২
গীতার
কতিপয় বিশিষ্ট ভাব বা উপদেশ, যা চণ্ডীতে মূর্ত হয়ে সুবিকশিত হয়েছে, তা গীতার
অধ্যায়ক্রমে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।
গীতার
প্রথম অধ্যায়ে- অর্জুনের বিষাদযোগ। গীতার বিষাদযোগ, চণ্ডীতে তা
অতিবিষাদ যোগরূপে পরিস্ফুট। তাই রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্যকে ঋষি “অত্যন্ত-দুঃখিতৌ” (
১/৪৩ ) বলেছেন।
গীতার
দ্বিতীয় অধ্যায়ে- সাংখ্যযোগ। এখানে গুরুত্বে বরণ ও সাংখ্যযোগ শ্রবণ। ত্রিতাপ তাপিত
ভক্ত অর্জুন দুঃখিত ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে জগৎ গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন। তাঁর
ভাষায়, “শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্” (
গীতা, ২/৭ ) – ‘আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাগত, আমায় শিক্ষা দাও।’ তখন
ভগবান, শিষ্য অর্জুনকে প্রথমে আত্ম-জ্ঞানের উপদেশ প্রদান করেছিলেন। চণ্ডীতেও তীব্র
বৈরাগ্যযুক্ত অতি দুঃখিত ( ১/৪৩ ) রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, মেধস মুনির
আশ্রমে গিয়ে শরণাগত হলে জ্ঞান গুরু ঋষি প্রথমে ভক্ত শিষ্যের জ্ঞানের অভিমান চূর্ণ
করলেন। তারপর ক্রমান্বয়ে শক্তিময় এবং কর্মময় জগৎ রহস্য উদ্ঘাটিত করে মহামায়া
সম্বন্ধে বিশেষ তত্ত্ব জ্ঞানের উপদেশ প্রদান করেছিলেন। গীতায় সাংখ্যযোগ দ্বারা
আত্মস্বরূপ লাভের যেসব কৌশল ব্যক্ত করা হয়েছে, চণ্ডীতে তা ব্যাপকভাবে বিবিধ উদাহরণের
মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। দেহের অনিত্যতা এবং আত্মার নিত্যতা, চণ্ডীতে শুধু
উপদেশে নয়, এখানে ভগবান ও ভগবতী যুদ্ধচ্ছলে স্বয়ং অনিত্য দেহ আর অবিশুদ্ধ আসুরিক
ভাব নাশ করে সর্বত্র সত্যময় আত্মভাবের
বিকাশ দেখিয়েছেন এবং সাধককে আত্মরাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। গীতার -
“যা নিশা
সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা
পশ্যতো মুনেঃ”।। ( ২/৬৯ )
- অর্থাৎ ‘সর্বভূতের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ (
অজ্ঞাত ), সেই ব্রহ্মে স্থিতপ্রজ্ঞ জাগ্রত থাকেন ( সর্বদা ব্রহ্মদর্শন করেন )। আর,
যে অজ্ঞানরূপ রাত্রিতে ভূতগণ জাগ্রত থাকে ( সংসার দর্শন করে ) স্থিতপ্রজ্ঞের পক্ষে
তা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ তিনি সংসার অনুভব করেন না।’ এই শ্লোকটি চণ্ডীতে
“দিবান্ধাঃ
প্রাণিনঃ কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে।
কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ
প্রাণিনস্তুল্যদৃষ্টয়ঃ”।। (
১/৪৮-৪৯ )
অর্থাৎ
‘পেচকাদি কোন কোন প্রাণী দিনে দৃষ্টিশক্তিহীন; কাক প্রভৃতি অন্যান্য প্রাণী আবার
রাতে অন্ধ। কেঁচো প্রভৃতি কোন কোন প্রাণী দিন ও রাতে দৃষ্টিশক্তিহীন এবং বিড়াল ও
রাক্ষসাদি কোন কোন প্রাণী দিন ও রাতে সমান দৃষ্টিসম্পন্ন।’ এই শ্লোকে আরও ব্যাপকভাবে
অভিব্যক্ত হয়েছে। গীতার এই অধ্যায়ে-
“ধ্যায়তো
বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ
স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো
বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।” ( ২/৬২-৬৩ )
অর্থাৎ ‘ বিষয়সমূহ চিন্তা করতে করতে তাতে
মানুষের আসক্তি জন্মে, আসক্তি থেকে কামনা ( তৃষ্ণা ) হয়, কামনা প্রতিহত হয়ে ক্রোধে
পরিণত হয়, ক্রোধ হতে কর্তব্যাকর্তব্যরূপ বিবেকনাশ এবং বিবেকনাশ হতে শাস্ত্র ও
গুরুর উপদেশজনিত সংস্কারের স্মৃতিবিলোপ, স্মৃতিবিভ্রম থেকে পুরুষের ভাল-মন্দ
বিচারবুদ্ধি বিনষ্ট হয় আর বিচারবুদ্ধি বিনষ্ট হলে মানুষ পুরুষার্থের অযোগ্য হয়।’- প্রভৃতি উক্তিতে ভগবান ক্রোধ সম্বন্ধে ক্রমবিকাশ
দেখিয়ে শেষে “বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি” ( ২ /৬৩ ) বলে
যা নির্দেশ করেছেন, চণ্ডীতে এর রহস্য নিশুম্ভ বধ- লীলাতে সুন্দররূপে পরিস্ফুট
হয়েছে।
গীতার
তৃতীয় অধ্যায়ে- কর্মযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন-
“কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা
স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্
বিমুঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে”।। (
গীতা, ৩/৬ )
অর্থাৎ ‘যে মূঢ় ব্যক্তি হস্ত, পদ ও বাক্যাদি
পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় সংযত করে মনে মনে শব্দরসাদি ইন্দ্রিয়বিষয় স্মরণপূর্বক অবস্থান
করে, তাকে মিথ্যাচারী বলে।’ এই বাণীটি সুরথ ও সমাধি চরিত্রের প্রথমাংশের
অভিব্যক্তি। কেন না, তাঁরা তীব্র বৈরাগ্যযুক্ত হয়ে উভয়ে ঋষির প্রশান্তিময় আশ্রমে
বাস করা সত্ত্বেও তাঁদের চিত্তে বিষয়চিন্তা প্রবল হয়েছিল।
কর্মযজ্ঞ
সম্বন্ধে গীতার উক্তি,
“দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ” ।।( ৩/১১ )
– অর্থাৎ ‘এই যজ্ঞ দ্বারা তোমরা ইন্দ্রাদি
দেবতাগণকে সংবর্ধনা করো এবং দেবতাগণও তোমাদের বৃষ্ট্যাদি দ্বারা শস্যাদি
উৎপাদনপূর্বক অনুগৃহীত করুন। এরূপে পরস্পরের ভাবনা দ্বারা তোমরা পরম মঙ্গল লাভ
করবে।’ কিন্তু চণ্ডীতে দেবগণের অধিকার ভোগ
সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
গীতা
বলেন, “প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ। অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা
কর্তাহমিতি মন্যতে” ।। ( ৩/২৭ ) অর্থাৎ “প্রকৃতির গুণত্রয় শরীরেন্দ্রিয়াদিসংঘাতে পরিণত
হয়ে লৌকিক ও বৈদিক সমস্ত কর্ম সম্পাদন করে। অহংকার দ্বারা যাঁর চিত্ত বিমূঢ় হয়েছে,
তিনি ‘আমি কর্তা’ এরূপ মনে করেন।” – এই অহং এর কর্তৃত্ব বা অহমিকা বিনাশ
করে আত্ম স্বরূপে উদ্বুদ্ধ করাই চণ্ডীর অন্যতম সাধনা। বিশেষত গীতার উক্ত শ্লোকটি
রাজা সুরথের প্রাথমিক চিন্তা রাশিতে সুন্দররূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। আর ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি
যে সকল কাজ করেন, তা চণ্ডীতে সবিস্তারে উদাহরণসহ আলোচিত হয়েছে। এই অধ্যায়ের
শেষভাগে ( ৩/৩৯ ) ‘কামের দূষ্পূরণীয়তা’ আলোচনাপূর্বক সেই দুর্ধর্ষ শত্রুকে
বধ করার জন্য ভগবান, ভক্ত অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, চণ্ডীতে তা শুম্ভ-চরিত্রে
বিভিন্ন ও বিচিত্র অবস্থার মধ্য দিয়ে সুন্দররূপে মূর্ত বা পরিস্ফুট হয়েছে।
গীতার
চতুর্থ অধ্যায়ে- জ্ঞানযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা
ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং
স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া” ।। ( ৪/৬ )
-‘আমি জন্মরহিত, অলুপ্তজ্ঞানশক্তি-স্বভাব এবং
ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্যন্ত সর্বভূতের ঈশ্বর হয়েও সমস্ত জগৎ যার বশীভূত আমার সেই
ত্রিগুণাত্মিকা শক্তিকে আশ্রয় করে স্বীয় মায়া দ্বারা যেন দেহ ধারণ করি।’ এ উক্তির
সত্যময় উদাহরণ ‘চণ্ডী’। কেননা, ভগবান ও ভগবতীর বিচিত্র অবস্থাযুক্ত তিনটি আবির্ভাব
লীলা এ-তে সবিস্তারে বর্ণিত।
গীতার
অভয় বাণী-“যে যথামাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্” ( ৪/১১ )
‘যাঁরা আমাকে যে প্রকারে বা যে উদ্দেশ্যে উপাসনা করেন, আমি তাঁদের সেভাবেই বা সেই
ফলপ্রদানের দ্বারাই অনুগ্রহ করি’- চণ্ডীতে তা উদাহরণসহযোগে মূর্ত হয়েছে। যা শরণাগত
ভক্ত সাধকগণকে সর্ববিধ অনাত্মভাব থেকে রক্ষা করে এবং চতুর্বর্গ প্রদানে ধন্য করছে।
গীতার ব্রহ্মজ্ঞানময় উক্তি, “ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ
ব্রহ্মণা হুতম্।” ( ৪/২৪ ) –‘অর্পণ ( যজ্ঞপাত্র ) ব্রহ্ম, ঘৃত
ব্রহ্ম, হোমকর্তা ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম’ প্রভৃতি বাণী দ্বারা সর্বভূতে এবং
সর্বভাবে ভগবৎ বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। চণ্ডীতে- “নিত্যৈব
সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্” ( ১/৬৪ ) - ‘তিনি ( মহামায়া ) নিত্যা ( সনাতনী, জন্মমৃত্যুরহিতা
); এই জগৎ প্রপঞ্চই তাঁর বিরাট মূর্তি।’ প্রভৃতি উক্তি দ্বারা গীতার ঐসকল
ব্রহ্মজ্ঞানময় ভাবকে ভক্তিরসে অভিসিক্ত করে সরস, মধুময় ও আনন্দময় করা হয়েছে।
গীতাতে শ্রীভগবান বলছেন,
“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন
সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি
তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।। ( ৪/৩৪ )
অর্থাৎ
‘যে বিধি দ্বারা সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা বলছি, অবগত হও। প্রণিপাত ( দীর্ঘ প্রণাম
), সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা ও গুরুসেবা দ্বারা প্রসন্ন হয়ে তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী তোমাকে সেই
ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ করবেন।’ এই আদেশ ও উপদেশ, চণ্ডীর সুরথ-ঋষি সংবাদে অভিব্যক্ত হয়ে
পূর্ণরূপে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। গীতার উক্তি-
“শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপর: সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।” (
৪/৩৯ )
–‘শ্রদ্ধাবান্ ( গুরুবাক্যে ও বেদান্তোপদেশে
বিশ্বাসী ), জ্ঞাননিষ্ঠ ও মুমুক্ষু অবশ্যই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান
লাভ করে জন্মান্তরগ্রহণ বা লোকান্তরগমন না করেই শাশ্বতী শান্তি বা মোক্ষ প্রাপ্ত
হন।’ –এর সাক্ষাৎ উদাহরণ হচ্ছে চণ্ডীতে; সমাধি বৈশ্যের পবিত্র চরিত্র। তিনি মেধা
মুনির উপদেশে বাহ্যপূজারূপ ভক্তিমূলক কর্মানুষ্ঠান দ্বারা মহাশক্তির সন্তোষ বিধান
করে একমাত্র তাঁর কৃপারূপ বর দ্বারাই মুক্তিপ্রদ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।
গীতার
পঞ্চম অধ্যায়ে – সন্ন্যাসযোগ। এখানে শ্রীভগবান বললেন,
“সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ।
তয়োস্তু
কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগ বিশিষ্যতে”।। ( ৫/২)
–‘কর্মের ত্যাগ ও কর্মের অনুষ্ঠান উভয়ই
মুক্তিমার্গ; কিন্তু তাদের মধ্যে জ্ঞানহীন কর্ম সন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মের
অনুষ্ঠান উৎকৃষ্টতর।’ আরও বললেন, “যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তৎ
যোগৈরপি গম্যতে।” (৫/৫) – ‘জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসিগণ মোক্ষ নামক
যে ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হন, কর্মযোগিগণও সেই ব্রহ্মপদই লাভ করেন।’ চণ্ডীতে এর
সুদৃষ্টান্ত বিরাজিত- রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, তীব্র বৈরাগ্যযোগে কর্মত্যাগ করলেও
ঋষি পুনরায় তাঁদেরকে কর্মময় সাধনায় নিযুক্ত করে কর্মযোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন
করেছিলেন আর সমাধি বৈশ্য যে কর্মময় অনুষ্ঠান দ্বারা জ্ঞানময় সংসিদ্ধি লাভ
করেছিলেন, তা-তেও কর্মযোগের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গীতার
ষষ্ঠ অধ্যায়ে- অভ্যাস যোগ। এখানে ভগবৎ উক্তি,
“প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে
স্থিতঃ।
মনঃ
সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ।। ( ৬/১৪ )
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ।
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি।।” (
৬/১৫ )
– ‘প্রশান্তচিত্ত, ভয়রহিত, ব্রহ্মচর্য পালন ও
গুরু সেবাদি ব্রতে স্থিত, মদ্গতচিত্ত ও মৎপরায়ণ যোগী ( সাধক ) মন একাগ্র করে নিত্য ধ্যানাভ্যাস করবেন। এরূপে
সদা সংযতভাবে মন সমাহিত করে যোগী আমার স্বরূপভূত মোক্ষপ্রদ পরম শান্তি প্রাপ্ত
হন।’ এই উপদেশের অনুরূপ সাধনা চণ্ডীতে সুরথ-সমাধির চরিত্রে দেখা যায়। তাই চণ্ডীর
মন্ত্রে আছে- “নিরাহারৌ যথাহারৌ তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ”। ( ১৩/১১ ) গীতাতে অভ্যাস
যোগের সর্বশ্রেষ্ঠ উপদেশ-
“সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।। ( ৬/২৯
)
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।” ( ৬/৩০ )
–‘সমাধিমান পুরুষ সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শী হয়ে
স্বীয় আত্মাকে ব্রহ্মাদিস্থাবরান্ত সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে স্বীয় আত্মাতে দর্শন
করেন। যিনি সর্বভূতে সকলের আত্মা আমাকে
এবং সর্বাত্মা আমাতে ব্রহ্মাদি সর্বভূতকে দর্শন করেন, তাঁর ও আমার একাত্মতা হেতু
আমি তাঁর অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না।’ গীতার এই আত্মময় এবং
পরমাত্মময় উপদেশ চণ্ডীতে নানা প্রকার লীলানন্দের মধ্য দিয়ে সর্বত্র অনুস্যূত ও
সুবিকশিত।
গীতার
সপ্তম অধ্যায়ে - জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার
ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে
পরাম্।
জীবভূতাং
মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ ।।” ( ৭/৪-৫)
– ‘ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও
অহংকার –এই আট প্রকারে আমার ঐশ্বরী মায়াশক্তি ( অপরা প্রকৃতি ) বিভক্ত। হে
মহাবাহো, এটি আমার অনর্থকরী বন্ধনাত্মিকা নিকৃষ্টা প্রকৃতি। কিন্তু এ থেকে অত্যন্ত
স্বতন্ত্র আমার প্রকৃষ্টা প্রকৃতি অবগত হও। জগতের অন্তঃপ্রবিষ্ট সেই জীবভূতা
প্রকৃতি ( পরা প্রকৃতি ) এই জগৎ প্রপঞ্চ ধারণ করে আছেন।’ চণ্ডীতে এই পরা এবং অপরা
প্রকৃতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের মধ্যে বিভিন্ন শক্তিরূপে আবির্ভূতা হয়ে লীলানন্দ
প্রকাশ করেছেন। পরিশেষে সমস্ত
অপরাশক্তিসমূহ পরা প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে মহাশক্তির অদ্বিতীয় মহিমা ঘোষণা করেছেন।
গীতার “বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি” ( ৭/১০ ) ‘
আমি বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি’ এই উক্তি চণ্ডীতে আরও ব্যাপকত্ব প্রাপ্ত হয়ে মন্ত্রধ্বনি
উত্থিত হয়েছে-
“যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ
সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।” (
৫/২০-২২ )
গীতাতে ভগবৎ উক্তি – “দৈবী
হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া” ( ৭/১৪ ) ‘ আমার এই দৈবী
গুণময়ী মায়া নিশ্চয়ই দুরতিক্রম্যা’ – চণ্ডীতে গুণময়ী এবং গুণাতীতা মহামায়ার লীলা,
তত্ত্ব এবং রহস্য সমস্তই উদ্ঘাটিত হয়েছে। তাই দেবগণ মাকে স্তব করেছিলেন, “গুণাশ্রয়ে
গুণময়ে নারায়ণী নমোহস্তুতে”। ( ১১/১১ ) গীতার আর্ত,
জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী এবং জ্ঞানী এই চার প্রকার সাধকের ( ৭/১৬ ) বিবরণ চণ্ডীতে
দৃষ্টান্ত দ্বারা অভিব্যক্ত। গীতার এই অধ্যায়ের শেষ দিকে ভগবান বলেছেন, “নাহং
প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ”- ‘আমি যোগমায়া দ্বারা আবৃত বলে
সকলের নিকট প্রকাশিত হই না।’ চণ্ডীতে দৃষ্ট হয়- যোগমায়ার এই আবরণশক্তি বিষ্ণুরও ‘যোগনিদ্রা’
রূপে ক্রিয়াশীলা।
গীতার
অষ্টম অধ্যায়ে- অক্ষর ব্রহ্মযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ”।। ( ৮/১৪ )
–‘যিনি একাগ্র মনে আমাকে যাবজ্জীবন নিরন্তর
স্মরণ করেন, সেই সদা স্মরণশীল যোগীর আমি সহজলভ্য’। ভগবান আরও বলেন,
“পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা
লভ্যস্ত্বনন্যয়া।
যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং
ততম্”।। ( ৮/২২ )
– ‘হে পার্থ, সকল জীবজগৎ পরমেশ্বরের মধ্যেই
অবস্থিত। ঘটাদি যেমন আকাশ দ্বারা অন্তরে ও বাহিরে ব্যাপ্ত, সেইরূপ এই সমগ্র জগৎ
ঈশ্বর কর্তৃক পরিব্যাপ্ত। অনন্যা ভক্তি দ্বারা সেই পরম পুরুষকে লাভ করা যায়’।
মহাশক্তিময় ভগবানের এসব জ্ঞান-ভক্তিময় উক্তি চণ্ডীতে সুবিকশিত ও জীবন্তরূপ পরিগ্রহ
করে নানা প্রকারে জীব জগতের মঙ্গল সাধন করেছে, করছে এবং করবে। দেবগণ, ঋষিগণ ও সুরথ
– সমাধি প্রভৃতি সকলেই ভক্তি বলে দেব দর্শন করে কৃত কৃতার্থ। চণ্ডীতে ভগবান ও ভগবতী যথাযথভাবে শরণাগত ভক্তগণের দুঃখ
দূর করে অভীষ্ট পূরণ করেছিলেন। গীতার ক্ষর, অক্ষর, অধ্যাত্ম, অধিদৈব প্রভৃতি
তত্ত্ব চণ্ডীতে দৃষ্টান্তমধ্যে সুবিকশিত রয়েছে।
গীতার
নবম অধ্যায়ে- রাজযোগ। এখানে ভগবান বলেছেন,
“ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা”। (
৯/৪ )
–‘আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর ও অব্যক্তমূর্তি; আমার
দ্বারা এই সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত’।
“সর্বভূতানি
কৌন্তেয় প্রকৃতি যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্”।। (
৯/৭ )
- ‘হে কৌন্তেয়, প্রলয়কালে সকল ভূত আমার ( ত্রিগুণাত্মিকা
মায়াতে ) প্রকৃতিতে লীন হয়। আবার সৃষ্টিকালে আমি তাদের সৃষ্টি করি’।
“ প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ।
ভূতগ্রামমিমং
কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ”।। ( ৯/৮ )
–
‘স্বীয় অবিদ্যারূপ ( মায়াকে ) প্রকৃতিকে বশীভূত করে প্রকৃতি পরতন্ত্র এবং
জন্মমৃত্যু-অধীন ভূতগণকে আমি পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি করি’। প্রকৃতিরূপিণী মহামায়ার এসব
তত্ত্ব চণ্ডীতে শ্রদ্ধাভক্তি দ্বারা রসময় হয়ে লীলারূপে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
গীতায় ভগবৎ উক্তি,
“অবজানন্তি
মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্” ।। ( ৯/১১ )
–‘আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব এবং সকলের
অন্তরাত্মা হলেও মনুষ্যদেহ আশ্রয়পূর্বক ব্যবহার করি বলে ( রাক্ষসী, আসুরী ও মোহিনী
প্রকৃতিতে আশ্রয়করী বিক্ষিপ্তচিত্ত ) মূঢ়গণ আমার ( আকাশকল্প ) পরমাত্মতত্ত্ব না
জেনে আমাকে অবজ্ঞা করে’।
“মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ।
রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং
শ্রিতাঃ”।। ( ৯/১২ )
–‘বৃথাশা বিফলকর্মা ও নিষ্ফলজ্ঞান অবিবেকিগণ
স্বাত্মভূত আমাকে অবজ্ঞা করার জন্য রাক্ষসী, আসুরী ও মোহিনী ( দেহাত্মবুদ্ধিকরী )
প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়ে থাকে’। এই ‘রাক্ষসী’, ‘আসুরী’ ও ‘মোহিনী’ প্রকৃতির
আশ্রিতগণের বিচিত্র ক্রিয়াশীলতাই চণ্ডীতে যুদ্ধরূপে সুচিত্রিত। গীতায় ভগবান আরও
বলেছেন,
“যৎ
করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোসি দদাসি যৎ।
যৎ
তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ম মদর্পণম্” ।। ( ৯/২৭ )
– ‘ হে কৌন্তেয়, যা অনুষ্ঠান করো, যা আহার করো,
যা হোম করো, যা দান করো এবং যে তপস্যা করো, সে সমস্তই আমাকে সমর্পণ করবে’। -এই
সমর্পণ রহস্য চণ্ডীতে অস্ত্র সমর্পণ রহস্যে বিশেষভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তাছাড়া সমর্পণ
বা শরণাগতি দ্বারাই চণ্ডী মহাগ্রন্থ নানা প্রকারে সুসজ্জিত ও অলঙ্কৃত রয়েছে।
গীতার
দশম অধ্যায়ে – বিভূতিযোগ। এখানে ভগবান জাগতিক প্রধান প্রধান চেতন
বস্তুকে ও বিশেষ অবস্থাকে ভগবৎ বিকাশরূপে ধারণা করার জন্য ভক্তকে উপদেশ দিয়ে
বলেছেন,
“যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং
শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ
ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্”।। ( ১০/৪১ )
–‘যা যা ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা উৎসাহশালী
সে সকলই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলে জেনো’। গীতার এইসব জ্ঞানময় উক্তি চণ্ডীতে আরও
ব্যাপকভাবে প্রকটিত ও ঐশ্বর্যময় ভগবতী-লীলারূপে বর্ণিত হওয়ায় তা আরও
মাধুর্য-মণ্ডিত হয়ে সুবিকশিত। এভাবে গীতার জ্ঞানময় বিভূতির সহিত ভক্তিময় শরণাগতি
এবং স্তব-স্তুতির মন্দাকিনী-ধারা সংযুক্ত হয়ে চণ্ডীতে প্রেমানন্দময়
অমৃত-প্রস্রবণের সৃষ্টি করেছে। বিশেষতঃ এ অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন, “অধ্যাত্মবিদ্যা
বিদ্যানাং” ( ১০/৩২ ) অর্থাৎ ‘বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি
অধ্যাত্ম বিদ্যা’ । এরূপে স্বয়ং ভগবান আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানময় ভাব স্বীকারপূর্বক
সকল বিদ্যার মধ্যে এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথিত গীতার
অধ্যাত্ম বিদ্যা দেবী মাহাত্ম্যের সর্বত্র নানা প্রকারে মূর্ত ও পরিস্ফুট হয়েছে।
গীতার
একাদশ অধ্যায়ে – বিশ্বরূপদর্শনযোগ। এখানে
ভগবান প্রথমেই দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রভৃতির
অভিব্যক্তি ভক্ত অর্জুনকে দেখালেন। আর, ঋগ্বেদের অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবীসূক্ত; যাতে
চণ্ডী-ত্ত্ত্ব বীজাকারে বিরাজমান, সেই দেবীসূক্তেও মহাশক্তির সহিত অভেদাত্মক
অনুভূতিতে মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু
প্রভৃতি ধারণ করার উল্লেখ করে অপূর্ব শক্তির পরিচয় প্রদান করেছেন। গীতাতে অর্জুনকে
বিভূতি দেখার জন্য ভগবান ‘দিব্যচক্ষু’ প্রদান করেছিলেন। অর্জুন তথাপি
বিভূতি দর্শনে ভীত হয়ে তা সংবরণের নিমিত্ত প্রার্থনাপূর্বক ভগবানকে পুনঃ পুনঃ
নমস্কার করেছিলেন। কিন্তু চণ্ডীতে সাধক ভক্তগণ আরও উন্নত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ায়
তাঁরা সাক্ষীভাবে বীর্যময় অপূর্ব শক্তিলীলা দর্শনে সমর্থ হয়েছিলেন। গীতাতে
অর্জুনের উক্তি,
“অমী চ ত্বাং
ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ
সর্বে
সহৈবাবনিপালসঙ্ঘৈঃ।
ভীষ্মো দ্রোণঃ
সূতপুত্রস্তথাহসৌ
সহাস্মদীয়ৈরপি
যোধমুখ্যৈঃ।। ( ১১/২৬)
বক্ত্রাণি তে
ত্বরমাণা বিশন্তি
দংষ্ট্রাকরালানি
ভয়ানকানি।
কেচিদ্বিলগ্না
দশনান্তরেষু
সংদৃশ্যন্তে
চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ।। ( ১১/২৭ )
অর্থাৎ
‘রাজন্যবর্গ সহ ঐ ধার্তরাষ্ট্রগণ এবং মৎপক্ষীয় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি প্রধান
যোদ্ধাগণ, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের সহিত আপনার দংষ্ট্রাকরাল ভীষণ মুখগহ্বরে
দ্রুতবেগে প্রবেশ করছেন। মুখপ্রবিষ্টদের মধ্যে কেউ কেউ চুর্ণিতমস্তক হয়ে ভক্ষিত
মাংসখণ্ডসমূহের ন্যায় আপনার দন্তসন্ধিস্থলে সংলগ্ন হচ্ছেন, দেখছি’। গীতার এই ভীষণ অভিব্যক্তি চণ্ডীতে
ভীষণতর হয়ে করালভাব প্রাপ্ত হয়েছে। তাই চণ্ডীতে চামুণ্ডার বিবরণে দেখা যায়-
“পার্ষ্ণিগ্রাহাঙ্কুশগ্রাহি-যোধ-ঘণ্টা-সমন্বিতান্।
সমাদায়ৈকহস্তেন মুখে চিক্ষেপ বারণান্।। ( ৭/১০ )
তথৈব যোধং তুরগৈঃ রথং সারথিনা সহ।
নিক্ষিপ্য বক্ত্রে
দশনৈশ্চর্বয়ত্যতিভৈরবম্।। ( ৭/১১ )
অর্থাৎ
‘পৃষ্ঠরক্ষক, মহামাত্র ( মাহুত ), ( গজারূঢ় ) বীর ও গলঘণ্টাদি-সংযুক্ত হস্তিসকলকে
একহস্তে গ্রহণ করে চামুণ্ডা মুখে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। এরূপে চামুণ্ডা অশ্বের সহিত
অশ্বারোহী যোদ্ধাকে এবং সারথির সহিত রথকে বদনমধ্যে নিক্ষেপ করে দন্তসমূহ দ্বারা
অতি ভীষণরূপে চর্বণ করতে লাগলেন’।
এরূপে
চন্ডীর দেবীযুদ্ধ ‘দারুণ’ ও ‘সর্বলোক ভয়ঙ্কর’ হলেও সাক্ষীরূপে
অবস্থিত দেবগণ, মহর্ষিগণ এবং ভক্তগণ, এখানে অভয়া মায়ের অপূর্ব শক্তিলীলা দর্শনে
বিস্মিত, পুলকিত এবং প্রেমভক্তিতে অবনত।
ভগবান গীতায় অর্জুনকে বিশ্বরূপ
দর্শনকালে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভাবী-চিত্র দেখিয়ে বলেছিলেন,
“ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্” –
‘আমার দ্বারা এরা ( ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধা ) পূর্বেই
নিহত হয়েছে। হে সব্যসাচী, তুমি নিমিত্তমাত্র হও’। এই ‘নিমিত্তমাত্র হও’
উক্তিটি গীতার একটি বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক স্তর নির্দেশ করে। সাধনার এই স্তরে নিজ
কর্তৃত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয় না, কিন্তু চণ্ডীতে দেবীযুদ্ধ বা আধ্যাত্মিক সাধনার
স্তর আরও উচ্চে অবস্থিত। সেখানে একদিকে গীতার ‘নিমিত্তমাত্র’ ভাবটিকেও
শক্তিরূপিণী প্রকৃতির কার্য বলে অনুভব করতে হবে এবং তৎসহ স্বকীয় নির্লিপ্ত
আত্মবোধময় সাক্ষীভাব জাগিয়ে তুলতে হবে। অপরদিকে সর্ববিধ কর্তৃত্বাভিমান ভগবচ্চরণে
সমর্পণ করে শরণাগত হতে হবে। তখন ভক্ত সাধক সাক্ষীভাবে দর্শন করবেন; মহাশক্তি
পরমাত্মময়ী মা স্বয়ং ভক্তের পক্ষে সর্বাবস্থায় যুক্ত রয়েছেন; যেখানে ‘নিমিত্তমাত্র’
হওয়ার ভাবটিও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এখানেই গীতার
সহিত চণ্ডীর আধ্যাত্মিক স্তরের পার্থক্য।
গীতার
দ্বাদশ অধ্যায়ে- ভক্তিযোগ। এখানে ভগবান অভ্যাসযোগ দ্বারা চিত্ত
স্থির ও ভক্তিলাভের উপায় নির্দেশ করার পর বলেছেন,
“অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্র করুণ এব চ।
নির্মমো
নিরহংকারঃ সমদুঃখসুখ ক্ষমী।।
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে
প্রিয়ঃ”।। ( ১২/১৩-১৪ )
–‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন,
মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে
দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা
তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয়
ভক্ত’। এই ভগবৎ উক্তির অন্তর্গত ‘নিরহংকার’ এবং ‘মমত্ব’হীনতাই
চণ্ডীতে ‘অহংমমেতি’ ভাব বিনাশদ্বারা আত্মভাব ও প্রেমভাব লাভে পর্যবসিত
হওয়ায়, সুবিকশিত ! এই ভাব দু’টি লাভ হলে ভগবৎ কথিত অন্যান্য অবস্থাসমূহ আপনা থেকেই
লব্ধ হয়।
গীতার
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে- ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ। এখানে
চতুর্বিংশতি তত্ত্বময় শরীরকে ক্ষেত্র বলা হয়েছে আর ক্ষেত্রজ্ঞ নির্ণয় করে ভগবান
বলেছেন,
“সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।। ( ১৩/১৪ )
– ‘তিনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে বিরাজিত
আছেন। সকল শরীরের হস্ত ও পদ, চক্ষু ও কর্ণ, মস্তক ও মুখ তাঁর হস্ত ও পদ, চক্ষু ও
কর্ণ এবং মস্তক ও মুখ’।
“সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং
সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
অসক্তং সর্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ”
।। ( ১৩/১৫ )
- ‘তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়-বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ
ইন্দ্রিয়-বিবর্জিত, সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সমুদয় গুণের
আশ্রয়’। “ভূতভর্তৃ চ তজ্জ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ” ( ১৩/১৭ ) –‘তিনি
সর্বভূতের পালক, সংহারক ও স্রষ্টা’। - এ সম্বন্ধে এবং দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে চণ্ডীতে
নানা প্রকার রহস্য এবং সাধন-তত্ত্ব বিশেষরূপে ব্যাক্ত হয়েছে। ভগবান বলেছেন,
“প্রকৃত্যৈব
চ কর্মাণি ক্রিয়মাণানি সর্বশঃ।
যঃ পশ্যতি তথাত্মানমকর্তারং স পশ্যতি”।। ( ১৩/৩০
)
–‘প্রকৃতিই সর্বভাবে সকল কর্ম করেন এবং আত্মা
অকর্তা, যিনি এরূপ দর্শন করেন, তিনিই যথার্থদর্শী’। - গীতার এই প্রকৃতি-তত্ত্ব এবং
প্রকৃতির প্রাধান্য চণ্ডীতে বিভিন্ন অবস্থায় ব্যাপকভাবে অভিব্যাক্ত হয়েছে।
গীতার
চতুর্দশ অধ্যায়ে- গুণত্রয়বিভাগযোগ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই গুণত্রয় চণ্ডীতে তিনটি চরিত্রে বিরাটরূপে
পরিস্ফুট হয়েছে। কেননা, ত্রিগুণের অভিব্যক্তিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং
দৃশ্যমান জীব জগৎ ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির রহস্যই চণ্ডীর চরিত্রাবলিতে সর্বত্র
উদ্ঘাটিত এবং উজ্জ্বলীকৃত।
গীতার
পঞ্চদশ অধ্যায়ে- পুরুষোত্তম যোগ। এখানে ভগবান বলেছেন, “মমৈবাংশো
জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ”। ( ১৫/৭ ) –‘সংসারে কর্তাভোক্তারূপে
প্রসিদ্ধ জীব আমারই সনাতন অংশ’। -এই ভাবটি চণ্ডীর প্রথম শ্লোক থেকেই ক্রমে বিকাশ
প্রাপ্ত হয়ে পরিশেষে চতুর্বর্গ ফলদায়ক বিরাট কল্পতরুরূপে পরিণত হয়েছে। এখানে
বর্ণিত ‘ক্ষর’, ‘অক্ষর’ এবং ‘পুরুষোত্তম’ ভাবসমূহ চণ্ডীতে মূর্ত হয়ে
সুবিকশিত হয়েছে।
গীতার
ষোড়শ অধ্যায়ে- দৈবাসুর-সম্পদবিভাগযোগ। এখানে বিবৃত সাতাশটি
দৈবী সম্পদ এবং তৎ বিপরীত সাতাশটি আসুরী সম্পদই চণ্ডীতে দেবাসুর
সংগ্রামের মৌলিক উপাদানস্বরূপ। এ অধ্যায়ে বর্ণিত দৈবী ও আসুরী প্রকৃতিসমূহ চণ্ডীর
সর্বত্র মূর্তি গ্রহণপূর্বক সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হয়ে দেবী যুদ্ধরূপে আত্মপ্রকাশ
করেছে। সুতরাং এই অধ্যায়ে প্রতিপাদ্য দৈবাসুর সম্পদই যে চণ্ডীতে ক্রমবিকাশ প্রাপ্ত
হয়ে অপূর্ব সাধন-রহস্য পরিব্যক্ত করেছে এ সম্বন্ধে কোন বিতর্ক বা সন্দেহের
অবকাশ নেই। ‘গীতার পরবর্তী বা পরিপূরক অবস্থা চণ্ডী’-এ বাক্যের সত্যতা ও
সার্থকতা গীতার এই অধ্যায়ে বিশেষরূপে ব্যক্ত ও প্রমাণিত।
গীতার
সপ্তদশ অধ্যায়ে- শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ। এখানেও
ত্রিগুণের বিশেষ বিশেষ অবস্থা আলোচিত। চণ্ডীতে সত্ত্ব, রজঃ, তমোগুণেরই বিরাট
অভিব্যক্তি। এ সম্বন্ধে ইতোপূর্বে গুণত্রয় বিভাগ অধ্যাযে উল্লেখ করা হয়েছে।
গীতার
অষ্টাদশ অধ্যায়ে –মোক্ষযোগ। এখানে ভগবান কামনামূলক কর্মত্যাগ ও
কর্মফল ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে উপদেশ দিয়েছেন। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি উপদেশে
বলেছেন,
“যস্য নাহঙ্কৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন
লিপ্যতে।
হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ন হন্তি ন নিবধ্যতে”।। (
১৮/১৭ )
–‘আমি
কর্তা এই অভিমান যাঁর নেই এবং যাঁর বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সমস্ত
প্রাণী হত্যা করলেও হত্যাকারী হন না, বা হত্যা ক্রিয়ার ফলে আবদ্ধ হন না’। এর
ভাবার্থ হচ্ছে –‘যাঁর অহংকার ভাব নেই, যিনি নির্লিপ্তভাবে কর্ম করেন, তিনি সর্ববিধ
কর্ম করেও কর্ম-বন্ধনে আবদ্ধ হন না’। এতৎব্যতীত এখানে ত্রিগুণভেদে জ্ঞানের ত্রিবিধ
ভাব বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর ভগবান বলেছেন,
“অহঙ্কারং
বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্।
বিমুচ্য
নির্মমঃ শান্তো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে”।। ( ১৮/৫৩ )
–‘অহংকার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ ত্যাগ
করে মমতাবর্জিত এবং প্রশান্ত চিত্ত মানুষ ব্রহ্মজ্ঞানলাভে সমর্থ হন’। -এসব ভগবৎ
উক্তিই চণ্ডীতে বৈচিত্র্যময় উদাহরণের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঋদ্ধ হতে হতে
পরিপূর্ণত্ব লাভ করেছে।
গীতার এই অধ্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - শরণাগত
হওয়ার জন্য ভগবানের পুনঃ পুনঃ আদেশ এবং উপদেশ। আবার চণ্ডী বা দেবী মাহাত্ম্যে,
শরণাগতিরই প্রেমানন্দময় সমুজ্জ্বল বিকাশ দ্বারা সর্বতোভাবে উদ্ভাসিত। এরূপে
গীতার অন্যান্য শ্লোকসমূহও বিচার করলে দেখা যায় যে, বহু শ্লোকের ভাব চণ্ডীতে
সুনিপুণ উদাহরণের মধ্যে মূর্ত হয়ে জ্ঞানী, কর্মী, যোগী এবং ভক্ত সকলেরই যথাযথ
সাধন-পন্থা সুগম করতঃ তাঁদের অভীষ্ট
সিদ্ধি বা মোক্ষ প্রাপ্তির সহজ উপায় নির্দেশ করে দিয়েছে। সুতরাং সপ্তশতী
অনুধ্যানে সর্বশ্রেণির সাধকগণ অমৃতত্ব লাভে ধন্য ও কৃতকৃতার্থ হবেন - এরূপ বলা
চলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন