৩
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
ও দেবী-মাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীর বিভিন্ন শ্লোকের মধ্যে ভাব ও ভাষাগত আশ্চর্য মিল
পরিলক্ষিত হয় । দৃষ্টান্তস্বরূপ কতিপয় শ্লোক উল্লেখ করা হলোঃ-
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষ্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি
প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।। গীতা, ২/৬০
-‘হে
কুন্তীপুত্র, বিক্ষেপকারী ইন্দ্রিয়গণ অতি যত্নশীল মেধাবী ( শাস্ত্রজ্ঞ ) পুরুষের
মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে’।
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাদাকৃষ্য মোহায়
মহামায়া প্রযচ্ছতি।। চণ্ডী, ১/৫৫-৫৬
-‘বিবেকিগণেরও
কি কথা? দেবী ভগবতী মহামায়া বিবেকিগণেরও চিত্তসমূহ বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত
করেন’।
অর্জুন উবাচ
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষেয়
বলাদিব নিয়োজিতঃ।। গীতা, ৩/৩৬
-‘অর্জুন
জিজ্ঞাসা করলেন, হে কৃষ্ণ, মানুষ কার
দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপানুচরণে প্রবৃত্ত
হয়?’
রাজোবাচ
তৎ কেনৈতন্মহাভাগ
যন্মোহ জ্ঞানিনোরপি।
মমাস্য চ ভবত্যেষা
বিবেকান্ধস্য মূঢ়তা।। চণ্ডী, ১/৩৯,৪৪-৪৫
-‘রাজা
সুরথ মেধা মুনিকে বললেন- হে মহামতি, রূপরসাদি বিষয় দোষযুক্ত- তা ইনি ও আমি জানি।
তথাপি আমাদের এই মোহ কি হেতু হচ্ছে? এরূপ মূঢ়তা বিবেকহীন ব্যক্তিরই হয়ে থাকে’।
যদা যদাহি
ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যূত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং
সৃজাম্যহম্।। গীতা, ৪/৭
-‘হে
ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যূদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও
অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি স্বীয় মায়া বলে দেহবান্ হই, যেন জাত হই’।
ইত্থং যদা যদা
বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি ।।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্ ।।
চণ্ডী, ১১/৫৪-৫৫
-‘এ প্রকারে
যখনই দানবগণের প্রাদুর্ভাববশতঃ বিঘ্ন উপস্থিত হবে তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে
দেব-শত্রু অসুরগণকে বিনাশ করবো’।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।। গীতা, ৪/৮
-‘সাধুদের
রক্ষার জন্য, দুষ্টদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে
নরাদিরূপে অবতীর্ণ হই’।
দৈত্যানাং
দেহনাশায় ভক্তানামভয়ায় চ।।
ধারয়ন্ত্যায়ুধানীত্থং দেবানাঞ্চ হিতায় বৈ।
চণ্ডী, দেবীকবচ-১৬
-‘বহু
দিব্য অস্ত্র দৈত্যগণের দেহ নাশের জন্য, ভক্তগণকে অভয়দানের জন্য এবং দেবতাগণের
হিতের জন্য ধরণ করেন’।
মত্তঃ পরতরং
নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়।
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।
গীতা, ৭/৭
-‘হে
ধনঞ্জয়, আমা অপেক্ষা জগতের অন্য শ্রেষ্ঠ কারণ নেই। যেমন সূত্রে মণিসমূহ গ্রথিত হয়ে
থাকে, সেরূপ এই পরিদৃশ্যমান জগৎ আত্মভূত আমাতে অনুস্যূত ও বিধৃত রয়েছে’।
একৈবাহং
জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো
মদ্ বিভূতয়ঃ।। চণ্ডী, ১০/৫
-‘একা মাত্র আমিই এই জগতে বিরাজিতা।
মদ্ব্যতিরিক্ত আমার সহায়ভূতা অন্যা দ্বিতীয়া আর কে আছে? রে দুষ্ট, ব্রহ্মাণীপ্রমুখ
এসকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি ( শক্তি ) । এই দেখ এরা আমাতেই বিলীনা হচ্ছে’।
দৈবী হ্যেষা
গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং
তরন্তি তে।। গীতা, ৭/১৪
-‘কারণ
আমার এই ত্রিগুণাত্মিকা অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া অতিক্রম করা অতিশয় কষ্টকর। কিন্তু
যাঁরা ধর্মাধর্ম পরিত্যাগপূর্বক আমাকে আশ্রয় করেন এবং অন্য প্রকার সাধনের উপর
নির্ভর করেন না, তাঁরাই কেবল আমার এই দুস্তর মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন, অর্থাৎ
সংসার-বন্ধন হতে মুক্ত হন’।
তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।
মহামায়াপ্রভাবেণ
সংসারস্থিতিকারিণা।। চণ্ডী, ১/৫৩
-‘তথাপি
সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে জীবগণ মোহরূপ গর্তে মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত
হয়’।
নান্তোহস্তি মম
দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ।
এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো
বিভুতের্বিস্তরো ময়া।। গীতা, ১০/৪০
‘হে
অর্জুন, আমার দিব্য বিভূতির অন্ত নেই ; আমি সংক্ষেপে এই সকল বিভূতির বর্ণনা
করলাম’।
দেব্যুবাচ।
অহং বিভূত্যা
বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।
তৎ সংহৃতং ময়ৈকৈব তিষ্ঠাম্যাজৌ
স্থিরো ভব।। চণ্ডী, ১০/৭-৮
‘দেবী
বললেন- এই যুদ্ধে স্বীয় শক্তি প্রভাবে ( মায়া দ্বারা ) আমি যে সকল মূর্তিতে
অবস্থান করছিলাম সে-সকল এক্ষণে উপসংহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে একাকিনীই রইলাম। তুমি
যুদ্ধে স্থির হও’।
যদ্ যদ্
বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম
তেজোহংশসম্ভবম্।। গীতা, ১০/৪১
‘যা
যা ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা উৎসাহশালী সে সকলই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলে
জানবে’।
পশ্যৈতা দুষ্ট
ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্ বিভূতয়ঃ ।। চণ্ডী, ১০/৫
-‘রে
দুষ্ট, ব্রহ্মাণীপ্রমুখ এসকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি ( শক্তি ) । এই দেখ এরা
আমাতেই বিলীনা হচ্ছে’।
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং
কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ।। গীতা, ১০/৪২
অথবা
হে অর্জুন, আমার বিভূতির এত অধিক জানবার
তোমার প্রয়োজন কি? এইমাত্র জেনে রাখো যে, আমিই এক পাদমাত্র ( আমার একাংশ ) দ্বারা
সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত করে রয়েছি’।
হেতুঃ
সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।
সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূত-
মব্যাকৃতা হি পরমা
প্রকৃতিস্ত্বমাদ্যা ।। চণ্ডী, ৪/৭
-‘আপনি
সমগ্র জগতের মূল কারণ। আপনি সত্ত্বাদি গুণময়ী হলেও রাগদ্বেষাদি দোষযুক্ত ব্যক্তি
আপনাকে জানতে পারে না। আপনি শিবাদি দেবগণেরও অজ্ঞাত। ব্রহ্মা হতে কীট পর্যন্ত এই
অখিল বিশ্ব আপনার অংশভূত। কারণ, আপনিই সকলের আশ্রয় স্বরূপা। আপনি ষড়্ বিকার রহিতা
পরমা আদ্যা প্রকৃতি’।
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং
সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ।। গীতা, ১৮/৬৬
-‘সকল
ধর্মাধর্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্বক গর্ভ, জন্ম, জরা ও মৃত্যুবর্জিত পরমেশ্বররূপ
একমাত্র আমার শরণাগত হও। আমা হতে অতিরিক্ত কোন বস্তুই নেই, এরূপ দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে
আমাকে সদা স্মরণ করো। তুমি এরূপ নিশ্চিতবুদ্ধিযুক্ত ও স্মরণশীল হলে তোমার নিকট আমি
স্বাত্মভাব প্রকটিত করে সকল ধর্মাধর্ম বন্ধনরূপ পাপ হতে তোমাকে মুক্ত করবো। অতএব,
শোক করো না’।
তামুপৈহি মহারাজ
শরণং পরমেশ্বরীম্ ।।
আরাধিতা সৈব নৃণাং
ভোগস্বর্গাপবর্গদা ।। চণ্ডী, ১৩/৪-৫
-‘হে
মহারাজ, সেই পরমেশ্বরীরই শরণাগত হও। তাঁকে ভক্তিপূর্বক আরাধনা করলে তিনিই ইহলোকে
অভ্যূদয় এবং পরলোকে স্বর্গসুখ ও মুক্তিপ্রদান করবেন’।
য ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি।
ভক্তিং ময়ি
পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ ।। গীতা, ১৮/৬৮
-‘এই
গীতা পাঠ ও ব্যাখ্যা দ্বারা আমি ভগবানের শুশ্রূষা করছি- এই জ্ঞানে যিনি এই পরম
গুহ্য গীতাশাস্ত্র আমার ভক্তের নিকট পাঠ ও ব্যাখ্যা করবেন, তিনি পরা ভক্তি লাভ করে
আমাকে প্রাপ্ত হবেনই, এতে সন্দেহ নেই’।
তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং
পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।
শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং
স্বস্ত্যয়নং হি তৎ ।। চণ্ডী, ১২/৭
-‘অতএব
আমার এই মাহাত্ম্য সমাহিতচিত্তে নিত্য ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করা কর্তব্য। কারণ
তা অতিশয় মঙ্গলজনক’।
গীতার প্রশস্তিতে বলা হয়েছে :
গীতা
সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মবিনিঃসৃতা ।।
-‘যে
গীতা সাক্ষাৎ ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্ম হতে নিঃসৃতা, তা উত্তমরূপে পাঠ করা
কর্তব্য ; অন্যান্য অধিক শাস্ত্রপাঠের
প্রয়োজন কি?’
শ্রীশ্রীচণ্ডীর
মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে :
যথাশ্বমেধঃ ক্রতুষু দেবানাং চ যথা হরিঃ।
স্তবানামপি সর্বেষাং তথা
সপ্তশতীস্তবঃ ।। -বারাহীতন্ত্র
-‘যেমন
অশ্বমেধ সকল যজ্ঞের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যেমন হরি দেবতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ
স্তবসমূহের মধ্যে সপ্তশতী স্তব ( চণ্ডী ) শ্রেষ্ঠ’ ।
ভারতীয়
সংস্কৃতির সমগ্ররূপ দর্শন ও অনুধাবন করতে হলে বৈদিক ও তান্ত্রিক দু’টি ধারা
সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ অবগত হতে হয়। কেননা, সুপ্রাচীন
কাল থেকেই বেদের দার্শনিক সিদ্ধান্তসমূহ তন্ত্রের পূজাদি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত
হয়ে একে অন্যের অভাব পূরণ করছে। কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে যজ্ঞ ও পূজা উভয়ই
অপরিহার্য। যজ্ঞ বেদের দান আর পূজা তন্ত্রের। বেদ ও তন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক। তাই
তো ভারতীয় সংস্কৃতির আধ্যাত্মিকরূপ উপলব্ধি করতে হলে দু’টি ধারার পূর্ণতা প্রাপ্ত
দু’টি গ্রন্থ ; গীতা ও চণ্ডী অধ্যয়ন অপরিহার্য। দু’টি গ্রন্থই একে অপরের পরিপূরক।
সহায়কগ্রন্থ
:-
১।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯৩
২।
শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯২
৩।
সপ্তশতী-সমন্বিত চণ্ডীচিন্তা, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, শ্রীমহানামব্রত কালচার্যাল
এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কলিকাতা, ১৪০১ বাংলা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন