই বরদানের কথা
না থাকলে আমরা কেউ শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের ফল পেতাম না। দেবতাদের হিতার্থে দুর্গামূর্তিতে
মায়ের এই অসুর-দলনলীলার সাথে মানুষের কোন সংস্রব নেই। কিন্তু এই স্তবের ফলে দেবীর বরে মানুষের সঙ্গে দেবগণের ও দেবীলীলার সম্বন্ধ স্থাপিত
হয়েছে। এই স্তব অতি মনোরম, ভক্তির বিমল উচ্ছ্বাস।
তৃতীয় স্তব, পঞ্চম অধ্যায়ে আছে। পুনরায় দেবগণ কর্তৃক দেবীর
স্তুতি; যা শুম্ভ-নিশুম্ভ-বধার্থ করা হয়েছে। শুম্ভ ও নিশুম্ভ ইন্দ্রাদি-দেবতাদের অত্যাচার করে স্বর্গরাজ্য
থেকে বিতাড়িত করে। দেবীর পূর্বে দেয়া বর স্মরণপূর্বক বিপদ ও দুঃখের প্রতিকারের
জন্য দেবগণ দেবী চণ্ডীর এই স্তব করেছিলেন। এই স্তুতিকে দেবীসূক্ত বলা হয়।
চতুর্থ স্তব, একাদশ অধ্যায়ে আছে। দেবগণ কর্তৃক দেবীর স্তব, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের পর দেবগণের
কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক এই স্তুতি। এই স্তুতিকে নারায়ণীস্তোত্র বলে।
গ্রন্থমধ্যে স্তবগুলোর অপূর্বতা সর্বাধিক। এর মধ্যে তিনটি বিষয় একত্রীভূত হয়েছে। দার্শনিক তত্ত্ব, ভক্তিরস ও উচ্চ সাহিত্যের উপাদান। এই তিনের মিশ্রণে স্তবগুলো পরম প্রসন্ন-গম্ভীর হয়েছে। বেদান্তের গূঢ়তত্ত্ব এ সকল স্তবে অনেক জায়গায় ফুটে উঠেছে। জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত—তিন প্রকারের সাধকের রুচি অনুযায়ী ভাবের কথা এই সকল স্তবে
রয়েছে। চণ্ডীতত্ত্বের উজ্জ্বলতা ও গভীরতা এই সকল স্তবেই বিশেষ ভাবে উপলব্ধি হয়। তন্ত্রশাস্ত্রে মহাশক্তি সম্বন্ধে যে অনুভূতি, স্তবগুলোর মধ্যে তা পরিস্ফুট। তন্ত্রবিজ্ঞানের দার্শনিকতা জানতে হলে স্তবগুলো পর্যালোচনাপূর্বক
জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য।
চণ্ডীগ্রন্থের
সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান :
পুরাকালে সুরথ নামক একজন রাজা শত্রুর
নিকট পরাজিত হয়ে মনের দুঃখে বনে গমন করেন। ক্রমে তিনি মেধা মুনির আশ্রমে অবস্থান
করেন। ধনলোভে স্ত্রী ও পুত্রগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ধনবান সমাধি নামক এক বৈশ্য তথায়
উপস্থিত হন। রাজ্য হারা রাজা সুরথ ও পরিবার পরিত্যক্ত বৈশ্য সমাধি মিলিত হলেন।
তাঁরা একে অপরের সমস্যা অবগত হলেন। যে ধনলোভী আত্মীয় ও স্ত্রীপুত্রগণ তাঁদের
পরিত্যাগ করেছে, তাদের জন্যই উভয়ের চিত্ত স্নেহাসক্ত হচ্ছে, তাদের কুশলাকুশল নিয়ে
তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এই মায়ারহস্য সম্বন্ধে অবগত হতে তাঁরা উভয়ে মেধা মুনির
সমীপে উপস্থিত হন, মুনিকে প্রশ্ন করেন। মেধা মুনি মহামায়ার স্বরূপ বর্ণনা করেন এবং
বহু অবতারের মধ্যে মায়ের তিনটি অবতারের বিবরণ দেন। মধুকৈটভ বধ, মহিষাসুর বধ ও
শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ—মায়ের তিনটি অবতারের
তিনটি কাজ। দেবী মাহাত্ম্য শ্রবণ করে মেধা মুনির উপদেশে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য
দেবীর আরাধনার জন্য গমন করেন। নদীতীরে অবস্থান করে তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ দেবীসূক্তপাঠ
ও তার ভাবার্থ অনুধ্যান করতে করতে তপস্যারত হন। তাঁরা উভয়ে নদীতটে দুর্গাদেবীর
মৃন্ময়ী প্রতীমা নির্মাণ করে সংযতচিত্তে পূজা আরাধনা করেন। তিন বছর এরূপে দেবীর
আরাধনার ফলে জগদম্বা চণ্ডিকা সন্তুষ্টা হলেন। দেবী প্রত্যক্ষভাবে
আবির্ভূতা হয়ে বললেন যে, সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দেবীর নিকট যা যা প্রার্থনা
করছেন তা তারা পাবেন। দেবী তা তাদের প্রদান করবেন। স্ব স্ব প্রার্থনা অনুযায়ী, সুরথ রাজা তার হারানো রাজ্য ফিরে পাবেন ও
মৃত্যুর পর সাবর্ণি নামে অষ্টম মনু হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন—এই বর এবং সমাধি বৈশ্যকে মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য তত্ত্বজ্ঞানরূপ
বর প্রদান করে দেবী অন্তর্হিতা হন।
তৃতীয় ভাগ—রহস্যত্রয়
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থের শেষভাগে অপরাধ-ক্ষমাপণ-স্তোত্রম্, সপ্তশতীরহস্যত্রয় ও শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের ফল আছে। সপ্তশতীরহস্যত্রয় এখানে আলোচ্য বিষয়। (১) প্রাধানিক-রহস্য, (২) বৈকৃতিক-রহস্য ও (৩) মূর্তি-রহস্য—এই তিনটিকে
রহস্যত্রয় বলে। এতে যথাক্রমে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মূর্তির রহস্যের কথা আছে। দেবী চণ্ডিকাই এই তিনটি মূর্তিতে
আবির্ভূতা হন। তিনি স্ত্রীও বটে আবার পুরুষও বটে। বলা হয়েছে-
“মাতুলিঙ্গং গদাং খেটং পাণপাত্রঞ্চ ৰিভ্রতী।
নাগং লিঙ্গঞ্চ যোনিঞ্চ ৰিভ্রতী নৃপ মূর্ধনি।।” ( প্রাধানিক রহস্য- ৫ )
“এবং যুবতয়ঃ সদ্যঃ পুরুষত্বং প্রপেদিরে।
চক্ষুষ্মন্তো নু পশ্যন্তি নেতরেহতদ্বিদো
জনাঃ ।।”
( প্রাধানিক রহস্য- ২৪ )
অর্থাৎ ‘হে নৃপ, ইনি হস্তে লেবু ( বা শ্রীফল ), গদা, খেট ( চর্ম ) ও পানপাত্র ধারণ করেন এবং মস্তকে নাগ ( ব্রহ্মার চিহ্ন ), লিঙ্গ ( শিবের চিহ্ন ) ও যোনি ( বিষ্ণুর চিহ্ন ) ধারণ করেন’।
‘পরে যুবতীগণ সদ্য পুরুষত্ব ( মহালক্ষ্মী ব্রহ্মত্ব, মহাকালী রুদ্রত্ব ও মহাসরস্বতী
বিষ্ণুত্ব ) প্রাপ্ত হলেন। চক্ষুষ্মান্-( জ্ঞানি- ) গণ এই তত্ত্ব দর্শন করেন (অবগত হন), অপরে ( অজ্ঞানীরা ) নয়। কারণ, উক্ত তত্ত্ব জ্ঞানচক্ষুর
দৃশ্য, চর্ম-চক্ষুর অদৃশ্য’।
দেবী চণ্ডিকা সাকারা ও নিরাকারা দুইই, সমকালে। তাঁর অনেক রূপ ও অনেক নাম।
“নিরাকারা চ সাকারা সৈব নানাভিধানভৃৎ।।
নামান্তরৈর্নিরূপ্যৈষা নাম্না নান্যেন কেনচিৎ ।।” ( প্রাধানিক রহস্য- ২৯ )
অর্থাৎ ‘হে মহারাজ, সর্বসত্ত্বময়ী, ঈশ্বরী মহালক্ষ্মী নিরাকারা নির্গুণা হয়েও সাকারা ( সগুণা )। সাকার অবস্থায় তিনি বিবিধ নাম ও রূপ ধারণ করেন। নির্গুণরূপে তিনি সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ—এই স্বরূপলক্ষণের দ্বারা নিরূপ্যা ( লক্ষণীয়া ), কিন্তু প্রত্যক্ষ্যাদি অন্য কোন প্রমাণ দ্বারা বোধ্য নন’ ।
মধুকৈটভ বধের জন্য বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপিনী
দেবী চণ্ডিকার নাম তমগুণময়ী মহাকালী।
সকল দেবতার শরীর হতে যে অমিতপ্রভা দেবী আবির্ভূতা হয়েছিলেন, তিনিই ত্রিগুণময়ী মহিষমর্দিনী সাক্ষাৎ মহালক্ষ্মী। ( চণ্ডী, ২।১০-১৩ দ্রষ্টব্য। ) তিনি ক্রমে ক্রমে
অষ্টভুজা, দশভুজা, অষ্টাদশভুজা এবং সহস্রভুজা হয়েছিলেন।
“সর্বদেবশরীরেভ্যো যাবির্ভূতামিতপ্রভা।
ত্রিগুণা সা মহালক্ষ্মীঃ সাক্ষান্মহিষমর্দিনী।।” বৈকৃতিকরহস্য-৭
“অষ্টাদশভুজা পূজ্যা সা সহস্রভুজা সতী।” বৈকৃতিকরহস্য-১০
ধূম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ, নিশুম্ভাদি অসুরদলন করার জন্য যে কালী
মূর্তিতে দেবী চণ্ডিকা আবির্ভূতা হয়েছিলেন, সেই চণ্ডিকাদেবীই সত্ত্বগুণময়ী মহাসরস্বতী।
দেবী চণ্ডিকার অনেক অবতার ও অনেক রূপ। যখন যখনই দানবেরা দেবতাদের স্বর্গভোগে বাধা দিয়েছে, তখন তখনই দেবী চণ্ডিকা আশ্রিত দেবগণের কল্যাণের জন্য আবির্ভূতা হয়েছেন আর প্রয়োজন
মত মূর্তি ধারণ করে অসুরকুল সংহার করেছেন।
“কার্মুকঞ্চ স্ফুরৎকান্তিঃ ৰিভ্রতী পরমেশ্বরী।
শাকম্ভরী শতাক্ষী সা সৈব দুর্গা প্রকীর্তিতা।।” মূর্তিরহস্য- ১৫
অর্থাৎ, ‘সেই পরমেশ্বরী শাকম্ভরী উজ্জ্বলকান্তিযুক্তা ও শত-নয়না। তিনিই দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা।’
“বিশোকা দুষ্টদমনী শমনী দুরিতাপদাম্।
উমা গৌরী সতী চণ্ডী কালিকা সাপি পার্বতী।।” মূর্তিরহস্য- ১৬
অর্থাৎ, ‘ তিনিই বিশোকা, দুষ্টদমনী, পাপনাশিনী ও বিপত্তারিণী। তিনিই উমা, গৌরী, সতী, চণ্ডী, কালিকা ও পার্বতী নামে অভিহিতা।’
“ইত্যেতা মূর্তয়ো দেব্যা ব্যাখ্যাতা বসুধাধিপ।
জগন্মাতুশ্চণ্ডিকায়াঃ কীর্তিতাঃ কামধেনবঃ।।” মূর্তিরহস্য- ২১
অর্থাৎ, ‘তিনি হস্তে নানাবর্ণ ভ্রমর ধারণ করেন এবং তিনি মহামারী ( মহামৃত্যু ) নামে অভিহিতা। হে পৃথিবী পতি, জগন্মাতা চণ্ডিকা দেবীর এই সকল মূর্তি ব্যাখ্যাত হলো। এই মূর্তিসমূহ কামধেনুরূপে ( সর্বকামপ্রদারূপে ) কীর্তিতা।’
মহামায়ার কথা অর্থাৎ শ্রীশ্রীচণ্ডী
প্রসঙ্গে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। মায়ের কৃপায় পরে আরও বিশদ আলোচনার আশা
রইল। মা যেন তাঁর সুগভীর তত্ত্বে প্রবেশ করার সামর্থ্য প্রদান করেন। মা চণ্ডীর তত্ত্ব যেন সম্যক উপলব্ধি করতে পারি। তিনি যেন আমাদের সর্বপ্রকারে
রক্ষা করেন। মায়ের নিকট এই প্রার্থনা। মাকে প্রণাম।
“সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।”
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, নভেম্বর, ১৯৯২
২. সপ্তশতী-সমন্বিত চণ্ডীচিন্তা, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, শ্রীমহানামব্রত কালচারাল এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কলিকাতা, ১৪০১ বাংলা।
১. শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, নভেম্বর, ১৯৯২
২. সপ্তশতী-সমন্বিত চণ্ডীচিন্তা, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, শ্রীমহানামব্রত কালচারাল এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কলিকাতা, ১৪০১ বাংলা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন