সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিবিধ

বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সপ্তশতী অনুধ্যান



সপ্তশতী অনুধ্যান
ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তারাজ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই দু’টি ধারা বিদ্যমানএকটি বৈদিক , অপরটি তান্ত্রিকবেদ, বেদান্ত বৈদিক ধারার ভিত্তি। এ ধারা পূর্ণতা পেয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তান্ত্রিক ধারার ভিত্তি হচ্ছে অগণিত তন্ত্রগ্রন্থ। এ ধারার চরম পরিণতি এসেছে দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। বৈদিক ধারায়
সমস্ত বিশ্ব প্রপন্চের মূলতত্ত্বকে মহাশক্তিময়ী চৈতন্যসত্তা বা ব্রহ্ম বা পরমাত্মা বলা হয়ে থাকে। তান্ত্রিক ধারায় এই তত্ত্বকেই চৈতন্যময়ী মহাশক্তি বা মহাদেবী বলা হয়ে থাকে। একটিতে পুরুষবাদ, অপরটিতে শক্তিবাদ বিধৃত। “পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যচ্চ ভাব্যং” – এ হলো পুরুষবাদের মূলমন্ত্র। পুরুষ থেকেই জগৎ সৃষ্ট, পুরুষাশ্রয়েই জগতের স্থিতি, পুরুষেই চরম লয় প্রাপ্তি। বৈদিক শাস্ত্র মতে পুরুষই পরমব্রহ্ম। গীতাতেও পুরুষোত্তমতত্ত্বই মূল-তত্ত্ব। অপরপক্ষে “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা” – এ হলো শক্তিবাদের মূলমন্ত্র। শক্তি হতেই জগৎ জাত, শক্তিতেই জগৎ স্থিত, শক্তিতেই জগৎ বিলয়-প্রাপ্ত। তন্ত্র শাস্ত্রমতে শক্তিই পরব্রহ্ম। পুরুষতত্ত্ব শিব আছেন, শবতুল্য। চণ্ডীতে চৈতন্যময়ী মহাশক্তির মহিমা কীর্তন করা হয়েছে।
গীতা ও চণ্ডীতে আপাত পার্থক্য বোধ হলেও তত্ত্বগতভাবে দু’টি গ্রন্থে বিরোধিতা নেই। ঋক্ বেদের দেবীসূক্ত মধ্যেই চণ্ডীর বীজ নিহিত রয়েছে। দেবীসূক্তে যিনি মন্ত্ররূপা, চণ্ডীতে তিনি বিগ্রহরূপা ড. শ্রীমন্ মহানামব্রত ব্রহ্মচারিজীর ভাষায়, “বেদাদি শাস্ত্রের মহাসত্য, চণ্ডী আধ্যাত্মিক পরীক্ষা অর্থাৎ সাধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বেদ, গীতার মন্ত্র ও বেদান্তের সূত্র, চণ্ডীতে মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে।” চণ্ডীর ভাব, ভাষা ও বহু শ্লোকের মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছেএ দু’টি গ্রন্থের সম্বন্ধ এ নিবন্ধের আলোচ্য।
গীতা ও চণ্ডী কোন গ্রন্থই একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয়। গীতা মহাভারতের অন্তর্গত আর চণ্ডী মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত। দু’টি গ্রন্থই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস কর্তৃক প্রকাশিত। গীতায় সাতশত শ্লোক আর চণ্ডীতে সাতশত মন্ত্র রয়েছে তাই দু’টি গ্রন্থকেই সপ্তশতী বলা হয়।
অনেক শাস্ত্রগ্রন্থই সংবাদ বা বক্তা শ্রোতার কথোপকথনরূপে প্রকটিত আছেন। যেমন- মহাভারত, বৈশম্পায়ন-জনমেজয়-সংবাদ । ভগবত, শুক-পরীক্ষিত-সংবাদ। গীতা, কৃষ্ণার্জুন-সংবাদ। চণ্ডী, মেধা ও সুরথ সমাধি-সংবাদ। তবে, গীতা ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থেই ষট্-সংবাদ দেখা যায়। গীতা অর্জুনকে লক্ষ্য করে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ। এই উপদেশই সঞ্জয় বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। উহাই আবার বৈশম্পায়ন বলেছেন জনমেজয়কে। চণ্ডীতেও সেরূপ- মেধা মুনি দেবী-মাহাত্ম্য রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যকে বলেছেন। সে কথাই মার্কণ্ডেয় মুনি ভাগুরি মুনিকে বলেছেন। উহাই আবার পক্ষিরূপি দ্রোণমুনির চারপুত্র, জৈমিনি মুনির নিকট কীর্তন করেছেন। এ হচ্ছে চণ্ডীর ষট্-সংবাদ। গ্রন্থসমূহে যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে ঐ ছয় ব্যক্তি তার প্রধান দ্রষ্টা বা সাক্ষী।
গীতা ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থই গুরু-শিষ্য সংবাদ গীতার আচার্য, অর্জুনের রথের সারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বিষাদগ্রস্ত অর্জুন শরণাগত হয়ে ‘শিষ্যস্তেহহং’ ( গীতা-২/৭ ) বলে উপদেশ প্রার্থী হলে, শ্রীকৃষ্ণ গুরুপদে আসীন ( কৃষ্ণং বন্দে জগদ্ গুরুম্ )  হয়ে উপদেশ দানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ব্যাসদেব ‘শ্রীকৃষ্ণার্জুন সংবাদ’ বলে অধ্যায়টিকে উল্লেখ করেছেন। চণ্ডীতে মোহগ্রস্ত রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি, আচার্য মেধার শরণাগত হয়েছেন। শিষ্যদ্বয়ের প্রশ্নের উত্তরে মুনিবর দেবী মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন।
উভয় গ্রন্থের শ্রোতৃগণ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জিজ্ঞাসু হয়েছেন- তা কোন আধ্যাত্মিক বা পারমার্থিক সমস্যা নয়। উভয় ক্ষেত্রেই পারিবারিক ও ব্যবহারিক জীবনের সমস্যায় তাঁরা বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু এর সমাধান কল্পে আচার্যদ্বয় যে উপদেশ দিয়েছেন তা সর্বতোভাবেই পারমার্থিক। সমস্যা সমাধানে চণ্ডীর আচার্য, দেবী মহামায়ার তত্ত্ব উদ্ঘাটন করেছেন, আর গীতার আচার্য, আত্মতত্ত্ব ও পুরুষোত্তম তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন।
চণ্ডীর মূখ্য বর্ণনীয় বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ। গীতার আবির্ভাবও যুদ্ধের প্রাক্কালে। চণ্ডীর যুদ্ধ মূলত: সাধকের অন্তরেরগীতার যুদ্ধ বাস্তবের, বাহিরের। চণ্ডীর যুদ্ধ সূক্ষ্মস্তরের- দেবতায় ও অসুরে। এই দেবাসুরের তাত্ত্বিকরূপ গীতায় ভগবান অর্জুনকে বলেছেন-
“তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ
                নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা” ।। ১০/১১
-অর্থাৎ ‘যারা আমার ভক্ত, আমাতে চিত্ত অর্পণ করে প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে, তাদের অন্তরে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান আলোক দ্বারা আমি তাদের অজ্ঞান-তমঃ বিনাশ করি।’ সকলের অন্তরে অজ্ঞান-তমঃ আছে – উহাই অসুর। জীবনের স্বচ্ছন্দ বিকাশের পক্ষে উহাই ছন্দোহীনতা বা সুরবিরোধী অসুরভাব, আর উজ্জ্বল জ্ঞানদীপই মহাবিদ্যারূপিণী মহাদেবী। সকল আসুরিক শক্তির ইনি বিনাশকারী। অজ্ঞানতমোরূপ আসুরিকতা বিধ্বংস করতে মহাশক্তি দুর্গা প্রকটিতা। চণ্ডীর মহাদেবী নিখিল ভাস্বর জ্ঞানদীপের সমষ্টিভূতা মূর্তি। সুতরাং গীতার “নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা” মন্ত্রের মধ্যে চণ্ডীর অসুরধ্বংসকারী মহাযুদ্ধের রহস্যটি সূত্রাকারে বিরাজিত।
চণ্ডীর যুদ্ধ মনোময় ও বিজ্ঞানভূমিতে স্থিত। অসুরগুলো মনোময় ভূমির বস্তু, মহাদেবী বিজ্ঞানময় ভূমির প্রজ্ঞাঘন শক্তি। এই দু’য়ে যুদ্ধ। গীতার যুদ্ধ কিন্তু মানুষের মাটির উপর। একই অন্নময় প্রাণময় ভূমির নীতির দুর্নীতির যুদ্ধ। গীতার যুদ্ধ রাজনৈতিক সমর, চণ্ডীর যুদ্ধ সাধন-সমর। গীতার কথা যুদ্ধের মুখে, চণ্ডীর কথা যুদ্ধের মধ্যে। চণ্ডীর প্রথম চরিতের প্রথমাংশ ভূমিকা বা ঘটনার ক্ষেত্র প্রস্তুতি। গীতার প্র্রথম অধ্যায়ও তা-ই। চণ্ডীতে সুরথ রাজা হলেও এখন রাজ্যভ্রষ্ট। রাজ্যচ্যুত রাজা বনে এসেছেন কিন্তু বাণপ্রস্থী হন নি। বনে আশ্রয় নিয়েও বিষন্নচিত্ত। আত্মীয়, স্বজন, রাজপ্রাসাদ, অশ্ব, গজ, পাত্র, অমাত্য সকলের অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তান্বিত। আর বৈশ্য সমাধি, ধনলোভী নিজ স্ত্রী-পুত্রগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনিও বনে এসেছেন।  রাজা ও বৈশ্যের বনেই দেখা, তাদের একই অবস্থা। আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েও তাদের প্রতি মমতাকৃষ্ট। তাদের প্রতি অতীব দুঃখার্ত (দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ, চণ্ডী- ১/৪৩ )
গীতায় অর্জুনের চিত্তও অনেকাংশে অনুরূপভাবে বিষাদযুক্ত। পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের হাতে অকথ্য লাঞ্ছনা ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাঁদের সহিত যুদ্ধ হবে তা বহু পূর্বেই স্থির হয়েছে। অর্জুন তপস্যা করে মহাশক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছেনঅর্জুন বীরপুঙ্গব। যুদ্ধ তাঁর কাছে খেলার মতো কিন্তু আজ রণাঙ্গণে সৈন্য দর্শন করতে করতে তাঁর এ কী হলো! অপ্রত্যাশিত “অকীর্তিকর” হৃদয়দেৌর্বল্য ও মহামোহ তাঁর উপস্থিত হলো। যাদের অশেষ হীনতার কথা তাঁর অন্তরে গাঁথা আছে সেই আত্মীয় পরিজনের প্রতি তিনি মমতাকৃষ্ট হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েই তিনি এমন মোহগ্রস্ত হলেন যে, তাঁদের বধ করা অপেক্ষা নিজ মৃত্যু শ্রেয়স্কর বলে তিনি বিবেচনা করলেন।
“যৎ প্রেমপ্রবণং চিত্তংবিগুণেষ্বপি বন্ধুষু” (চণ্ডী ১/৩৩) – গুণহীন স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয়গণের প্রতি আমার চিত্ত প্রেমপ্রবণ (মমতাযুক্ত) হয়েছে। চণ্ডীতে মেধা মুনির পদপ্রান্তে উপনীত হয়ে রাজা সুরথ এই মোহের কারণ জিজ্ঞেস করলেন- “দৃষ্টদোষেহপি বিষয়ে মমতাকৃষ্টমানসেৌ” (১/৪৪) – বিষয়ের দোষ স্পষ্টতঃ দেখা সত্ত্বেও আমরা তার প্রতি মমত্ব হেতু আকৃষ্ট হচ্ছি কেন? গীতার মধ্যেও অর্জুনের অনুরূপ প্রশ্ন-
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতিপুরুষঃ
            অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।। (৩/৩৬)
-‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও কে আমাদের চিত্তকে বলপূর্বক পাপে নিয়োজিত করে? উভয় প্রশ্নের মর্মার্থ একই। সব বুঝেও ভুল করি, পাপে লিপ্ত হই কেন’?
চণ্ডীর জিজ্ঞাসু রাজা ও বৈশ্য নিজেদের জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন। তাঁরা প্রশ্ন করছেন-
“তৎ কেনৈতন্ মহাভাগ যন্মোহো জ্ঞানিনোরপি” ( ১/৪৪ ) অর্থাৎ জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এই মোহ কেন? উত্তরে  ঋষি বলেছেন- তোমাদের এই বিষয় ও ইন্দ্রিয় মিলন হেতু যে অবরোধ তাকে যদি জ্ঞান বলো, তা হলে ঐরূপ জ্ঞান পশুপক্ষীদেরও আছে। “যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ” ( ১/৫০ ) বস্তুতঃ এই ইন্দ্রয় বিষয়- মিলনজ জ্ঞান অজ্ঞানেরই নামান্তর। চণ্ডীর এই উত্তরের প্রতিধ্বনি গীতাতেও শ্রুত হয়। অর্জুনকে মৃদুমন্দ ভর্ৎসনার সুরে শ্রীভগবান যেন এই কথাই বলেছেন- “অর্জুন তুমি জ্ঞানী ব্যক্তির মতো কথা বলছো ( প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ) ( গীতা, ২/১১ ), কিন্তু কাজ করছো অজ্ঞানের মতো। কারণ, যা শোকের বস্তু নয় ( অশোচ্য ) তারই জন্য শোক করছো। জ্ঞানী ব্যক্তিরা এরূপ করেন না”।
চণ্ডীতে সুরথ-সমাধির মোহগ্রস্ত ও উদ্ভ্রান্ত মনকে ঋষি প্রশান্ত করেছেন; চণ্ডীর মাহাত্ম্য কীর্তন করে এবং তাঁদের দ্বারা দেবী মহামায়ার পূজা করিয়ে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিষাদিত চিত্তকে স্বরূপস্থিত করিয়েছেন- উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে। সুরথ-সমাধির বাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে মাতৃদর্শনে, আর অর্জুনের মোহ কেটেছে সত্য-দর্শনে, বিশ্বরূপ দর্শনে।
চণ্ডী ও গীতার ভূমিকায় এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও পরিবেশের ভিন্নতা সুস্পষ্ট। চণ্ডীর উপদেশের পরিবেশ ঋষির তপোবন। তপোবনের প্রাকৃতিক শোভা  ও সৌন্দর্য- প্রশান্ত শ্রীসম্পন্ন, রমণীয় শান্তরসপ্রধান। চণ্ডীর আলোচ্য বিষয় দেবাসুর-সংগ্রাম- রজোময় ও তমোময়। পক্ষান্তরে গীতার পটভূমিকা এক মহাসমরের। যুদ্ধক্ষেত্র স্বভাবতঃই রজস্তমোগুণময়। কিন্তু গীতার আলোচ্য বিষয় আত্মতত্ত্ব- গভীর শান্তরসাত্মক। চণ্ডীর প্রশান্ত ভূমিতে যুদ্ধের অশান্ত বার্তা। গীতার অশান্ত সমরাঙ্গনে প্রশান্তর বার্তা।
চণ্ডীর মধ্যম চরিতে দেবী মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব ও গীতার বিশ্বরূপ দর্শন, তত্ত্বতঃ একই। উভয় ক্ষেত্রেই অনুভূতি বিজ্ঞানময় ভূমির- সামগ্রিক দৃষ্টি। বহুত্বে একত্ব, একত্বে বহুত্ব। সমগ্র সত্ত্বাকে একেবারে একত্র একত্বে দর্শন। “ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নম্” একস্থ সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বচরাচরের সকলই একদেহে স্থিত, ইহাই অপরোক্ষ দর্শন। ইহাই বিশ্বরূপ দর্শনের মর্মকথা।
চণ্ডীতেও মায়ের মহীয়সী স্ত্রীমূর্তির মধ্যে নিখিল দেবগণের শক্তিসমূহ প্রকটিত। ভিন্ন ভিন্ন দেব শক্তি একই বিশ্বজননীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তাঁর বাহুই বিষ্ণু, চরণই ব্রহ্মা, শ্রীবদনই শিব। কেশে যম, নাসিকায় পবন, নয়নে অগ্নি। বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন আয়ুধগুলো মায়ের শ্রীহস্তে শোভমান। তাই মায়ের দর্শনেই নিখিল দেবতা ও দৈবশক্তির দর্শন পাওয়া যায়। এক স্বরূপে বিশ্বদেবতার দর্শন, এক নিরূপম দর্শন।
গীতায় বিশ্বরূপ দর্শনে অর্জুনের ভীতিযুক্ত বিস্ময়। চণ্ডীতে মাতৃরূপ দর্শনে দেবগণের প্রীতিযুক্ত বিস্ময়। অর্জুন ‘হৃষ্টরোমা’ ভয়ে, দেবগণ ‘পুলকোদ্গমচারুদেহাঃ’ আনন্দে। দেবগণ জানেন, মা আমাদের সকল অমঙ্গল নাশ করবেন- তাই উল্লসিত। অর্জুন জানেন না ইনি কে, তাই জিজ্ঞেস করেছেন-
“আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপঃ”
উগ্রমূর্তি আপনি কে আমাকে বলুন। উত্তরে জানলেন- তিনি কাল, লোকসংহারে প্রবৃত্ত- “কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ”
চণ্ডী ও গীতায় শ্রীভগবৎস্বরূপের আবির্ভাবের কথা ঠিক একই রূপ। চণ্ডীতে দেবগণের স্তুতিতে প্রসন্না দেবীর সান্ত্বনা বাক্য-
“ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
               তদা তদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্”।। ১১/৫৫
‘যখনই যখনই দানবের অভ্যূদয়ে জীবগণ এপ্রকারে উৎপীড়িত হবে তখনই তখনই আবির্ভূতা হয়ে শত্রু নাশ করে শান্তি আনয়ন করবো।’ গীতাতেও ভগবান অনুরূপ বাণী বলেছেন- যখন যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যূত্থন হয়, তখন সাধুগণের রক্ষণ, দুষ্কৃতির দমন ও ধর্ম-সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। “সম্ভবামি যুগে যুগে উভয় বাণীতেই বুঝা যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবতী দুর্গা উভয়েরই দুঃখদুর্দশাগ্রস্ত উৎপীড়িত জীবের জন্য দয়া আছে। আমাদের দুঃখ তাঁদের প্রাণে লাগে। ডাকলে শোনেন। প্রয়োজন বোধ করলে মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করেন। অনুগ্রহ করে দুঃখ দূর করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছেন নন্দ-গোকুলে যশোদার ঘরেসেই যশোদার ঘরেই যোগমায়ারূপে কন্যা হয়ে একই রজনীতে একই সময়ে মা এসেছেন। গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া” -নিজ মায়াশক্তির সঙ্গে সম্ভূত হই। আর সেই আত্মমায়া-স্বরূপিণী দেবীই চণ্ডীতে বলেছেন, “নন্দগোপগৃহে জাতা যশোদা-গর্ভ-সম্ভবা” (১১/৪২) – আমি নন্দগোপ-গৃহে যশোদা গর্ভে আসবো – এই একবাক্যতা চমৎকার।
গীতায় শ্রীভগবান নিজের স্বরূপ বলেছেন, “অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ” (১২/২০)। চণ্ডীতে মেধা ঋষি মহাদেবীর তত্ত্ব বলেছেন, “যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে” (৫/১৭)
আত্মার স্বরূপ হলো চেতনা বা চৈতন্যস্বরূপতা। শ্রীভগবান বললেন, আমি আছি সর্বভূতে আত্মারূপে। ঋষি বললেন, মহাদেবী আছেন সর্বভূতে চেতনারূপে। ভিন্নতা কিছুই নেই।
গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “একাংশেন স্থিতো জগৎ” (১০/৪২)। এই বিশ্বজগৎ আমার একাংশে অবস্থিত।
চণ্ডীতে দেবতাগণ মায়ের স্তবে বলেছেন, “সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূতম্” (৪/৭)। তুমি সকলের আশ্রয়। এই সমস্ত জগৎ তোমার অংশভূত। উভয় একই কথা।
গীতা বলেছেন, প্রকৃতি ও পুরুষ দুই তত্ত্বর মিলনে সংসার সৃষ্টি। গীতা সমস্ত বিকার ও গুণকে প্রকৃতিসম্ভব বলেছেন-
“বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্” (১৩/২০)
দেহস্থ পুরুষকে বলেছেন ‘ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ’ (১৩/২৩)। দেবীমাহাত্ম্যে মহাদেবী আদ্যা পরমাপ্রকৃতি  ( পরমা প্রকৃতিরাদ্যা - ৪/৭ )কিন্তু এই পরমা প্রকৃতির মধ্যে পুরুষ এবং প্রকৃতি  উভয় সম্মিলিতা, কারণ মহাদেবী কেবল নিখিল বিকার ও গুণের মূল নন- তিনি চৈতন্যময়ী এবং মাহেশ্বরীও। মহাদেবী প্রকৃতি বলে ত্রিগুণময়ী, আবার পুরুষ বলে ত্রিগুণের দোষের দ্বারা লিপ্ত নন। এরূপ আশ্চর্যজনক তত্ত্ব বলে মহাদেবী হরিহরাদিরও অজ্ঞেয়া।
“হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
         র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।” ( ৪/৫ )
তুমি সমস্ত জগতের কারণ। তুমি ত্রিগুণা হয়েও দোষে লিপ্ত নও। হরিহর প্রভৃতিরও তুমি অজ্ঞেয়া।
গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন,
“যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
                তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্”।। ( ১০/৪১ )
-‘যেখানে যা কিছু শ্রীমৎ, ঊর্জিত ও বিভূতিযুক্ত, সকলই আমার অংশ বলে জানবে।’
চণ্ডীতে ভগবতী অসুরকে বললেন, “পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ”।। ( ১০/৫ ) – রে দুষ্ট! দেখ্ আমার বিভূতিসকল আমাতেই প্রবেশ করছে। এ বলে আকর্ষণ করলেন। অসুর দেখলো অগণিত মাতৃকামূর্তি দেবীর দেহে প্রবেশ করছে, আর প্রবেশ করে এক হয়ে যাচ্ছে। মা বললেন,
“অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রুপৈর্যদাস্থিতা।
                     তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব তিষ্ঠাম্যাজৌ স্থিরো ভব।।” (১০/৮)
-‘আমি ঐশ্বর্য দ্বারা এ যুদ্ধে বহুরূপে যে অবস্থান করছিলাম, তা উপসংহার করলাম। আমি এখন একাই আছি, একাই যুদ্ধ করবো, তুই স্থির হ।’ নিখিল বিভূতি যে এক বস্তুরই বহু প্রকাশ – গীতায় তা সুব্যক্ত, চণ্ডীতে বাস্তবায়িত।
বৈশেষিক দর্শনের ঋষি কণাদ ধর্মের লক্ষণ বলেছেন, “যতো বাহভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ” যা হতে অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স লাভ হয় তা-ই ধর্ম। অভ্যুদয় মানে সাংসারিক উন্নতি, যেমন- ধন, মান, যশ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি। নিঃশ্রেয়স মানে নিশ্চিত মঙ্গল।  প্রবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল অভ্যুদয়। নিবৃত্তি-লক্ষণ ধর্মের ফল নিঃশ্রেয়স। পূর্ণাঙ্গ বৈদিক ধর্মের চণ্ডীর লক্ষ্য নিবদ্ধ।
সুরথ ও সমাধির অর্চনায় মা পরিতুষ্টা হয়ে বললেন, বর চাও। রাজা চাইলেন অবিভ্রংশ রাজ্য। সমাধি চাইলেন তত্ত্বজ্ঞান। যে জ্ঞানের উদয় হলে, মিথ্যা আমি ও আমার নাশ প্রাপ্ত হয়, তা-ই চাইলেন সমাধি। রাজা চাইলেন অভ্যুদয়, বৈশ্য চাইলেন নিঃশ্রেয়স। গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, “যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।” ( ৪/১১ ) – ‘যে ব্যক্তি আমাকে যে ভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সে ভাবেই ভজনা করি।’ শ্রীচণ্ডীতে তা প্রকট করে দেখানো  হল। সুরথ রাজা ভজনা করেছেন রাজ্যসুখের জন্য, সমাধি বৈশ্য ভজনা করেছেন মুক্তিসুখের জন্য। ভগবতী উভয়কেই বাঞ্ছানুরূপ ফলদান করেছেন।
গীতা ও চণ্ডী উভয় গ্রন্থেই প্রবৃত্তি-ধর্ম বা ভোগের কথা এবং নিবৃত্তি-ধর্ম বা ত্যাগের কথা -যোগের কথা দৃষ্ট হয়। যেমন গীতায় ভগবান বলছেন, “হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।” (২/৩৭) –‘যুদ্ধে মৃত্যু হলে স্বর্গ, জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে’। এ কথা সম্পূর্ণ প্রবৃত্তি-মার্গের, ভোগের কথাই। “উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ” –‘যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উত্থিত হও।’ –এই ধুয়া ভগবান গীতায় আগাগোড়াই বজায় রেখেছেন। বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েও বলেছেন-
“তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভশ্ব
                      জিত্বা শত্রূন্ ভুঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্ ।” ( ১১/৩৩)
অতএব অর্জুন, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হও। শত্রু জয় করে নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ কর। ইহা ভোগমার্গেরই নির্দেশ, “যুধ্যস্ব জেতাসি” ( গীতা, ১১/৩৪ ) যুদ্ধ কর জয় হবে, এ কথা ত্যাগ-মার্গের নয়। তবে চণ্ডী ও গীতাতে পার্থক্য এই,- চন্ডীতে ভোগ যোগ দু’টি পৃথক বস্তুভোগের জন্য ভোগ, ত্যাগের জন্য যোগ। ভোগ চাও ত এক পথ, ত্যাগ চাও ত আলাদা পথ। গীতায় ভোগ যোগ আলাদা নয়। গীতায় ভোগের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু ত্যাগের ভূমিকায়। সর্বতোভাবে ত্যাগের ভূমিতে দাঁড়িয়ে ভোগ করো। গীতার দৃষ্টি নিবৃত্তির দিকে; মূল কথা তার ত্যাগ, কিন্তু নিবৃত্তির সঙ্গে প্রবৃত্তির, ত্যাগের সঙ্গে ভোগের কোন বিরোধিতা দেখতে পাওয়া যায় না। গীতায় ভোগ ত্যাগের কুক্ষিগত। ভোগ করো ভোগস্পৃহা-শূন্য হয়ে, কর্ম করো কর্মফল ত্যাগ করে, যুদ্ধ করো আমাকে স্মরণ করে। “মামনুস্মর যুধ্য চ” ( ৮/৭ )কর্ম করো কর্তৃত্বাভিমান ছেড়ে –শত্রু জয় করো নিমিত্তমাত্র হয়ে। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করো শত্রুতাভাব না রেখে, ‘নির্বৈর’ হয়ে। গীতায় প্রেরণা আছে কর্ম করাতে- কিন্তু সেই করা-ক্রিয়ার কর্তা আছে, কর্তৃত্বাভিমান নেই- কর্ম আছে কর্মফলাকাঙ্ক্ষা নেই। এই কর্তৃকর্মহীন স্তব্ধ ক্রিয়ার মধ্যে জ্ঞান -কর্মের সমন্বয়, ভোগ যোগের সমন্বয়, প্রবৃত্তি নিবৃত্তির একাত্মতা। ভোগের প্রতীক ধনুর্ধর পার্থ। ত্যাগের প্রতীক যোগেশ্বর কৃষ্ণ। গীতা ধনুর্ধারীর রথে যোগেশ্বরকে সারথি করে এ কথা জানিয়েছেন যে- পূর্ণজ্ঞানী হয়ে, কর্মের অতীত হয়ে অপর্যাপ্ত কর্ম করো। ভোগাতীত হয়ে ভোগের মধ্যে বাস করো। যোগেশ্বরকে জীবন-রথে সারথি করে কর্মের ধনু ধারণ করো। সবশেষে সঞ্জয়ের মুখেও তা-ই শুনি-
“যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ
          তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম”।। (১৮/৭৮)
-‘যে পক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং গাণ্ডীবধারী অর্জুন সেই পক্ষে  রাজ্যশ্রী, বিজয়, অভ্যুদয় ও অব্যভিচারিণী নীতি বিরাজ করে, ইহা আমার নিশ্চিত অভিমত।’
সুতরাং গীতা ও চণ্ডীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, চণ্ডী দু’ হাত বাড়িয়ে এক হাতে ভোগ ও অপর হাতে যোগ দিচ্ছেন, আর গীতা দু’ হাতে একত্রে দু’টিই বিতরণ করছেন।
চণ্ডী পাঠের পূর্বে অর্গলা স্তোত্র পাঠ করা আবশ্যিক। এ স্তোত্রের “রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি” মন্ত্রের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি  হেতু অনেকে মনে করেন- চণ্ডীতে কেবল দেহি দেহি রব, কেবল ভোগ আর ভোগের জন্যই প্রার্থনা। এ প্রার্থনায় দ্বিবিধ তাৎপর্য নিহিত আছে। যিনি ভোগাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে এক প্রকার অর্থ, যিনি মোক্ষাকাঙ্ক্ষী, তাঁর কাছে অন্য প্রকার অর্থ। যিনি ভোগী তিনি দেহের রূপ কামনা করেন, যিনি ত্যাগী তিনি আত্মার স্বরূপ জ্ঞান জাগিয়ে তুলবার প্রার্থনা করেন। ভোগী লৌকিক যুদ্ধে, মামলা মোকদ্দমায় জয় কামনা করেন, ত্যাগী সাধন-সমরে জয় আকাঙ্ক্ষা করেন। ভোগী চান লৌকিক নাম যশ খ্যাতি, তাই বলেন যশো দেহি। সাধক চান ভগবদ্ভক্ত বলে জগতে কীর্তিত হতে। ভোগার্থী বাঞ্ছা করেন লৌকিক শত্রুর ধ্বংস; তাই বলেন, “দ্বিষো জহি”ত্যাগী – যোগী চান, সাধন-পথে যে সকল বাধক রয়েছে; সেই কামাদি শত্রুর অবলুপ্তি। ভোগী যেখানে পাঠ করেন-
“ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্” ‘( হে দেবি, ) আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী ( অনুকূল আচরণকারিণী ) মনোরমা ভার্যা ( ভরণীয়া বা স্ত্রী বা ভক্তি ) দাও।’ এক্ষেত্রে ভোগী ভার্যা অর্থে ভরণীয়া বা স্ত্রী গ্রহণ করে প্রার্থনা করেন ,কিন্তু সাধকগণ চিরদিন সেখানে ভার্যা অর্থে ভক্তি ধরেই পাঠ করে থাকেন।
এ ছাড়া মায়ের কাছে কেউ অবনত হয়ে কিছু কামনা করলেই মা তা দেন না। যে বস্তু দিলে একজনের উপকার কিন্তু অন্যের ক্ষতি তা দেন না। যাতে জগতের সকলের উপকার তা-ই মা দেন। তাই তো দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে জগজ্জননী বললেন-
“বরদাহং সুরগণা বরং যং মনসেচ্ছথ।
                     তং বৃণুধ্বং প্রযচ্ছামি জগতামুপকারকম্”।। ( ১১/৩৭ )
‘হে দেবগণ, আমি বরদাত্রী, তোমরা মনে মনে জগতের হিতকর যে ইচ্ছা করছো তা প্রার্থনা করো, এখনই দিচ্ছি।’ নিষ্কাম ব্যক্তি নিষ্ক্রয় নয়, সে সর্বদা কর্ম করে “সর্বভূতহিতে রতাঃ” ( গীতা, ১২/৪ ) হয়ে। সুতরাং মা যে জগতের মঙ্গলময় বর দিবেন, তা নিষ্কাম ভক্তেরও কাম্যদেবতাগণও বলেছেন-
“ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।” ( ১১/৩৫)
‘হে স্তবনীয়ে দেবি। ত্রিভুবনবাসী জনগণের জন্য বরদাত্রী হও।’
কেউ কেউ মনে করেন, গীতা ভক্তির কথায় পূর্ণ আর চণ্ডীতে ভক্তির গন্ধও নেই। এরূপ মনে করা ঠিক নয়। গীতা শুধু ভক্তির কথায় পূর্ণ নয় –কর্ম, যোগ, জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় গ্রন্থ গীতা। চণ্ডী গ্রন্থও ভক্তিশূন্য নয়। যে অর্গলা-স্তবে “রূপং দেহি জয়ং দেহি” প্রার্থনা পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হয়েছে সেই স্তবেই আছে-
“দেবি ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দোদয়েহম্বিকে” (২৪)
হে দেবি অম্বিকে, তুমি ভক্তদেরকে অনর্গল আনন্দ দান করে থাকো। ভক্তদেরকে যে কত আনন্দ দান করেন তার প্রমাণ চতুর্থ অধ্যায়ে দেবগণের স্তুতিকালে দৃষ্ট হয়স্তবপরায়ণ দেবগণের বর্ণনায় ঋষি বলেছেন- “প্রণতি-নম্রশিরোধরাংসাঃ” “প্রহর্ষপুলকোদ্গম-চারুদেহাঃ” ( ৪/২ ) তাঁরা গ্রীবা ও স্কন্ধ নত করে প্রণাম করে আনন্দে রোমাঞ্চ উদ্গত হওয়ায় সুন্দর দেহশালী হয়ে মহাদেবীকে স্তব করে ছিলেন। আনন্দ গভীর না হলে পুলক হয় না।
চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবের শেষে বলেছেন-
“যা চ স্মৃতা তৎক্ষণমেব হন্তি নঃ
              সর্বাপদো ভক্তিবিনম্রমূর্তিভিঃ”।। ( /৮২ )
‘আমরা ভক্তিনম্র হয়ে স্মরণ করলে জগন্মাতা তৎক্ষণাৎ আমাদের সকল বিপদ নষ্ট করে থাকেন।’ সবশেষে চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের স্তবে দেবগণ বলেছেন- হে দেবি, মা যেমন পুত্রদের রক্ষা করেন, সেরূপ আমাদেরকে পাপ থেকে রক্ষা করো।
“পাপেভ্যো নঃ সুতানিব” ( ১১/২৭ )
এ প্রার্থনার মধ্যে প্রীতিপূর্ণ আর্তি বিদ্যমান। পরেই বলেছেন, তোমার যারা আশ্রিত, তাদের আর বিপদ নেই।
“ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নাণাং” ( ১১/২৯ )
হৃদয়ে ভক্তি না থাকলে- আশ্রিত, শরণাগত, মুখের কথায় হয় না। তারপর একটি আশ্চর্য সংবাদ বলেছেন-
“ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি” ( ১১/২৯ )
তোমাকে যারা আশ্রয় করে, তারা সকলের আশ্রয় হয়ে থাকে। সকলের বলতে নিখিল বিশ্বের সকলের। আর এক মন্ত্রে তা স্পষ্টতর করেছেন-
“বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ” ( ১১/৩৩)
যারা তোমার কাছে ভক্তিভরে বিনম্র, তারা বিশ্বের আশ্রয় হয়ে থাকে। কতখানি ভক্তিপূর্ণ চিত্তে মাতৃচরণ আশ্রয় করলে সে নিখিল বিশ্বের আশ্রয়স্থল হতে পারে তা বিশেষভাবে অনুধাবনীয়। চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের স্তবটিতে পুনঃ পুনঃ “নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”
শত শতবার নমস্কার। গীতায় ভগবান অর্জুনকে বলেছেন,
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।” ( ৯/৩৪)
মন্মনা, মদ্ভক্ত হয়েই পুনঃ পুনঃ নমস্কার করতে বলেছেন।
ভাগবতীয় শাস্ত্রে শ্রীভগবানের গুণাবলির মধ্যে ‘হতারিগতিদায়কত্ব’ একটি প্রধান গুণ। যে শত্রুকে তিনি নাশ করেন তারও সদ্গতি দান করেনপূতনা-মোক্ষ লীলায় শাস্ত্রকার বলেছেন,
“জিঘাংসয়াপি হরয়ে স্তনং দত্ত্বাপ সদ্গতিম্।” ( ভাগবত, ১০/৬/৩৫ )
জিঘাংসাবৃত্তি নিয়ে এসেও পূতনা সদ্গতি পেল। চণ্ডী গ্রন্থে মহিষাসুরের যুদ্ধের প্রসঙ্গে, স্তবে দেবগণ বলেছেন, মহিষাসুর বধকালে তোমার বাইরে নিষ্ঠুরতা থাকলেও “চিত্তে-কৃপা” ছিল। তোমার ভয়ঙ্কর শস্ত্রপ্রভাসমূহের ঝকমকানিতে অসুরদের দৃষ্টি যে নষ্ট হয় নি, তার কারণ তোমার অর্ধ-চন্দ্রযুক্ত বদনখানি তারা দেখতে পেয়েছিল
( ৪/২০ )। তোমার শস্ত্রদ্বারা পবিত্র হয়ে তারা উৎকৃষ্ট লোকে গমন করুক, এরূপ মতি নিয়েই তুমি তাদেরকে অস্ত্রাঘাত করেছো। না হলে তো শুধু দৃষ্টি দ্বারাই তাদেরকে ভষ্মীভূত করতে পারতে।
“দৃষ্ট্বৈব কিং ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম
সর্বাসুরানরিষু যৎ প্রহিণোষি শস্ত্রম্।
    লোকান্ প্রয়ান্তু রিপবোহপি হি শস্ত্রপূতাঃ
                ইত্থং মতির্ভবতি তেষ্বপি তেহতিসাধ্বী”।। ( /১৯ )
করুণাময়ী মহাদেবীও যে হতারিগতিদায়িকা তা এই মন্ত্রে সুব্যক্ত হয়েছে।
গ্রন্থ শেষে উভয় গ্রন্থের ফলশ্রুতিও অনুরূপ। গীতার বক্তা বলেছেন-
“অধ্যেষ্যতে চ য ইমং ধর্মং সংবাদমাবয়োঃ
             জ্ঞানযজ্ঞেন তেনাহমিষ্টঃ স্যামিতি মে মতিঃ”।। ( ১৮/৭০ )
যিনি আমাদের এই ধর্মসংবাদ  গীতাশাস্ত্র অধ্যয়ন করবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞ দ্বারা আমার অর্চনা করবেন। আরও বলেছেন-
“শ্রদ্ধাবাননসূয়শ্চ শৃণুয়াদপি যো নরঃ
                           সোহপি মুক্তঃ শুভাল্লোঁকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পুণ্যকর্মণাম্”।। ( ১৮/৭১ )
যিনি শ্রদ্ধাবান্ ও অসূয়াশূন্য হয়ে গীতা শ্রবণ করেন তিনি পাপ থেকে বিমুক্ত হয়ে পুণ্যবানের প্রাপ্য শুভ লোক প্রাপ্ত হন। দেবী মাহাত্ম্যেও  মহাদেবী বলেছেন-
“শ্রোষ্যন্তি চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্। ( ৪/১২ )
     ন তেষাং দুষ্কৃতৎ কিঞ্চিদ্ দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ”( /১২)
যে আমার উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য ভক্তিসহকারে পাঠ করবে, তার কোন পাপ, বা পাপজনিত বিপদ হবে না। আরও বলেছেন-
“তস্মান্মমৈতন্মাহাত্মং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ
                 শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ”।। ( ১২/৭ )
সে জন্য, আমার এই মাহাত্ম্য একাগ্রচিত্ত হয়ে ভক্তিসহকারে সকলের পাঠ ও শ্রবণ করা উচিত। তা-ই উৎকৃষ্ট স্বস্ত্যয়ন। আরও অনেক ফলের কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা-
‘সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্’( ১২/২০ )
আমার মাহাত্ম্য আমার সন্নিধিকারক। পুরাণে শ্রীভগবানও বলেছেন-
‘মদ্ভক্তো যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।’
গীতা শ্রবণে অর্জুনের মোহ নষ্ট হল- স্মৃতি ফিরে এলো, চিত্ত স্থির হল, সকলের সংশয় কেটে গেল। গীতা শ্রবণ করতে করতে “সুদুর্দর্শ বিশ্বরূপ” দর্শন হল। দেবী মাহাত্ম্য চণ্ডীতে ঋষিবর চণ্ডীগ্রন্থ শুনিয়ে শ্রোতা সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যকে দেবীর চরণে শরণাগতি গ্রহণ করতে বললেন।
“তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্।
                 আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা” ।। ( ১৩/৫ )
‘সেই পরমেশ্বরীর শরণাগত হও। তাঁকে আরাধনা করলে তিনি মানুষকে ভোগ, স্বর্গ ও অপবর্গ ( মোক্ষ বা মুক্তি ) প্রদান করে থাকেন।’ ঋষি তাঁদেরকে আরাধনায় নিযুক্ত করেছিলেন। আরাধনার ফলে তাঁরা দেবীর সাক্ষাৎকার ও বাঞ্ছানুরূপ ফল লাভ করলেন।
এ আলোচনায় দেখা গেল মূলত: একই  মহাসত্য সর্বত্র ঘোষিত এবং এ আলোচনা থেকে বলা যায় যে, তন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক সত্যের দর্শনই চণ্ডী।     ( চলবে----------- )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন